এস এম মুকুল/

মানুষ প্রতিনিয়ত বদলায়, সেটা প্রয়োজনে হোক অথবা অপ্রয়োজনে। প্রকৃতির নিয়মেও বদলায় মানুষ। অবস্থান আর পরিস্থিতির কারণেও বদলায়। আমরা দেখেছি, বিশ্বরাজনীতিতে বদলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে আমেরিকায় ক্ষমতায় আসেন বারাক ওবামা। দিনবদলের স্লোগানে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দেশ শাসনের দায়িত্ব পেয়েছে। সম্প্রতি রাজনৈতিক আদর্শ বদলের মাধ্যমে নতুন ধারার সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া। এই বদলে দেয়ার জোয়ারে আমজনতা গা-ভাসিয়ে দেবে হয়তো। আবারো কেউ হয়তোবা ক্ষমতায় আসবে বদলে দেয়ার নতুন কায়দা-কানুন নিয়ে। প্রশ্ন হলো, এসবের ফলে আদৌ কি বদলে যাচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি? কতখানি বদলেছে জীবনমান? আমরা ঠিক একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সবকিছু বদলে দেয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করছি। অথচ সবার আগে যেটা প্রয়োজন তা করছি না! দেশের পরিবর্তন চাইলে আগে নিজেকে বদলাতে হবে, তারপর দল, সংগঠন, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি; ক্ষমতার মোহ আর শাসনের নামে শোষণের মনোবৃত্তি বদলাতে হবে।

বাংলাদেশে বইছে পরিবর্তনের হাওয়া। আমরা পরিবর্তন চাই। এর প্রয়োজন আছে। কিন্তু কীভাবে হবে সেই পরিবর্তন? কোনো আদর্শিক পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দল তাদের অসাধু মন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টাদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়নি। ছাত্রলীগের দাপুটে দাঙ্গাবাজদের দণ্ডিত হতে দেখা যায়নি। তারা কী করে দিনবদল করবেন? দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীকে অপসারণ করতে না পারলে দিনবদল কীভাবে সম্ভব? আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রী গত আমলের দুর্নীতি আর দুঃশাসনের মনোভাব একটুও বদলাননি। যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়ে দোষী ও দণ্ডিত হওয়ার পরও সেই দলটির সঙ্গ ত্যাগ করেননি। তাহলে কীভাবে তিনি নতুনধারার সরকার গঠন করবেন? যারা ভেতরে-বাইরে, মননে-চিন্তায়, কর্মে-আদর্শে বদলান না, তারা কী করে দেশ ও এর মানুষকে বদলে দেবেন?

এ দুটি দলের রাজনীতিকরা শুধু দল ও ব্যক্তিস্বার্থে কী পরিমাণ মিথ্যাচার করতে পারেন তার নমুনা প্রতিনিয়ত দেখছে জনগণ। আমরা কখনো এক হয়ে বলতে পারিনি আমাদের দেশ আমরাই গড়ব। জিএসপি সুবিধা বাতিল হলে এ দেশের ক্ষতি হয়। তারপরও তারা এটা নিয়ে রাজনীতি করেন। সরকারের ব্যর্থতা থাকলেও বিরোধী দল দেশবান্ধব ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় না। আবার বিরোধীরা কখনো এগিয়ে আসতে চাইলে সরকার আশ্রয় দেয় না। প্রাকৃতিক বিপর্যয় অথবা দুর্ঘটনা ঘটলে বিরোধী দল সোচ্চার হয়। সরকারের ত্রুটি বলে বেড়ায়। ত্রাণ যাচ্ছে না, উদ্ধারকার্য সঠিক হচ্ছে না ইত্যাদি বলে এ ঘটনায় কোনো না কোনো রাজনৈতিক রঙ লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আমরা দেখতে পাই না, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা দুর্ঘটনায় সরকারের পাশাপাশি পরিস্থিতি উত্তরণে বিরোধী দলও কাজ করছে। সরকারের দায় ও দায়িত্ব বেশি হলেও বিরোধী দলগুলোর দায়িত্বও কম নয়। কারণ তারাও জনপ্রতিনিধি। কিন্তু তারা কী তা পরিপালন করেন? যে নেতাকর্মীদের হরতালের নামে মিছিল, সমাবেশ, ভাংচুর, জ্বালাও-পোড়াও আর দখলবাজির কাজে ব্যবহার ও প্রশ্রয় দেয়া হয়; তারা কি উদ্ধার ও সহায়তার কাজে তাদের কাজে লাগান? সরকারের সাহায্য-সহযোগিতার অপ্রতুলতা বা ত্রুটি নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি তারা নিজেদের অঢেল সম্পদ থেকে কতটুকু সাহায্য দেন? যারা নিজেরা বদলান না, তারা বদলের নামে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই পরিবর্তনের বুলি আওড়ান মাত্র।

এসব দেখতে দেখতে  জনগণ অতিষ্ঠ। আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তবে জনগণের মধ্যে এখনো কোনো সুস্থির চিন্তা নেই। তাই দল আর মার্কার বাইরে ব্যক্তি ইমেজ বা যোগ্যতার বিচার হচ্ছে না। যত দিন না এই পরিবর্তন আসবে, তত দিন রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনও আশা করা যায় না। রাজনীতিকরা নিজেরা বদলাবেন না, জনগণকেই তাদের বদলে যাওয়ার স্রোতে আসতে বাধ্য করতে হবে।

এবার যদি জনগণ বিশেষ  করে তরুণসমাজ দুই জোটের ভোটব্যাংক ভেঙে ব্যক্তি ইমেজকে গুরুত্ব দেয়, তাহলে পাল্টে যেতে পারে রাজনীতির ভোল। দেশে যেহেতু তৃতীয় শক্তি নেই, সেহেতু কোনো জোট বা দলকে গুরুত্ব না দিয়ে ব্যক্তি ইমেজের প্রতি জনগণের সমর্থন বাড়ালে রাজনীতিতে নতুন মুখ আসবে। আগামী নির্বাচনে যদি ব্যক্তি ইমেজের কারণে ১০০ জন নির্বাচিত হন, তাহলেই পাল্টে যাবে পরবর্তী রাজনীতির রূপরেখা। এ অবস্থাটা সব দলই আন্দাজ করতে পারছেন। অনেক নেতা, সংসদ সদস্য এমনকি মন্ত্রী পর্যন্ত মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কথা বলছেন প্রকাশ্যে। কাজেই ক্ষমতা যে জনগণের হাতে, সেটা বুঝিয়ে দেয়া দরকার। জনগণের অসন্তোষ গুরুত্ব না দিয়ে একদল হরতাল ডাকবে, আর অন্য দল তা আমলে না নিয়ে জনগণের দুর্ভোগ বাড়াবে— এমনটি আর চলতে দেয়া যায় না। এ মানসিকতার পরিবর্তন চাই।

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here