সঞ্জিব দাস।
গলাচিপা: জোয়ার-ভাটার তালে শিক্ষাবিহীন অন্ধকারেই বেড়ে উঠছে তারা। পা রাখে নি স্কুলের চৌকাঠে। কানে শুনে নি ঘন্টার আওয়াজ। হাতে নেয় নি বই-খাতা-কলম।
কেবল স্কুল না থাকায় পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চরের শিশুরা বাধ্যতামুলক শিক্ষা থেকে এভাবেই হচ্ছে বঞ্চিত । ওই সব চরে এখনও গড়ে উঠেনি সরকারি কিংবা বেসরকরি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এ কারণে শিশুরা পড়ালেখা না শিখে সংসারে রোজগারের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন ধরণের পরিশ্রমী কাজে ঝুঁকে পড়ছে। এসব প্রতিকূলতার পরেও কিছু ছেলে মেয়ে দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে অন্যত্র গিয়ে শিক্ষা অর্জন করছে। আবার অনেকে ব্যর্থ হয়ে পড়ালেখা ছেড়েও দিয়েছে।
সরেজমিনে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার রাঙ্গাবালী ইউনিয়নের চরকাশেম, মাদারবুনিয়া, ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের চর নজির ও চর ইমারশন ঘুরে এমনই চিত্র চোখে পড়ে। ওই চারটি চরে স্কুল না থাকায় প্রায় দুই হাজার ছেলে মেয়ে শিক্ষাজ্ঞান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমনি একটি চর চরকাশেম। চারপাশে নদী বেষ্টিত চর এটি। ওই চরে প্রায় এক হাজার লোকের বসবাস। এর মধ্যে শিশু রয়েছে প্রায় দুইশত। কিন্তু ওই সব শিশুর জন্য নেই কোনো স্কুল।
তাই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ওরা। ওদের পরিবারের লোকজন জানে না শিক্ষার গুরুত্ব। পরিবারের লোকজন ওই সব শিশুদেরকে পড়ালেখা না শিখিয়ে সংসারের কাজে লাগিয়েছে। ওই শিশুদের উপার্জনে চলছে সংসারের খরচ। ওই চরের শিক্ষা বঞ্চিত শিশু সালমা আক্তার (১১) বলে, চরে স্কুল নেই। ল্যাহাপড়াও করি না। মা’র লগে কাম কাইজ কইরা খাই। ল্যাহা পড়া কি করমু ? সালমার হয়ত এ বয়সে চতুর্থ শ্রেণিতে লেখাপড়া করার কথা। স্কুলের বন্ধুদের সাথে কানামাছি কিংবা গোল্লাছুট খেলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে এ বয়সে মায়ের সঙ্গে সংসারের কাজের জোগান দিচ্ছে সে।
একই চরের মিরাজ (১০) বলে, আমাগো চরেতো স্কুল নাই। বাপ-মায় পড়া লেহা করায় না। মাইনসের লগে কাম কাইজ করি। আর টাকা-পয়সা আয় করি। চরের বাসিন্দা আতিকুর রহমান বলেন, চরের ছেলে মেয়েরা স্কুল দেখতে কেমন তা-ই জানে না। এখানকার ছেলে মেয়ের কথা চিন্তা করে প্রাইমারী স্কুল (প্রাথমিক বিদ্যালয়) করা প্রয়োজন। এভাবে শুধু চর কাশেম নয়, চর মাদারবুনিয়া , চর নজির ও চর ইমারশনে কোন ধরনের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা কোন স্কুল নেই। ওই সব চরের প্রায় দুই হাজার ছেলে মেয়ে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। ওরা পার হয়নি স্কুলের চৌকাঠও। এ নিয়ে অভিভাবকদের খুব একটা মাথাব্যাথা নেই।
এমনকি বাবা-মায়েরা মনে করছেন স্কুল না থাকলে কিছু যায় আসে না। এর ফলে তাদের সন্তানরা পরিবারের সাথে কৃষি ও অন্যান্য গৃহস্থালি কাজে তো সময় দিতে পারছে। স্কুল বিহীন চর গুলো ঘুরে দেখা গেছে চর কাশেম থেকে নদী পার হয়ে সড়ক পথে ৫ কিলোমিটার দূরে সামুদাফৎ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর পাশ্ববর্তী গঙ্গীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। যাতায়াত ব্যবস্থাও খারাপ।
দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে অভিভাবকদের পক্ষে শিশুদের পড়ালেখা করানো সম্ভব নহে। চর নজির মূল ভূ-খন্ড থেকে আলাদা একটি চর। নৌ-পথেই যাতায়াতের একমাত্র ভরসা। যাতায়াত পথ দুর্গম ও দুর্ভোগের হওয়ায় ওই চরের ছেলে মেয়ে স্কুলে যায় না। একইভাবে চর ইমারশনে কোন স্কুল না থাকায় ওই এলাকার শিশুরা শিক্ষা বঞ্চিত হয়ে আছে। রাঙ্গাবালী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান সাইদুজ্জামান মামুন বলেন, স্কুল না থাকায় ছেলে মেয়েরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ওই সব চরে স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হলে শিশুরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত।
এ ব্যাপারে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) গোলাম সগির প্রতিবেদককে জানান, স্কুল না থাকায় চরের ছেলে মেয়েরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না। ওই সব ছেলে মেয়েদের শিক্ষার আওতায় আনা জরুরী। এ কারণে ওই নব চরে স্কুল প্রয়োজন।
তিনি প্রতিবেদককে আরও বলেন, যেই সব চরে স্কুল নেই, সেই সব এলাকার তালিকা করে আমরা ইতিমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছি। আশা করছি, সরকার ওইসব এলাকাগুলোতে অতি শীঘ্রই স্কুল প্রতিষ্ঠা করবেন।