Tahmina Shilpi 01

আমি তাঁর ভক্ত কিংবা অনুরাগী নই।তিনি আমার প্রেমের ঠাকুর,জীবনবোধের শিক্ষক
তাহমিনা শিল্পী

‘ওগো বাঁশিওয়ালা,
বাজাও তোমার বাঁশি,
শুনি আমার নতুন নাম-
এই বলে তোমাকে প্রথম চিঠি লিখেছি,
মনে আছে তো?
আমি তোমার বাংলাদেশের মেয়ে।’

রেলগাড়ির কামরায় আমাদের হঠাৎ দেখা হয়নি।দেখা হয়নি কোন বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায়,কোন জোসনাভেজা রাতে কিংবা কোন সবুজ পাহাড়ের পাদদেশে।তবু তাঁকে আমি চিঠি লিখেছিলাম।উত্তরের অপেক্ষায় বসে ছিলাম জোয়ার-জলের দিকে চেয়ে,ভেসে গিয়েছিল আমার চলতি বেলার আলোছায়া।উত্তর আসেনি………

তারপরও সারাবেলা আমি তাঁকে চোখে হারাই।সে আমার প্রাণের পরে ঢেউ খেলে যায়।আমি বহু বাসনায় তাঁরে প্রাণপণে চাই।

সত্যি বলতে কি আমার বেশ কয়েকজন প্রেমিক ছিল এবং আছে।কিন্তু আমি তাদের কারোরই প্রেমিকা নই।এই কথাটিতে বন্ধুরা কিঞ্চিত রহস্যের গন্ধ খোঁজে।তবুও অবলিলায় আমি এর সত্যতা স্বীকার করি।আমার প্রেমিকদের প্রত্যেকেই কর্মে- গুণে আমাকে এতোটাই বিমোহিত করেছেন যে আমি আমার প্রেমের অনেকটাই তাঁদেরকে মানে তাঁদের সৃষ্টিকর্মকে সমর্পণ করেছি।তাঁদের মধ্যে অন্যতম বিশ্বকবি শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।প্রতিদিন প্রতি মুহর্তে হাসি, কান্না,দুঃখ,বিষাদে,আনন্দে আমি তাঁর সৃষ্টির কাছে আশ্রয় নেই।তাঁর সৃষ্টির মাঝে বারবার নিজেকে হারাই।আবার তাঁর সৃষ্টিতেই নিজেকে ফিরেফিরে পাই।তাই তিনিই আমার প্রেমিক,প্রাণের ঠাকুর,জীবনবোধের শিক্ষক।

এবার তবে শুরুর দিককার গল্পটা বলি,বীরপুরুষ কবিতা পড়ে প্রথমবার রবীন্দ্রনাথকে জেনেছিলাম। তখন আমার বয়স নয়।স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করে প্রথম হলাম।
‘মনে কর যেন বিদেশ ঘুরে,
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দুরে।
……………………………………..
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে,
রাঙা ধূলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।’
সেই থেকে ঘুরে বেড়ানোর নেশাটা মাথায় পাকাপোক্ত ভাবে গেড়ে বসছে।এখন বন্ধুদের কেউকেউ আমাকে মজা করে লাটিম বলে ডাকে।

‘মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু কখন খেলতে গিয়ে হঠাৎ অকারণে
একটা কি সুর গুনগুনিয়ে কানে আমার বাজে,
মায়ের কথা মিলায় যেন আমার খেলার মাঝে।
মা বুঝি গান গাইত আমার দোলনা ঠেলে ঠেলে-
মা গিয়েছে,যেতে যেতে গানটি গেছে ফেলে।’
কবিতাটির প্রতিটি শব্দে কি যেন কি ব্যাথা।কেবলই চোখ ভরে উঠে জলে।অকারণ ভয় চেপে বসে মনে।মাকে আঁকড়ে থাকি আরও বেশি শক্ত করে।মা যে আমার পরম প্রিয় অমূল্য ধন বুঝেছিলাম এই কবিতা পড়েই।

‘আমি ছিলাম ছাতে
তারায় ভরা চৈত্র মাসের রাতে।
হঠাৎ মেয়ের কান্না শুনে,উঠে
দেখতে গেলেম ছুটে।
সিঁড়ির মধ্যে যেতে যেতে
প্রদীপটা তার নিবে গেছে বাতাসেতে।
শুধাই তারে,কী হয়েছে বামী?
সে কেঁদে কয় নিচ থেকে,হারিয়ে গেছি আমি।
আহা! কী সরল শিশুমন।জেনে নিলাম সরলতা এক গুরুত্বপূর্ণ মানবিক গুণ। সন্তানের প্রতি বাবার অসীম মমতা হৃদয়স্পর্শ করেছিল ভীষনভাবে।বুঝেছিলাম বাবা নির্ভার নিশ্চিত আশ্রয়।

Tahmina Shilpiট্রামে চেপে দালিম রঙা শাড়িতে কমলা নামের মেয়েটি ট্রামে চেপে চলছিল কলেজের পথে।’তাকে দেখে যেখানে আমার নামবার সেখানে নামা হল না।’সত্যিকারের ভালোবাসলেই কেউ এমনতর আত্মভোলা হয়।

‘মনে মনে ভাবি,আর-কোনো সম্বন্ধ না থাক্,ও তো আমার সহযাত্রিণী।’ আহা! কী নির্মল প্রেমানুভূতি!
ক্যামেলিয়া ভালোবাসার রেনু মাখিয়েছিলো মনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।’কমলার পাশে বসেছে এক আধা-ইংরেজ।ইচ্ছে করছিল,অকারণ টুপিটা উড়িয়ে দিই তার মাথা থেকে,ঘাড়ে ধরে তাকে রাস্তায় দিই নামিয়ে।’ বুঝলাম ভালোবাসায় হিংসে বৈধ।

‘দামি দুর্লভ গাছ,এদেশের মাটিতে অনেক যত্নে বাঁচে।/জিগেস করলেম,নামটা কী? সে বললে,ক্যামেলিয়া।চমক লাগলো।’ বুঝতে বাকি রইলো না ভালোবাসা চিরন্তন।তাকে ভুলে যাওয়া সাচ্চা প্রেমিকের কাজ নয়।ভালোবাসায় থাকে অভিমান,গভীর অনুরাগ এবং চাপা অভিযোগ।’ইচ্ছে হল গিয়ে বলি,আমাকে দরকার কি নেই কিছুতেই।’ এযে তারই প্রমান বহন করে।

শেষমেষ সাঁওতাল মেয়ের কানে গোঁজা ক্যামেলিয়া ফুলটি আমায় উদাস করে তুলেছিল।ভারী মিষ্টিমধুর সেই কথোপকথন -‘ডেকেছিস কেনে।আমি বললেম,এইজন্যেই।’

‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,কালো তারে বলে গায়ের লোক।কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।’
বর্ণ বৈষম্যহীন ভিন্নঢঙে সৌন্দর্যের উপস্থাপনের আরেক নাম কৃষ্ণকলি।

‘মেঘলাদিনে দেখেছিলেম মাঠে…..
ঘোমটা মাথায় ছিলনা তার মোটে,
মুক্তবেণী পিঠের পরে লোটে।’ নারীর সৌন্দর্যের অপার মুগ্ধতায় মন শীতল হয়ে কালোর প্রতিও প্রেম জন্মেছিল মনে।বর্ণ বৈষম্য আন্দোলনে অপরিসীম ভূমিকা রাখে লাইনকটি।আর কেবল পুরুষ নয়,নারীরাও সম্মান করতে শিখেছে নিজেদেরকে।

রবীঠাকুরের অনবদ্য সৃষ্টি মনস্তাত্ত্বিক রোমান্টিক উপন্যাস শেষের কবিতা।একবার কিংবা বারবার পড়েও যেন শেষ হয়না পড়ার মোহ।কারণ,জীবনবোধ জাগ্রত করে ব্যক্তিত্ববান হতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে শেষের কবিতা।জীবনের জটিল মুহুর্তকে সহজ করতেও সহায়ক এই উপন্যাসের কোটেশনগুলো।এতে একদিনে যেমন অমিত রায়ের নাকউঁচু স্বভাব,অপরদিকে অমর স্বমহিমায় উদ্ভাসিত শিলং পাহাড়ের প্রকৃতিকন্যা লাবণ্য।দুটি মেরু মুখোমুখি, মাঝখানে নিদারুণ বাস্তবতা।

রবীন্দ্রজয়ন্তীতে‘যারা কাছে আছে, তারা কাছে থাক
তারা তো পাবে না জানিতে
তাহাদের চেয়ে কাছে আছো তুমি
আমার হৃদয়খানিতে।’
বিরহেও যে প্রেম কতটা শালীন সুন্দর এবং উজ্জ্বল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।তাই লাবন্য অমন করে বলতে পেরেছিল-
‘হে ঐশ্বর্যবান,
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান-
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু,বিদায়। ‘

নির্ভেজাল বাঙালি ও সাহিত্যানুরাগী প্রাণ তাই স্মরণ করে রবীঠাকুরকে উৎসবে পার্বণে।যেকোন প্রয়োজনে আয়োজনে।রবীঠাকুর তাই বারোমাস বেঁচে থাকে আমাদের মনের গহীন গোপন অলিন্দে। অনেকটাই এইরকমভাবে-
‘দূর হতে আমি তারে সাধিব,
গোপনে বিরহ ডোরে বাঁধিব।’

ওগো প্রাণেশ্বর,তুমি রবে নিরবে!!
মাঝেমাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিও!

আজি ২৫ শে বৈশাখে জন্মদিনের শুভক্ষণে প্রনমি তোমায় হে প্রেমের ঠাকুর।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here