ইয়ানুর রহমান।

যশোর : চট্টগ্রামে আটক পাঁচ ‘হরকাতুল জিহাদ (হুজি) সদস্যের মধ্যে একজন যশোরের নাজিম উদ্দিন (৪২)। তার পরিবার, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় কাউন্সিলরসহ প্রতিবেশীরা ছবি এবং বৃহস্পতিবার রাতে টিভিতে খবর দেখে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন।

শুক্রবার দুপুরে যশোরের মণিরামপুর উপজেলার দুর্গাপুরের বাসভবনে গিয়ে আটক পাঁচ ‘হুজি’ সদস্যের ছবি দেখালে নাজিমউদ্দিনের ছোটভাই আজিমউদ্দিন, মেয়ে ফওজিয়া ইয়াসমিন তুবা এবং ছোট মেয়ে সাইরম্নজিয়া ইয়াসমিন তৈয়বা তাকে শনাক্ত করেন।

তারা জানান, প্রায় সাত মাস আগে নাজিমউদ্দিন নিখোঁজ হন। এরপর বহু খোঁজ-খবর করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

এদিকে নাজিম উদ্দিনের স্ত্রী নাজমা আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে যশোর ও ঢাকায় দুই দফা সংবাদ সম্মেলন করেছি। পুলিশের কাছে কয়েক দফা গিয়েছি, কিন্তু লাভ হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘এরপর থেকে প্রতিদিন টেলিভিশনে সংবাদ দেখি। যদি তার কোনো খবর পাই। বৃহস্পতিবার টেলিভিশনে রাত ৭টা এবং ১০টার খবরে আমার স্বামীসহ কয়েকজনকে অস্ত্রসহ আটক করা হয়েছে বলে জানতে পারি। ছবিতে বামদিক থেকে দ্বিতীয় চেক ও সাদা গেঞ্জি পরিহিত মানুষটিই আমার স্বামী। বাড়ি থেকে যখন নিখোঁজ হন, তখন ওই গেঞ্জিটিই পরা ছিলেন।’

প্রসঙ্গত, ২৫ মে নাজিমউদ্দিন (জিএম নাজিম উদ্দিন ওরফে নকশা নাজিম) ঢাকা থেকে নিখোঁজ হন। সাদা পোশাকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে তার স্ত্রী নাজমা আক্তার দাবি করেন। নাজমা আক্তারের দাবি, নাজিম কোনো জঙ্গি সংগঠনের সাথে জড়িত নন।

নাজিমউদ্দিন-নাজমা দম্পতির তুবা (১৮) ও তৈয়বা (১৩) নামে দুই মেয়ে সনত্মান রয়েছে। তুবা বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে থাকেন। আর ছোট মেয়ে তৈয়বা স্থানীয় পৌরসভা বালিকা বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী।

মণিরামপুর শহরের দুর্গাপুর জামায়াত মসজিদের অদূরে মৃত হাসান আলী গাজীর বড় ছেলে নাজিম। তার ছোট ভাই আজিম ইজিবাইক চালক।

মণিরামপুর সম্মিলনী স্কুল থেকে এসএসসি ও ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশের পর স্থানীয় একটি দূধের কোম্পানিতে চাকরি করতেন নাজিম। এরপর ১৯৯৭ সালে ২৩ বছর বয়সে উপজেলার জালঝাড়া গ্রামে বিয়ে করেন। বিয়ের পরে মণিরামপুর কলেজে ডিগ্রি ভর্তি হন। ছাত্রজীবনে বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়লেও পরে রাজনীতি ছেড়ে দেন।

বিয়ের পর এক বছর সময়কাল তাবলীগ জামায়াত করতেন বলে স্ত্রী নাজমা জানান। এরপর মণিরামপুর শহরের দক্ষিণ মাথায় নকশা কম্পিউটার নামে একটি দোকান দেন। ২০১২ সালের দিকে সেই দোকানটি বিক্রি করে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। সেখানে দুই বছর থাকার পর গত বছরের ২৭ রমজান দেশে ফেরেন। বাড়ি এসে বড় মেয়ে কলেজ পড়ুয়া তুবাকে পাশের খানপুর গ্রামে বিয়ে দেন। তখন ছয় মাস বাড়িতে ছিলেন তিনি।

তারপর ঢাকায় থেকে ব্যবসার অংশীদার ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার লুচিয়া গ্রামের নুরম্নল ইসলামের ছেলে সৈয়দ গাউসুল আজমের (৪০) সাথে সৌদি আরবে নারীকর্মী পাঠাতেন। মাঝে মধ্যে আবার বাড়িতেও আসতেন।

তিনি জানান, চলতি বছরের ১৮ মে ঢাকার বসুন্ধরার বাসা নম্বর ৫২, রোড নম্বর ১৪, এফ ব্লকে বন্ধু খন্দকার মাহফুজ আলমের কাছে বেড়াতে যান নাজিম। মাহফুজ যশোরের ঝুমঝুমপুর এলাকার মৃত খন্দকার জায়েদ আলীর ছেলে। বন্ধুর বাসায় থাকা অবস্থায় ২৫ মে ব্যবসায়ীক অংশীদার গাউসুল আজমের ফোন পেয়ে সকাল ১০টার দিকে বাসা থেকে বের হন। গাউসুলের ঢাকার মিরপুরে অফিস করার কথা ছিল এবং সেখানে নাজিমকে কম্পিউটারের কাজ করার কথা বলে এবং সেই দোকান দেখাতে তাকে ফোন করে মিরপুরে ডেকে নেন গাউসুল। ওইদিন (২৫ মে) বেলা ১১টার দিকে মিরপুর এলাকা থেকে গাউসুলের সামনে থেকে সাদা পোশাকে ডিবি পরিচয়ে মাইক্রোবাস করে নাজিমকে তুলে নিয়ে যান চার ব্যক্তি। কিন্তু গাউসুল ঘটনার কিছুই নাজিমের পরিবারকে জানাননি। পরে ফোনে নাজিমকে না পেয়ে গাউসুলের কাছে ফোন দিয়ে ঘটনা জানতে পারেন নাজিমের পরিবার।

খবর পেয়ে নাজিমের স্ত্রী নাজমা ঢাকায় গিয়ে স্বামীকে সম্ভাব্য সবখানে খোঁজ করেও কোনো সন্ধান মেলাতে পারেননি। ফলে ২৮ মে ঢাকার পলস্নবী ও ভাটারা থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু মামলা না নিয়ে ভাটারা থানা পুলিশ একটি নিখোঁজ ডায়েরি (১৭৩০) গ্রহণ করে।

স্বামী হারানোর ঘটনায় ১ জুন বুধবার প্রেসক্লাব যশোরে ও ১৬ জুলাই শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন নাজিমের স্ত্রী নাজমা। এক ইসাথে ঢাকা ডিবি কার্যালয়ে স্বামীর ছবিসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে আসেন তিনি।

এদিকে, জঙ্গি ইস্যুতে সরকারের তৎপরতার অংশ হিসেবে ঈদুল ফিতরের চার দিন পরে মণিরামপুর থানা পুলিশ নাজিমের বাড়িতে যায়। পুলিশের ফোন পেয়ে তিনি তিন দফা থানায় হাজির হয়ে পুলিশকে সম্ভাব্য সব তথ্য দিয়েছেন বলে জানান নাজমা।

নাজমা আরও জানান, খবরে ছবি দেখে চট্টগ্রামে স্বামীর সাথে সাক্ষাতের জন্যে পরিবারের পক্ষ থেকে সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।

মণিরামপুর পৌরসভার চার নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুর রহমান ছবি দেখে নিশ্চিত করেন উনিই নিখোঁজ নাজিম উদ্দিন।

মনিরামপুর থানার ওসি বিপস্নব কুমার নাথের কাছে চট্টগ্রামে আটক হুজি সদস্যদের মধ্যে মণিরামপুরের নাজিম আছে কি না জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান।

যশোরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছি চট্টগ্রামে আটক নাজিমই যশোরের মণিরামপুরের নাজিমউদ্দিন।’

প্রসঙ্গত, যশোরের ‘পাঁচ ব্যক্তি জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত’ বলে কিছুদিন আগে পুলিশ তথ্য প্রকাশ করে। এছাড়া যশোর পুলিশ প্রশাসনের ছাপানো পোস্টারে জঙ্গি হিসেবে নাজিমের নাম ও ছবি ছাপা হয়েছে পাঁচ নম্বরে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here