বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও পাখির অভয়াশ্রম বাইক্কা বিলে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও পাখি বিলুপ্ত হতে চলেছে। এখনই সময়োপযোগী পদপে গ্রহণ না করলে আগামীতে পরিবেশের ভারসাম্য রাসহ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে প্রাণীকুল-এ রকম ধারণা করছেন প্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। বন উজাড়, পশু-পাখির খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত উদ্ভিদ ধ্বংস, নির্বিচারে বক্ষৃনিধন, অবাধে পাহাড় কাটা ও বনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়ায় বনের পশু-পাখির চরম খাদ্যসঙ্কট দেখা দিয়েছে। এর কুফল হিসেবে খাদ্যের সন্ধানে বন থেকে মেছোবাঘ, মায়াহরিণ, বনমোরগ, বানর, ভাল্লুক, অজগর, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ লোকালয়ে বেরিয়ে আসছে। মানুষের হাতে ধরা পড়ছে আর রাস্তা পারাপারের সময় গাড়ির চাপায় পিষ্ট হয়েও মারা যাচ্ছে অনেক প্রাণী।
এদিকে দেশের অন্যতম রেইন ফরেস্ট হিসেবে পরিচিত লাউয়াছড়া বনাঞ্চল একসময় উদ্ভিদ ও পশুপাখির অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু গ্যাস কোম্পানি শেভরনের ভূতাত্ত্বিক জরিপ ও গাছচোরদের অব্যাহত মূল্যবান গাছ চুরির কারণে লাউয়াছড়া বনাঞ্চল বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। বন থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আসা পশুপাখিগুলো বিপন্ন হয়ে পড়েছে। আর ভূতাত্ত্বিক বিস্ফোরণের ফলে মাইক্রো-ব্যাকটেরিয়া ও অণুজীব ধ্বংস হয়েছে আর বাকিরা হুমকির মুখে। পশুপাখির ফুড-চেইন মারাত্মক ক্ষতিগস্থ হয়েছে।
বন্যপ্রাণী সংরণবিদ সীতেশ রঞ্জন দেব জানান, চরম খাদ্যসঙ্কট দেখা দেয়ায় লাউয়াছড়া বন ছেড়ে সমপ্রতি মেছোবাঘ, হরিণ ও বিভিন্ন প্রজাতির সাপ বেরিয়ে এসে লোকালয়ে ধরা পড়ছে। তিনি জানান, পরিস্থিতি উত্তরণে বনজুড়ে বন্যপ্রাণী সংরণে যথাযথ আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের সদিচছাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে দেশের অন্যতম বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য লাউয়াছড়া, কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, বাইক্কা বিল মত্স্য ও পাখির অভয়ারণ্যকে রা করতে পারলে বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী ও পাখির প্রজনন বৃদ্ধির মাধ্যমে বিপন্নতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
বনবিভাগ, বন্যপ্রাণী সংরণবিদ সীতেশ রঞ্জন দেব ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে দুই শতাধিক বন্যপ্রাণী ধরা পড়েছে। এর মধ্যে মেছোবাঘ, লজ্জাবতী বানর, অজগর, মায়াহরিণ, খাটাশ, গন্ধগোকুল উল্লেখযোগ্য। এগুলো লোকালয় থেকে উদ্ধার করে সেবা দিয়ে পরে লাউয়াছড়া বনে ছাড়া হয়েছে। জানা গেছে, মাগুরছড়া গ্যাস বিস্ফোরণের কারণে লাউয়াছড়া সংরতি বনাঞ্চলের বিভিন্ন ছড়ার পানি শুকিয়ে যায়। টিলার মাটি ধসে ছড়াগুলো ভরাট হয়ে যায়। ফলে ছড়ায় বসবাসকারী কাঁকড়া, চিংড়ি, গিরগিটি, গুঁইসাপ, কুঁচো. কেঁচো, শামুক, টাকিমাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ব্যাপক হারে মারা যায়। এসব জলজ প্রাণী মেছোবাঘসহ অন্যান্য প্রাণীর খাদ্য। অন্যদিকে বনের ভেতর ডুমুর, বেলম, পিঁপড়া, বনতেঁতুল প্রভৃতি উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় বনের খাদ্যসঙ্কট প্রবল হয়ে উঠেছে। বনবিভাগ ও আইপ্যাক সূত্রে জানা গেছে, এক হাজার ২৫০ হেক্টর জায়গার ওপর ১৯৯৬ সালে স্থাপিত হয় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। এর মধ্যে আইপ্যাক প্রকল্পের অধীন লাউয়াছড়ায় ৩ হাজার একর রয়েছে। এতে রয়েছে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২০প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২৪৬ প্রজাতির পাখি। আর এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে স্তন্যপায়ী প্রজাতির মধ্যে গণ্ডারের ৩টি,বনগরুর ২টি,নেকড়ে,হরিণের ২টি,বনমহিষ, নীলগাই,পাখি প্রজাতির ২টি এবং এক প্রজাতির সরীসৃপ। বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে ৪৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী,৪৭ প্রজাতির পাখি, ৮প্রজাতির উভচর ও ৬৩ প্রজাতির সরীসৃপ। তথ্যমতে, দেশে প্রায় ৯০৩ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যে ৩০-৩৫টি উভচর, ১২৬টি সরীসৃপ, ৬৫০টি পাখি এবং ১১৩টি স্তন্যপায়ী প্রজাতি রয়েছে। স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে ১০টি প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটেছে। এছাড়া ৪৩টি প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। এদিকে পরিবেশবিদ ও গবেষকরা বলেছেন, এখানে ৪০০ প্রজাতির পশুপাখি ছিল। ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মাগুরছড়ায় বিস্ফোরণের ঘটনায় লাউয়াছড়া, মাগুরছড়া ও কালাছড়াসহ আশপাশের বনাঞ্চলের প্রাণীকুল মারাত্মক ক্ষতিগস্থ হয়।
২০০৯ সালে লাউয়াছড়া বনে আসা মার্কিন বন্যপ্রাণী গবেষক ড. এলিয়েট হাইমফ জানান, পৃথিবীর ৭টি বনে হাতেগোনা কিছু উল্লুক আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের লাউয়াছড়া বনে ১৪টি পরিবারে বিভক্ত হয়ে ৫৭টি উল্লুক দেখা গেছে। দিন দিন বন উজাড় হয়ে যাওয়ায় এবং মানুষের তাড়া খেয়ে উল্লুকের সংখ্যা কমে যাচেছ, যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পরিবেশ বিপন্ন হওয়ায় দেশের ১৫০ প্রজাতির পাখি ও বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির পথে রয়েছে। এদের মধ্যে স্তন্যপায়ী, পাখি, উভচর ও সরীসৃপ প্রজাতির এসব বন্যপ্রাণীর বেশিরভাগ এখন অতিবিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায়। এছাড়া প্রায় আড়াইশ’ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর সঠিক অবস্থান সম্পর্কেও রয়েছে যথার্থ তথ্য-প্রমাণের অভাব। ওয়াইল্ড লাইফ ট্য্রাস্টের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। আশঙ্কা করা হচেছ, পরিবেশগত অভয়াশ্রম ও সংরক্ষিত এলাকা নিরাপদ রাখা এবং পরিমার্জিত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণীত না হলে উল্লেখযোগ্য বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
এদিকে গত ২৩ ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার ভোর রাতে কমলগঞ্জে দু’টি স্থানে র্যাবের পৃথক অভিযানে ৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার, জবাইকৃত হরিণের মাংস ও বিপুল পরিমাণ চোরাই কাঠসহ ৪ ব্যক্তিকে আটক করা হয়। গত ২৩ ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার ভোর রাত ৩টায় কমলগঞ্জ পৌরসভার কুমড়াকাপন গ্রাম থেকে ৫টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৪ রাউন্ড গুলি উদ্ধার, হরিণের মাংস ভাগাভাগি করে নেওয়ার সময় ৩জনকে আটক ও রাত সাড়ে ৩ টায় বালিগাঁও গ্রামের এক বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণে চোরাই কাঠসহ এক ব্যক্তিকে আটক করে র্যাব-৯ শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের সদস্যরা। র্যাব-৯ এর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বুধবার দিবাগত রাতে কমলগঞ্জের কুমড়াকাপন গ্রামে ডাকাতির পস্তুতি নিচ্ছে একদল ডাকাত এই খবরে রাত ৩ টার দিকে র্যাব সদস্যরা ঘটনাস্থলে গেলে ডাকাত দল পালিয়ে যায়। এসময় সবুজ মাষ্টারের বাড়ির পিছন থেকে ডাকাত দলের ব্যবহৃত ১৩ ইঞ্চি লম্বা একটি সাইড গান, ১০ ইঞ্চি লম্বা একটি পিসত্মল, ৩৬ ইঞ্চি লম্বা একটি একনলা বন্দুক ও ৪০ ইঞ্চি লম্বা একটি এয়ার গান উদ্ধার করা হয়। তাছাড়া ২২ বোরের ৪ রাউন্ড গুলি ও একটি খেলনার পিসত্মল উদ্ধার করা হয়। গত বৃহস্পতিবার ভোর রাতে লাউয়াছড়া বনের বালিগাও এলাকায় অবৈধ ভাবে একটি হরিণ সিকারের পর জবাই করে মাংস ভাগাভাগির গোপন খবর পেয়ে মৌলভীবাজার র্যাব এর পরিচালক লে. কমান্ডার কাওছার মাহমুদের নেতৃত্বে একদল র্যাব সদস্য সেখানে অভিযান চালিয়ে জবাই করা হরিণের মাংস, মাংস কাটার সরঞ্জামাদি ও তিনজন হরিণ সিকারীকে আটক করে। আটককৃতরা হলেন- ইউনুছ মিযা (৪০),আজাদুর রহমান (৩৫) ও নরসাদুর রহমান (২৮)। উলেখ্য, লাউয়াছড়া বনের আশপাশের জনবসতির কয়েকটি শিকারী চক্র প্রতিনিয়ত বন বিভাগের চোখে আঙ্গুল দিয়ে শিকার করে আসছে হরিন, বণ্য শুকর, বন মুরম্নগসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণী। এ সব ঘটনায় বন বিভাগের দায়ের করা একাধিক মামলাও রয়েছে। পরে আটককৃত মাংস ও আসামীদের মৌলভীবাজার বন্য প্রাণী সংরন বিভাগে হস্তান্তর করা হয়। বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩ টায় কমলগঞ্জের বালিগাঁও গ্রামে বনদস্যূ সুরমান মিয়া (৩০)-র বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণে সাইজ করা চোরাই সেগুন ও আকাশ মনি কাঠ উদ্ধার করে র্যাব সদস্যরা। সাথে সাথে বনদস্যূ সুরমান আলীকেও আটক করা হয়।
ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/সজল দেব/মৌলভীবাজার