মো. শাহীন
মো. শাহীন :: ২০০৮ সালের ঘটনা,  মাগুরা সদরের পশু হাসপাতাল পাড়ার একটি দোতলা বাড়িতে আমাদের বসবাস। বাড়িটি আমার নানা বানিয়েছেন। বাড়িটিতে আমি নাবিলা,  আমার ছোট ভাই সাদমান, আমার বাবা-মা, নানা নানি ও আমার মামা সবাই মিলে একসাথে বসবাস ছিল। আমাদের বাড়ির পাশের বাড়িটির নিচতলায় বর্ধিত অংশের টিনশেডের দুটো রুম ভাড়া নিয়ে থাকতো একটি হিন্দু পরিবার। বেশ ভালোভাবেই দিন কাটছিলো পরিবারটির।  পরিবারের সদস্য সংখ্যা  চার জন। দুই ছেলে- বড় ছেলে শিমুল।  বয়স ১৪-১৫ বছর,  সপ্তম শ্রেণীতে পড়তো ছেলেটা। তাকে ঘিরেই সকল রহস্যের জট। ছোট ছেলে পলাশ, বয়স ১০ বছর, মা গৃহিণী এবং বাবা স্বর্নকার। ঐ বাড়িটিতে বসন্তের এক সন্ধ্যায় একটা  ভয়ংকর  ঘটনা ঘটে। বাড়িটির ছাদে বিশাল আগুনের এক ফোয়ারা দেখা যায়!
.
প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের অঞ্চলে ঘুড়ি উড়ানোর প্রথা প্রচলিত ।ছোট বড় সকল বয়সের মানুষের শখ ছিল ঘুড়ি উড়ানো। প্রত্যেক বাড়ির ছাদেই বিকেল বেলা ঘুড়ি উড়াতে দেখা যেত। আমি আর আমার ছোট ভাইয়েরও ঘুড়ি উড়ানোর শখ ছিল। প্রতিদিন আমরা ছাদে ঘুড়ি উড়াতাম। আমার বয়স তখন মাত্র সাত বছর।  তবে ছোট বেলা থেকেই অনেক সাহসী ও চঞ্চল ছিলাম। প্রতিদিনের মতো সেদিনও ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলাম।  পাশের বাড়ির ছাদে সেদিন ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল শিমুল নামের ছেলেটা, যাকে ঘিরেই ঘটনাটি ঘটে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে মাগরিবের আজান হয়। কিন্তু ঘুড়ি উড়ানো এমনই শখ ছিল যে, যতক্ষণ না ঘুড়ি নামানো যায় ততক্ষনে তো বাসার ভিতরে যাওয়ার উপায় নেই। আজানের সাথে সাথে আমরা ঘুড়ি নামাতে সক্ষম হই।
.
কিন্তু পাশের বাড়ির ছাদে শিমুল ছেলেটি কিছুতেই ঘুড়ি নামাতে পারছিল না। সে সন্ধ্যার পরও ঘুড়ি  ওড়াচ্ছিল। আমরা বাড়ির ভিতরে গিয়ে সবাই নামাজের জন্য দাঁড়াই।  নামাজের মাঝ খানে পাশের বাড়িতে চিৎকার চেচামেচি শুনতে পাই।  আমরা নামাজ শেষ করে বারান্দায় গিয়ে দেখি পাশের বাড়ির ছাদে বিশাল আকৃতির আগুনের কুন্ডলী। কিছুক্ষনের মধ্যেই আগুন হাওয়ায় মিশে যায়।  ধোয়া দেখা যায়  আর ছেলেটা পুড়ে গেলাম, পুড়ে গেলাম বলে চিৎকার করতে থাকে। ওর চিৎকার শুনে ওর ছোট ভাই পলাশ ওর মাকে ডেকে আনে। বাড়ির অন্যান্যরাও চলে আসে সবাই ধোঁয়া দেখতে পায় কিন্তু আগুন দেখতে পায় না। কিছুক্ষনের মধ্যে ধোঁয়াও হাওয়ায় মিশে যায়। সবাই ধরাধরি করে ছেলেটিকে ছাদের থেকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে যায়।  অনেক মানুষ এসে জড়ো হয় বাড়িটিতে। আমরাও যাই ও বাড়িতে কি ঘটছে তা জানার জন্য।
.
একটি বিষয় বলে রাখি, আমাদের মাগুরা শহরে হিন্দু মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ মিলে মিশে একত্রে বসবাস করে।  ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষ হলেও মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। সকলে সকলের বিপদে ঝাপিয়ে পড়ে । আমার নানা আবুল হোসেন মুন্সি, এলাকার খুবই পরিচিত একজন ধার্মিক ব্যক্তি। সবাই তাকে এক নামে চেনে। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে তার দক্ষতা ছিল। তিনি সব সময় এলাকার মানুষের বিপদে আপদে সাহায্য করতেন। যে কোন সমস্যায় মানুষ প্রথমে আমার নানার স্মরণাপন্ন হতো।
.
সেদিন ঐ বাড়িতে গিয়ে আমরা ছেলেটিকে অস্বাভাবিক অবস্থায় দেখতে পাই।আগত সবাই ছেলেটার অস্বাভাবিক অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যায়। সকলে পরামর্শ দেন আমার নানা আবুল হোসেন মুন্সিকে ডাকার জন্য।  সে মতো আমার নানাকে ডাকা হয়।আমার নানা শারীরিক দিক দিয়ে ভালোই শক্তি সবল ছিলেন।  কিন্তু সেদিন ঐ বাড়িতে গিয়ে ছেলেটাকে অস্বাভাবিক শক্তির অধিকারী দেখলেন আমার নানা।  কোন স্বাভাবিক মানুষের এমন শক্তি থাকার কথা নয়। আমার নানা ছেলেটাকে ধরে রাখতে পারছিলেন না। নানা, অন্য একটি ছেলেকে বললেন শিমুল ছেলেটিকে শক্ত করে ধরে রাখার জন্য।  এরপর নানা শিমুল  ছেলেটার হাতের কনিষ্ঠ আঙুল ধরে বেশ কিছু সূরা ও দোয়া পাঠ করেন। এর ফলে ছেলেটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। নানা ছেলেটার পরিবারকে কিছু পরামর্শ দিলেন ও সেগুলো মেনে চলতে বলেন।  “ জীবন বাঁচানো যখন বড় ব্যাপার তখন ধর্ম কোন বাধা নয়”।
.
এরপর কয়েকদিন ভালোই চলল। কিন্তু সপ্তাহখানেক পরে যা ঘটলো তার জন্য আমরা কেহ প্রস্তুত ছিলাম না।  এলাকার মোটামুটি সব বাড়ির মানুষজনই ঘুমিয়ে পরেছিল। হঠাৎ মধ্য রাতে রাস্তা থেকে বিকট শব্দে ডাইনির মতো চিৎকার চেচামেচি শুনতে পাই।  আমরা জানালার কাচ দিয়ে দেখতে পাই শিমুল ছেলেটি রাস্তায় রাস্তায় ডাইনির মতো চিৎকার করতেছে।  ছেলেটাকে ধরে নিয়ে আসার জন্য কিছু লোক যায়  কিন্তু এবার ছেলেটিকে ধরা যায় না।  সারারাত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বিকট শব্দে চিল্লাতে থাকে।  সকালবেলা ছেলেটাকে রাস্তায় অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়। এবারও ছেলেটাকে শান্ত করার দায়িত্ব পড়ে আমার নানার উপর।  নানা ছেলেটাকে দেখে পরামর্শ দিলেন আমাদের এলাকা থেকে একটু দূরে একজন বড় আলেম আছেন যিনি জ্বীন-ভূত তাড়ানোর কাজও করে থাকেন।  ছেলেটার পরিবারের লোকজন ঐ প্রসিদ্ধ আলেমের কাছে যান ছেলেটিকে নিয়ে। আলেম সাহেব ছেলেটিকে দেখে বলেন ওর উপর বদ জ্বীনের আছর আছে।  ওকে বদ জ্বীনের আছর থেকে মুক্ত করতে হবে।  সাথে সাথে আপনাদের বাড়িতে যাতে বদ জ্বীন আবার হানা দিতে না পারে তাই আপনারদের বাড়ি ও ছেলেটির শরীর বন্ধ দিতে হবে।  আর এ কাজটি ঐ স্থানে গিয়েই করতে হবে যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে।
.
যেই কথা সেই কাজ। প্রসিদ্ধ আলেম সাহেব ঐ ছেলেটির বাড়িতে আসলেন।  জ্বলন্ত কয়লার মধ্যে শুকনো মরিচ ঢুকিয়ে ছেলেটিকে শুকতে দিলেন। এবার জ্বীন এসে হাজির হলো। জ্বীন কথা বলতে শুরু করল। এটা ছেলেটির কন্ঠ নয় জ্বীনের কন্ঠ । জ্বীনের নাম নাকি ইদ্রিস।  সে বাস করত পশু হাসপাতাল মাঠের পাশে কড়াই গাছ, মাতৃসনদ হাসপাতালের  সামনে তুলা গাছ ও এর একটু দূরে মোমেনী ময়দানে। যেদিন শিমুলের সাথে প্রথম ঘটনাটি ঘটে , সেদিন নাকি সন্ধ্যায় জ্বীনটা উড়ে যাচ্ছিল।  হঠাৎ সে শিমুল ছেলেটিকে ছাদের উপর ঘুড়ি উড়াতে দেখে এবং মাজা করার জন্যই নাকি মজার ছলে শিমুলের উপর ভর করে। মাগরিবের আজান শুনে সহ্য করতে পারে না জ্বীন-ভূতরা। তাই তারা লোকালয়ে চলে আসে পালানোর জন্য। সেদিনও নাকি জ্বীন সন্ধ্যার আজান শুনে সহ্য করতে না পেরে নিজের বাসস্থানে পালাতে চেষ্টা করে পথিমধ্যে ছেলেটাকে দেখে ওর উপর ভর করে। জ্বীন বলে ছেলেটা খারাপ তাই ও সন্ধ্যার সময় ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল। আর বদ জ্বীন নাকি খারাপ মানুষের উপরই ভর করে!
.
তাহলে এবার তো এর একটা বিহিত করা দরকার।  এবার সমাধানে আসা যাক। এবার হুজুর জ্বীনকে জিজ্ঞেস করলেন,  ছেলেটার উপর ভর যেহেতু করে বসেছে এখন ছেড়ে যাবে কিনা?  জ্বীনকে হুজুর সাহেব বিভিন্ন রকম ভয় দেখান অবশেষে জ্বীন ছেলেটাকে ছেড়ে যেতে রাজি হয়। এবার হুজুর বললেন, তুই যে ছেড়ে যাবি তার জন্য কোন একটা চিহ্ন রেখে যা, যা দেখে আমরা বুঝতে পারবো তুই চলে গেসিছ। যেই কথা, সেই কাজ।  এবার জ্বীন পাড়ার মাঠের খেজুর গাছ থেকে বিকট শব্দে একটি খেজুর ডাল ভেঙে চলে যায়। এরপর ছেলেটা দুই দিন পরে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়। এর কিছু দিন পর ছেলেপুলে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় হিন্দু পরিবারটি।  এরপর একদিন শোনা গেল ওরা নাকি অন্য পাড়ায় বাস করে এবং ছেলেটি ভালো আছে।  পরবর্তীতে তাদের আর কোন খবর পাওয়া যায় নি। সত্যিকার অর্থে পরবর্তীতে  কি ঘটেছে ঐ পরিবারের ভাগ্যে তা কারও জানা নেই!
.
আমাদের চারপাশে কত বিচিত্র ঘটনা তো প্রতিনিয়ত ঘটে থাকে। তার কোন খোঁজ আমরা রাখি কি? প্রকৃতিতে বিচিত্র ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে কত গুলো মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়।  আবার কত গুলো মানুষের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়।  এভাবেই প্রকৃতির বিচিত্র খেলায় আবর্তিত হয় জীবন।
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here