ফারহানা মিলি :: যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টিভির মালিক নুরুল ইসলাম বাবুল মারা গেলেন আজ বিকালে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এভারকেয়ার হাসপাতালে গত ১৪ জুন থেকে ভর্তি ছিলেন তিনি। মাত্র কদিন আগেই মারা গেলেন ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের মালিক লতিফুর রহমান। উনার মৃত্যু অবশ্য বার্ধক্যজনিত বলে জানা গেছে।

কোভিড নাইনটিনের শিকার হয়ে এর আগে ড. আনিসুজ্জামান, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা মোহাম্মদ নাসিম এবং আরেকজন সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ নেতা সাহারা খাতুন মারা যান।

ড. আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর পর মৌলবাদী একটি গোষ্ঠীর উল্লাস দেখা গেছে। যেন আনিসুজ্জামান স্যার কখনও মারাই যেতেন না! কিংবা কোভিডের শিকার হওয়া একটা মহাপাপের মতো বিষয়। মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর পরও অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা কথা বলেছেন।

বলা হয় যে, মৃত্যুর চেয়ে বড় সত্য আর নেই। মৃত্যুর এই অনিবার্যতা জানার পরও আমরা নিজেদের অস্তিত্বের জন্য, কখনও কখনও অস্তিত্বকে আরও উজ্জ্বল করতে, আরও লক্ষ্যণীয় করতে কাজ করি; কখনও নানা অপকর্ম করি, অন্যের ক্ষতি করি, অন্যের ভালো করি, অন্যের পাশে দাঁড়াই। কিন্তু মৃত্যুর পর সব মানুষকে রেহাই দেওয়ার সংস্কৃতিও সভ্যতার অনুষঙ্গ।

এর কারণ, কীভাবে আমাদের মৃত্যু হবে সে কথা আমরা কেউ জানি না। কেবল এটা জানি, এই পৃথিবীর ৭৮০ কোটি মানুষের সবারই মৃত্যু হবে। আমাদের সব আপনজনদের হবে, আমাদেরও হবে। কোভিড নাইনটিনের এই মহামারী এই পৃথিবীর জীবিত মানুষদের জন্য এক অভূতপূর্ব ঘটনা। একদম শতবর্ষী যারা, তাদের কেউ কেউ শৈশবে স্পেনিশ ফ্লুর মহামারীর মধ্যে পড়লেও সেটির স্মৃতি ওদের না থাকারই কথা।

সত্যি বলতে কী, এর আগে আমরা পৃথিবীবাসী কেবল ‘চক্ষু দিয়া দেখতেছিলাম জগত রঙিলা— মওলা তোমার নুরানি তীর হঠাৎ মারিলা– মওলা আন্ধা করিলা।’ সদ্যপ্রয়াত এন্ড্রু কিশোরের আরেকটি জনপ্রিয় গান এটি। ১৯৮২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘বড় ভালো লোক ছিল’ সিনেমার গান। করোভাইরাসের মহামারী যেন আমাদের সবার জীবনে এই চরম সত্যটি হাজির করেছে। আধ্যাত্মিক ওই গানের মূলমন্ত্র এই যে, বিধাতা হঠাৎ ‘এক নুরানি তীর ছুঁড়ে আমাদের দৃষ্টিহীন করে দিলেন’— মওলা আন্ধা করিলা।

আর এজন্যই এক মৃত্যু-আতঙ্ক আজ তাড়া করে ফিরছে পৃথিবীবাসীকে। আমরা কে-যে আক্রান্ত হব এই গভীর অসুখে আর কে-বা হারিয়ে যাব জানি না কেউ। মৃত্যু অনিবার্য বলে কোনো উপায়ে মৃত্যুই আমাদের জন্য শাস্তি নয়।

আসলে মৃত্যু-আতঙ্কের মধ্যে চারপাশের এত মৃত্যু মনকে ভারাক্রান্ত করছে। যমুনা গ্রুপের মালিকানাধীন দৈনিক যুগান্তরে আমি কাজ করেছি সাড়ে সাত বছর। ২০০৪ সালে ওখানে যোগ দেবার পর বাবুল সাহেবকে মাঝেমধ্যে অফিসে আসতে দেখতাম। দীর্ঘদেহী মানুষটি চুপচাপ হেঁটে যেতেন সম্পাদকের রুমের দিকে। এতবড় গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক হলেও তাঁর আশেপাশে এক দঙ্গল লোক দেখা যেত না। পত্রিকা অফিসে তাঁর আগমনের ক্ষেত্রে উনি একটা সৌজন্য বজায় রাখতেন বলে মনে হত।

সংবাদপত্র অফিসগুলোতে মালিকদের কর্তৃত্বের চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠার এবং নানা ধরনের গোষ্ঠীস্বার্থের বিষয়গুলো চলে আসার ঘটনাগুলো বেশিদিন আগের নয়। এক দশকের মধ্যেই এসব ঘটছে বা এসব পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি দেখছি আমরা। তাই বাবুল সাহেবের মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ মালিককেও সাধারণভাবে এবং নিতান্তই কালেভদ্রে যুগান্তরে আসতে দেখতাম আমরা। পত্রিকার নীতিনির্ধারণে তাঁর প্রভাবের কথাও শুনিনি। আসলে তখনও অফিসগুলোতে সাংবাদিকতাটা ছিল— যার ‘অনেক কিছুতেই’ এখন আঁচড় পড়েছে।

আমি বলছি দেড় দশক আগের কথা, যখন অনেকটাই স্বাধীনতার দরজা খোলা ছিল পত্রিকাগুলোতে। তখন তো মিডিয়া বলতে পত্রিকাই। টিভি চ্যানেল কয়েকটা গুটি গুটি পায়ে এগুচ্ছে মাত্র। অনলাইন বলতে গেলে নেই। তরুণরা ব্লগিং শুরু করছে। ফেসবুক মাত্রই যাত্রা শুরু করেছে। বাংলাদেশে হাতেগোনা মানুষজনের থাকত ফেবু একাউন্ট। ডিজিটাইজ হবার একমাত্র নমুনা ছিল কম্পিউটারে মাউস ধরে কি বোর্ড টিপে টিপে কম্পোজ করতে পারার সক্ষমতা– আর জিমেইলে একটা একাউন্ট থাকা এবং মেইল চালাচালি করতে পারা।

যাহোক, ধান ভানতে শিবের গীত নয়। মিলেনিয়ামের শুরুর দিকের ওই ছিমছাম বিষয়গুলো চোখের সামনে বদলে গেল। সেসব পরিবর্তনের হাওয়ায় হাওয়ায় অনেক কিছুই হল। আমাদের মিডিয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জনজীবনেও। তার আরও পরে, মিলেনিয়ামের সবচেয়ে সেরা সালটি (২০২০-টুয়েন্টি-টুয়েন্টি) দেখবার আনন্দে যখন আমরা ভাসছি তখনই এল এই মহামারী।

আসুন এই পৃথিবীর প্রতিটি মৃত্যুর জন্য কেবল শোকস্তব্ধ হই। কারণ মওলা কখন নুরানি তীর ছুঁড়ে মারবেন আমরা কেউ জানি না।

 

 

লেখক : সাংবাদিক।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here