হীরেন পন্ডিত :: ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আমার এক বন্ধুকে দেখতাম সাংবাদিক হিসেবে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করছে। আমারও ওকে দেখে মিডিয়ায় কাজ করার খুব আগ্রহ দেখা দেয়। কিন্তু পরিচিত কেউ না থাকার কারণে মিডিয়ায় কাজ করার সুযোগ হয়ে উঠেনি। কিন্তু, সে সময় দৈনিক পত্রিকা বলতে সংবাদ, ইত্তেফাক, বাংলার বাণী ও অবজারভার, অন্য পত্রিকা ছিলো সেগুলো এত নামকরা ও জনপ্রিয় ছিলোনা। আর সরকারী পত্রিকা বলতে দৈনিক বাংলা এবং বাংলাদেশ টাইমস ছিলো। কয়েকটা সাপ্তাহিক ছিলো বিচিত্রা ছিলো এর মধ্যে অন্যতম। গ্রাম থেকে এসেছি পত্রিকায় কি কাজ করব সে সম্পর্কে কোন পরিস্কার ধারণা ছিলোনা। যায় যায় দিন, দেশবন্ধু, বিচিন্তা এগুলো ছিলো নামকরা ও জনপ্রিয় সাপ্তাহিক। তবে এরশাদ সাহেবের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে লেখার কারণে অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়।

জগন্নাথ হলে থাকার কারণে পলাশি বাজারে যাওয়া হতো মাঝে মাঝে। ১৯৮৮ সালের কোনো একদিন পলাশি বাজারে পরিচয় কবি সমরেশ দেবনাথের সাথে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চাকরি করতেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ি এলাকায় থাকতেন। একদিন তাঁকে আমার আগ্রহের কথা বললাম যে আমি কোন পত্রিকায় খন্ডকালীন কাজ করতে আগ্রহী। তিনি আমাকে নিয়ে অনেকের কাছে গিয়েছিলেন, প্রথমে পরিচয় করে দিয়েছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণের সাথে তখন তিনি পলাশিতে থাকতেন। এরপর একদিন কবি অসীম সাহা ও কবি মহাদেব সাহার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। অসীমদা একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক আর মহাদেবদা দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক ছিলেন।

একদিন কবি শামসুর রাহমানের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তখন সোবহানবাগ এলাকায় থাকতেন পরে শ্যামলীতেও উনার বাসায় গিয়েছি। শিল্প ও সংস্কৃতির সাথে জড়িত এমন অনেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। পরে একদিন সোহরাব হাসানের (প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক) সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এর কয়েক মাস পরে একদিন পল্টনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে ড. নিতাই কান্তি দাশের সাথে পরিচয় করালেন।

এরশাদ সাহেব দেশবন্ধু পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার পর মোজাম্মেল বাবুর সম্পাদনায় পূর্বাভাস নামে একটি রাজনৈতিক সাপ্তাহিক বের হতো (বর্তমানে ৭১ টিভির প্রধান সম্পাদক)। নিতাইদা পূর্বাভাস পত্রিকায় সম্পাদনা সহকারি হিসেবে একটি কাজের ব্যবস্থা করলেন। এই পত্রিকার সাথে জড়িত ছিলেন আনিসুল হক (বর্তমানে বিখ্যাত লেখক ও সহযোগী সম্পাদক প্রথম আলো) আমিনুর রশীদ (দেশ টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক), কুদ্দুস আফ্রাদ (বর্তমানে ডিইউজে প্রেসিডেন্ট ও কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিনিধি) বাঁধন সরকার (বর্তমানে সমকালে কর্মরত)।

অনেকে এই পত্রিকায় লিখতেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন, ড. হুমায়ুন আজাদ, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ. শাহজাহান সরদার, নাজিম উদ্দিন মোস্তান, মোজাম্মেল হোসেন, তখন একতায় ছিলেন, প্রথম আলো এবং সম্পাদক সকালের খবর ছিলেন, মনজুরুল আহসান বুলবুল, বিএফইউজের সাবেক প্রেসিডেন্ট, বৈশাখী এবং একুশে টিভির সাবেক প্রধান সম্পাদক, তখন সংবাদে ছিলেন, তসলিমা নাসরিন (বিদেশে নির্বাসিত), অমিত হাবিব (বর্তমানে সম্পাদক, দেশ রূপান্তর) এবং আরো অনেকে।

তসলিমা নাসরিন তখন পুরান ঢাকার আরমানি টোলায় থাকতেন। পূর্বাভাস অফিসে আড্ডা দেয়ার কারণে বেশি রাত হলে দুই একদিন উনাকে রিকশায় উনার আরমানি টোলার বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসেছি। অমিত হাবিবদার আর নাসরিন আপার খুঁনসুটি এখনো মনে পড়ে। নাসরিন আপা অল্পকথা নামে একটি কলাম লিখতেন আর অমিত হাবিবদা সংস্কৃতির ওপর লিখতেন। অল্পকথা একটি নারীবাদি কলাম ছিলো।

আনিসুল হক (মিটুন ভাই) থাকতেন ঢাকা মেডিক্যালের ফজলে রাব্বি হলে। আমি প্রতিদিন তাঁর সাথে রিকশায় পল্টন থেকে শহীদ মিনারের কোনায় নেমে যেতাম। কাছেই আমার জগন্নাথ হল। তবে আমি একদিনও ভাড়া দেইনি উনিও কোনদিন কিছু বলেন নি। চক্ষুলজ্জার কারণে আমিও কোনো দিন কিছু বলিনি। একদিন অনেক রাতে ফেরার কারণে আমি রিকশা থেকে নেমে যাবার পর শহীদ মিনারের সামনে ছিনতাইকারীর হাতে সব খুইয়ে খুব মন খারাপ করলেন মিটুন ভাই। সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছিলেন রাতে চলাচলের স্বাধীনতা নষ্ট করে উনার মনে ভয় ধরিয়ে দেয়ার জন্য।

পূর্বাভাস ছিলো এরশাদ সাহেবের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার একটি রাজনৈতিক পত্রিকা। এইজন্য প্রায় প্রতিদিন আতঙ্কে থাকতাম কোনদিন পত্রিকাটা বন্ধ হয়ে যায়। অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র এবং পত্রিকায় কাজ বেশি না থাকলেও অনেক সময় দিতে হতো তাই একদিন কাজটি ছেড়ে দেই।

তখন এশিয়া দর্পণ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন এ্যান্ড্রু অলক দেওয়ারী। একদিন এক বিজ্ঞাপন দেখে উনার সাথে শুক্রবাদে দেখা করি। কিন্তুু পত্রিকাটির ডিক্লারেশন ছিলোনা। তাই তিনটি সংখ্যা বের করেছিলেন কিন্তু পরে ওয়ার্ল্ড ভিশন এ কাজের ব্যস্ততার কারণে আর বের করেননি। তিনি আমাকে একটি খন্ডকালীন শিক্ষকতার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন বস্তিবাসী শিশুদের পড়ানোর কাজ। তিনি ওয়ার্ল্ডভিশন ছেড়ে রেল বিভাগে সরকারী চাকরি নিয়ে রাজশাহী চলে যান পরে আবার পিএইচডি করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা নিয়েছিলেন।

১৯৯০ সাল। সারা দেশে তখন জেনারেল এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। কেননা কয়েকদিন আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় চিকিৎসক নেতা ডা. শামসুল আলম মিলনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ডিসেম্বর মাসের এক তারিখে ঢাকা সেনানিবাসে এক জরুরী বৈঠকে বসেন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা। বৈঠকে ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা একমত পোষণ করেন দেশের চলমান সংকট একটি রাজনৈতিক বিষয় বলে। তারা একমত হন এ সঙ্কট সমাধানের জন্য রাষ্ট্রপতিকে রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে এ ব্যাপারে। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর কিছু করণীয় নেই-এটাও তারা সিদ্ধান্ত নেন। বিরোধী দলগুলো এ নির্বাচনের প্রস্তাব আগেই বর্জন করেছিল। তারপরও এরশাদের নির্দেশ মতো ভাইস-প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমদ সন্ধ্যায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে গিয়েছিলেন ভাষণ রেকর্ড করার জন্য। সে ভাষণ তিনি রেকর্ডও করেছিলেন। তবে তা প্রকাশের আগেই এরশাদ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।

এ কারণে ওইদিন মধ্যরাতে মওদুদ আহমেদকে আবারো বাংলাদেশ টেলিভিশনে যেতে হয়েছিল প্রেসিডেন্ট এরশাদের পদত্যাগের ঘোষণা দেবার জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতৃত্বে তীব্রতর হয়েছিল ১৯৯০এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন যা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে, আর তার মাধ্যমেই এরশাদের নয় বছরের শাসনের অবসান ঘটেছিল।

পূর্বাভাস ছেড়ে দেয়ার পর কবি অসীম সাহার নীলক্ষেতের সেই ইত্যাদি হয়ে উঠে আমার অলিখিত ঠিকানা এবং নিয়মিত আড্ডা একটি অবধারিত বিষয় ছিলো। অসীমদা লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত থাকেন সবসময়। এর মধ্যে একটি ছিলো বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি (বিজিএস)। জার্মান নাগরিক ও বাংলাদেশের নাগরিকদের সেতুবন্ধনের একটি সংগঠন। প্রফেসর কবীর চৌধুরী ছিলেন সভাপতি, লেখক আহমদ ছফা ছিলেন সাধারণ সম্পাদক এবং কবি অসীম সাহা ছিলেন সাংস্কৃতিক সম্পাদক। এরপর বিজিএস-এর সাথে সম্পৃক্ত হবার কারণে অনেক কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিল্পীসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছি।

বিজিএস-এ কাজ করার সুবাদে পরে মিডিয়ার সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছিলো। যেমন অবজারভারের মাহফুজুল হক খান (প্রয়াত), বিএসএসএর বিশেষ সংবাদদাতা ও পরে ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, হারুন হাবীব, চিত্রালীর হীরেন দে, দৈনিক রূপালীর কানাই চক্রবর্তী (বর্তমানে বিএসএসএর ডেপুটি চীফ রিপোর্টার), সোহরাব ভাই তখন ভোরের কাগজে ছিলেন (বর্তমানে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক), মাশুক ভাই ছিলেন দৈনিক খবরে, সংবাদের সালাম জুবায়ের, বাংলার বাণীর মারুফ রায়হান, বাংলাবাজার পত্রিকা, মানবজমিন ও পরে যুগান্তরের অহমেদ ফারুক হাসান ও পরে জনকণ্ঠও গুরুত্ব দিয়ে ছাপাতো খবরগুলো।

ওয়াহিদুল হক সাহেবের কাছে গিয়েছি ডেইলি স্টার খবর ছাপানোর জন্য। অনেকে বিজিএস-এর খবরগুলো গুরুত্ব দিয়ে ছাপতেন। তবে এইসব কাজে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করতেন অসীমদা ও ছফা ভাই। উনারা ফোন করে বলতেন সংবাদগুলো গুরুত্ব দিয়ে ছাপার জন্য।

 

 

 

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here