মাহবুব খান সবুজ :: ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসের ৮ তারিখ। সুইডেনের ল্যান্ডভেত্তের বিমানবন্দরে যখন তার্কিশ এয়ারলাইন্সের বিমান ভূমিস্পর্শ করে তখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে। অপেক্ষাকৃত নিরব, নিস্তব্ধ কর্মচাঞ্চল্যবিমুখ বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে যখন বাইরে এসেছি তখন পারদ সূচকমাত্রা ৭° বা ৮° ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিমানবন্দর থেকে বের হবার আগেই গরম কাপড় পড়ে নিলাম। সুইডিশ সরকারের সহযোগিতায় চলতি বছরের ৯-২৭ নভেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত “ইন্টারন্যাশনাল ট্রেনিং প্রগ্রাম ইন স্ট্রাটেজিক ইনভায়রনমেন্টাল এ্যাসেসমেন্ট” কোর্সে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/সংস্থার সাত সদস্যের প্রতিনিধিদলের মধ্যে আমি প্রথমবার সুইডেন যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যাই।
স্যুট-টাই পরিহিত ও আপাদমস্তক অতিভদ্রলোক মটরভ্যান ড্রাইভার সাহেব আগে থেকেই বিমানবন্দরে এসে আমাদের জন্য দন্ডায়মান। ড্রাইভার সাহেবের সহযোগিতায় একে একে সব লাগেজ গাড়িতে নিজেরাই তুললাম। সুইডেনের মাটিতে যাত্রা শুরু। গন্তব্যস্থল: একলান্দাগতন, গোথেনবার্গে অবস্থিত কোয়ালিটি হোটেল প্যানোরমা। সন্ধ্যা নেমে যাওয়ায় দুপাশের বিস্তীর্ণ প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো ক্রমশঃ দৃষ্টিসীমার অন্তরালে চলে যাচ্ছিল। সর্পিলাকার রাস্তা ধরে প্রায় ৪০ মিনিট যাত্রার পর হোটেলে আগমন। হোটেলের সামনে নামতেই মনে হলো শীতের তীব্রতা আরো খানিকটা বেড়েছে।
নভেম্বর ০৯: কনকনে শীতের অন্ধকারে ঘুম থেকে ওঠে রিফ্রেশ হয়েই সকাল সাতটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট রুম। রাজ্যের খাবারের মেন্যু। সেদ্ধ ডিম ছাড়া বাঙালি খাবারের বড়ই অভাব। উদোর খালি থাকায় গোগ্রাসে কিছু ব্রেড ও ফ্রুটস দিয়ে নাস্তা সেরে ফেললাম। ব্রেকফাস্ট রুমটির পূর্বদিকে লম্বভাবে দেয়ালঘেষা স্বচ্ছ কাঁচের ভিতর দিয়ে বাইরের রাস্তা, যানবাহন, পথচারিদের আনাগোনা আলোআঁধারী মতো চোখে পড়ে। সুইডেনে এসময় সূর্য ওঠে সাড়ে আটটার পড়ে। তাই আলো আঁধারীর মধ্যেই কর্মমুখি ও শিক্ষার্থীদের বেরিয়ে পড়তে হয় যার যার গন্তব্যে। নাস্তা শেষে হোটেল থেকে উঁচু-নিচু পথ ধরে প্রায় দেড় কিলোমিটার হাটার পর আশিবার্গসগতনে ইকোসেনত্রামে এসে পৌঁছতে প্রায় আধা ঘন্টা পেরিয়েছে। সকাল সাড়ে আটটা থেকে এই ইকোসেনত্রামের দ্বিতীয়তলে আপাতত শুরু প্রতিদিনের ক্লাশ। ঠিক ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় সময় মেপে চলা প্রাত্যহিক জীবন এখানে। ক্লাশে যখন উপস্থিত হই, সূর্য তখন সবেমাত্র উঠি উঠি করছে। প্রথমেই পরিচিতি পর্ব। আসিয়ান দেশভুক্ত কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, মায়ানমার এবং আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার প্রিয় দেশ বাংলাদেশ। পাঁচটি দেশের সর্বমোট ৩০ সদস্যের প্রশিক্ষণার্থী।
ফিকা: প্রাত্যহিক ক্লাশ রুটিন অনুযায়ী সকাল ১০:০০ টা এবং বিকাল ০৩:০০ প্রতিক্ষেত্রে ১৫ মিনিটের জন্য রিফ্রেশমেন্ট ব্রেক। সুইডিশ ভাষায় একে বলে ‘FIKA’ বা ‘কফি ব্রেক’। আমাদের দেশের চা-পান বিরতির মতো। তবে এ সময় চা, কফি, দুধ, দুধ-চকোলেটের মিশ্রিত পানীয় ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ফল পরিবেশন করা হয়। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্লাশে ইতঃপূর্বের জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় উত্তেজিত মস্তিষ্ককে পুনঃ সতেজতায় ফিরে আনা। সুইডেনে সর্বত্র এ বিষয়টি খুব সিরিয়াসলি উপভোগ করতে দেখেছি। চা-কফি পানীয় পানের সাথে সাথে ছোট খাটো আড্ডাও জমে ওঠে এ সময়। তবে হ্যাঁ, সময় পনেরা মিনিট কিন্তু ঠিক পনের মিনিট তার বেশি নয়! দেশের সাথে ঘুমের Time adjustment হতে কিছুটা বিলম্ব হওয়ায় প্রথম প্রথম আমার ক্লাশে বেশ ঘুম চলে আসতো। তাই কখন ‘ফিকা’ এর সময় হবে এ নিয়ে অধীর থাকতাম। অফিস, আদালত সর্বত্র ‘ফিকা’ সুইডিশ কালচারের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে।
নভেম্বর ১৩: অফিসিয়াল পাসপোর্ট ও সেনজেন ভিসা থাকায় প্রথম উইকএন্ড ডেনমার্ক ও নরওয়ে ঘুরবো বলে পূর্বদিনেই সিদ্ধান্ত নিলাম। সাত বাংলাদেশি মিলে যাত্রা শুরু পরবর্তী স্ক্যান্ডেনেভিয়ান কান্ট্রি ডেনমার্ক। গোথেনবার্গের নিলস এরিকসন টার্মিনাল থেকে মধ্যরাতের বাসে করে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনের উদ্দেশে যাত্রা। সোজা দক্ষিণে মালমো হয়ে প্রায় ৩২০ কি.মি দূরত্বে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন পৌঁছতে প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা। সময় সকাল প্রায় সাড়ে সাতটা। বাস থেকে নামতেই তীব্র শীতের কামড়। তাপমাত্রা তখন ৩° বা ৪° ডিগ্রি সেলসিয়াস। কয়েক লেয়ার গরম কাপড়েও যেনো কিছুই হয়না। সাতসকালে অচেনা গন্তব্যে পৌঁছে নাস্তা খাওয়া ও শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচতে অবশেষে সেন্ট্রাল স্টেশনের ভেতরে আশ্রয় নেয়া।
স্টেশনের ভেতরে যখন পৌঁছেছি তখন আটটা বাজতে আরো কিছু সময় বাকি। আটটা বাজলে মানিএক্সচেঞ্জ খুলবে। তাই মুদ্রা পরিবর্তন না করা পর্যন্ত কোনো খাবারও কেনা যাচ্ছেনা। পুরো স্টেশনটিতে ফ্রি ওয়াই-ফাই জোন থাকায় নেট ব্রাউজার, ভাইবারে ফোন করার বেশ ভালো এক সুযোগ মিলল সবার জন্য। আমাদের একজন সদস্যের ডেনিশ-বাংলাদেশি পরিচিত থাকায় তাঁকে ভাইবারে কল করা হলো। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে লিঙ্কন ভাই, সাব্বির ভাইসহ আরো দু’জন বাংলাদেশি এসে হাজির। তাঁদের কেউ কেউ ১২-২০ বছর যাবত এ দেশে আছেন। সবাই এখন ডেনিশ নাগরিক। তাঁদের সাথে নিয়ে আসা নিজেদের গাড়িতে করে কোপেনহেগেন শহর ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। গোথেনবার্গে দিনের আলো তেমন একটা না পাওয়া গেলেও কোপেনহেগেনের স্বচ্ছ রৌদ্রঝলমল নির্মল আকাশ মনোমুগ্ধকর। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি শহরটিতে এসে সত্যিই ভালো না লেগে উপায় নেই।
বিগত পাঁচদিন ভাত-মাছের সাথে কোনো দেখা নেই। তাই বাংলাদেশি-ডেনিশ লিঙ্কন ভাইয়ের আতিথেয়তায় তাঁর নিজ বাড়িতেই বাঙালি কায়দায় দুপুরের খাবার অমৃতের স্বাদ পাই।
আমাদের পূর্বনির্ধারিত কোপেনহেগেন টু অসলো যাত্রার আমুল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত। নাহ্ এবার আর বাসে যাওয়া হবে না। বাস জার্নি টু অসলো বাতিল করা হলো। সবার সিদ্ধান্ত এবার সমুদ্র পথে যেতে হবে অসলো। কোপেনহেগেন থেকে অসলো যাবো নর্থ সি দিয়ে। ডেনমার্কস্থ বাংলাদেশি ভাইদের সহায়তায় শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল সাতটি ডিএফডিএস সি-ওয়েজ-এর টিকিট। ছাড়বে বিকাল (সন্ধ্যা) ০৪:৩০ টায়। এখনো বেশ কিছু সময় হাতে রয়েছে। টার্মিনালের কাছেই লাংগেলিনিয়ায় (Langelinie) অবস্থিত ‘দি লিটল মারমেড’ দেখতে গেলাম।
মৎস্যকন্যার কাছে যখন পৌঁছেছি তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলানতলে চলে গেছে। সাগর সংযুক্ত লেকের জলাশয়ে নিমজ্জিত পাথরের উপর আড়চোখে ঘুরে তাকিয়ে আছে মৎস্যকন্যা। ব্রোঞ্জের তৈরী এবং ১.২৫ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট এই ভাস্কর্যটি ১৯১৩ সালে ভাস্কর শিল্পী এডভার্ড এরিকসেন তাঁর সৃষ্টিতে দর্শনার্থীদের কাছে এক আবেগময় ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন । নানান দেশের বেশ কিছু পর্যটক মৎস্যকন্যা দর্শনে ভালোই ভিড় জমিয়েছে।
কোপেনহেগেন টু অসলো যাত্রা: ১৪ নভেম্বর ২০১৫ শনিবার সন্ধ্যা (!) সাড়ে চারটা। ডিএফডিএস ক্রাউন সি-ওয়েজ-এর কেবিনে যখন উঠলাম সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে গা ঢাকা দিয়েছে। নর্থ সি উপকূল দিয়ে ১১তলাবিশিষ্ট বিশাল জাহাজ মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলল। ২১৩৬ যাত্রী ধারণক্ষমতার বিশাল এই জাহাজের রয়েছে সি-শপ, ক্যাফে, কনফারেন্স রুম, ডিসকো বার, নাইট ক্লাব ইত্যাদি। জাহাজ ভ্রমণ আমার জীবনে এই প্রথম। তাই উৎসুক মনে বিশাল জলরাশির পরিবেশ দর্শনের জন্য আলো-ছায়ার মধ্যেই জাহাজের ছাদে চলে গেলাম।
চারিপাশে অন্ধকার, নিঝুম, নিরবতা। শুধুমাত্র জাহাজের রেস্টুরেন্ট ও বার থেকে মৃদুলয়ের কোনো অজানা সঙ্গিত কানে বাজছে। ছাদের উপর বাতাস থাকায় প্রচন্ড শীত লাগছিল। তাই বেশিক্ষণ সেখানে থাকার আর আগ্রহ পেলাম না। জাহাজের সি-শপে ঘোরাঘুরি করলাম। পৃথিবীর সব দামী ব্রান্ডের টেক্সটাইল, কসমেটিকস, পারফিউম, জুয়েলারি, টয়জ, ওয়াইন, ক্যান্ডি-চকোলেট থেকে শুরু করে রাজ্যের পশড়া নিয়ে সাজানো বিশাল শপ। পকেটের অবশিষ্ট ডেনিশ ক্রোনার দিয়ে কিছু স্যুভেনির এবং ক্যান্ডি-চকোলেট কিনে নিয়ে তা শেষ করলাম। এগারটার মধ্যে কেবিনে ফিরে এলাম। এবার ঘুমানোর পালা। মধ্যরাতের পরে হঠাৎ জাহাজের দুলুনিতে ঘুম ভেঙে গেল। জাহাজের সাথে তীব্র পানি ভাঙনের শব্দ কানে আসছিল। মনে মনে ভাবছিলাম ১৯১২ সালের টাইটানিক ঘটনা ঘটবে না তো? জানা গেল নর্থ সি’র স্বাভাবিক আচরণের কারণে এমনটি হচ্ছে। কারণ তখন আমাদের জাহাজ গভীর সাগরে এসে পড়েছে। ঢেউ এর সাথে সাথে জাহাজের দুলুনি হওয়াটাইতো স্বাভাবিক।
অসলো ভ্রমণ (নভেম্বর ১৫): আমার বরাবরই ঘুম থেকে খুব ভোরে ওঠা অভ্যাস। ভোর ছ’টার আগে থেকেই জেগে আছি। দীর্ঘ ভ্রমণের সময় যেনো আর শেষ হয় না। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে চারটা থেকে পানিতে ভেসে চলেছি। প্রায় ১৭ ঘন্টা পর সকাল দশটায় ঘোষণা এলো সাড়ে দশটার মধ্যে জাহাজ নরওয়ের রাজধানী অসলো ভিড়ছে। দ্রুত চলে এলাম আবারো জাহাজের ছাদে। অনতি দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি নতুন আরেকটি স্বপ্নের দেশ নরওয়ে। নীল জলরাশির ওপারে কী সুন্দর সব দালানকোঠা। এই সেই নিশীথ সূর্যের দেশ। তবে এখন ভালোই রৌদ্রময়! মোবাইল এ্যাপসে স্থানীয় তাপমাত্রা দেখাচ্ছে মাইনাস ২° ডিগ্রি সেলসিয়াস।
অসলোর ভূমিতে পা দিতেই দেখা গেলো নানা জায়গায় বরফ জমে আছে। হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল পায়ের কেডস কেমন যেনো পিছলিয়ে যাচ্ছে। সদলবলে সবাই শীতকে জয় করার জন্য জোর কদমসে হাটতে শুরু করলাম। অজানা গন্তব্য। চারিপাশের ভূ-দৃশ্যাবলী আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুধুই কাছে টানছিল। আমিও আমার নিকনের শাটার ক্লিক-ক্লিক-ক্লিক! ছবি তুলতে তুলতেই এগিয়ে যাচ্ছি। কাছেই ছিল সেন্ট্রাল স্টেশন। প্রচন্ড খিদেয় কিং বার্গার শপে। কিন্তু এবারো আগের মতোই মুদ্রার পরিবর্তন। মানি এক্সচেঞ্জে গিয়ে সুইডিশ ক্রোনার দিয়ে নরওয়েজিয়ান ক্রোনার কেনা হলো।
স্টেশনের কোথা থেকে গোথেনবার্গের উদ্দেশে বাস ছাড়বে আগেই তা জেনে নিলাম। কেননা রাত সাড়ে সাতটার বাসে ফিরতে হবে সুইডেনে। এবার বেরিয়ে পড়া যাক। স্টেশন থেকে বের হয়ে সোজা পশ্চিমদিকে কার্লস জোহান্স গেট ধরে সম্মুখপানে যাত্রা। পরিচ্ছন্ন রাস্তা, অনুচ্চ বড় বড় দালানাকোঠা, পথচারীদের আনাগোনা, দুপাশের সুসজ্জিত নানা ধরনের শপ ভালোই লাগছিল হেটে যেতে যেতে। রাস্তার একপাশে লম্বালম্বিভাবে লাগানো গাছগুলো কেমন যেনো ম্রিয়মান লাগছিল। শীতের কারণে পাতা ঝরে পড়ায় প্রকৃতির স্বাভাবিক সৌন্দর্যে কিছুটা ছেদ পড়েছে। অসলোর ন্যাশনাল থিয়েটারের সামনের বাগানে বেশকিছু গোলাপের ঝোপ দেখা গেল। থোকায় থোকায় ফুটে থাকা হলুদ লালের মিশ্রণে অপরূপ গোলাপের কিছু ম্যাক্রো ফটোগ্রাফি শট নিলাম। সামনে কিছুটা এগিয়ে যেতেই একটু উঁচুতে দেখা গেল ক্রিম কালারের ‘দি রয়েল প্যালেস’প্রাসাদ। এটি ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে ফরাসি বংশোদ্ভুত নরওয়েজিয় King Charles-III এর আবাসিক ভবন হিসেবে নির্মিত হয়। বিস্তারিত জানার প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সময় স্বল্পতার কারণে ঐতিহাসিক রাজভবনটি আর ঘুরে দেখার সুযোগ হলো না। এক ধরনের আফসোস নিয়েই ফিরে যেতে গেল।
এবার হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত অবস্থায় চলে এলাম ফ্রিৎজোফ ননসেনস প্লাস নামক স্থানে যেখানে রয়েছে সেই বিখ্যাত ‘অসলো সিটি হল’। প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর তারিখে এখানেই ঘোষিত হয় শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের নাম। নোবেল পুরস্কারের অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে একমাত্র নোবেল শান্তি পুরস্কারটিই নরওয়ের রাজধানী ‘অসলো সিটি হল’ থেকে প্রদান করা হয়ে থাকে। নরওয়ের রাজা পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে সিটি হল সেন্টারে উপস্থিত থাকেন। হলের অভ্যন্তরে চারিপাশের দেয়ালে স্বনামধন্য শিল্পীদের আঁকা বিভিন্ন ধরনের ম্যুরাল পেইন্টিং, ডিজাইন এক কথায় অপূর্ব!
সারাদিন হাটাহাটির পর প্রচন্ড ভাত-রুটির খিদে পেয়েছিল। কার্লস জোহান্স গেট রোডেই পেয়ে গেলাম জয়পুর ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট। এখানে চড়া দামে মিলল ভাত, নানরুটি ও সবজি। পেট পুড়েই খেলাম। ততক্ষণে রাত প্রায় সাতটা ছুঁই ছুঁই। দ্রুত পায়ে হেটে সোজা বাস স্টেশন। ঠিক কাঁটায় কাঁটায় রাত ০৭:২৫-এ আমাদের দ্বিতল বাস এসে হাজির হলো। মোট দূরত্ব ২৯৩ কি.মি.। গোথেনবার্গের নিলস এরিকসন টার্মিনালে এসে বাস যখন থামলো তখন রাত ১১:১০ মিনিট। হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় বারোটা। আগামিকাল আবার ক্লাশ শুরু।
ভাস্তারভিক: ১৮ নভেম্বর ২০১৫ বিকাল ০৪:৪৫ মিনিট। গোথেনবার্গের পাঠ চুকিয়ে দিয়ে প্রায় ৩২০ কি.মি দূরে সুইডেনের পূর্ব উপকূলীয় শহর ভাস্তারভিক-এর উদ্দেশে যাত্রা।
একটি ভাড়া করা বাসে আমাদের প্রশিক্ষণের সার্বক্ষণিক দায়িত্বে নিয়োজিত প্রগ্রাম কো-ডাইরেক্টর মিজ গুনিলা ওলুন্দ উইঙ্কভিস্ত, মিজ আনা ফ্রান্সিস ওলসন, প্রগ্রাম কো-অর্ডিনেটর মিজ কারিন হগলুন্দ-সহ সব প্রশিক্ষণার্থী ভাস্তারভিক এসে যখন পৌঁছি তখন রাত প্রায় সাড়ে ন’টা। দশটার মধ্যেই গভীর ঘুম। সুইডেনে আসার পর এই প্রথম আমার ভালো একটি ঘুম হলো।
গতকাল মোবাইলে গুগলআর্থে দেখে নিয়েছিলাম আমাদের হোটেলের পাশেই বলটিক সাগর। খুউব ভোরে হোটেল থেকে বলটিক সি-তে সূর্যোদয় দেখব বলে আমি আমার প্রিয় নিকন ক্যামেরাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গতকাল ভালো ঘুম হওয়ায় একরকম ফুরফুরে মেজাজেই বের হয়েছি। এখানে ছোট ছোট বাড়িগুলোর খুব সম্ভবত: বেশির ভাগ সিঙ্গেল ইউনিটের। বেশ পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন। বাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেনো অন্য কোথাও বানিয়ে এখানে এনে শুধু নির্দিষ্ট জায়গায় বসিয়ে দেয়া হয়েছে। বলটিক সাগর তীরে গড়ে ওঠা শহরটিতে তেমন লোকসমাগম নেই। জানা গেল গ্রীষ্মের শুরুতে দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক বলটিক উপকূল ও এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখতে ভিড় জমায়। ছোট ছোট অসংখ্য প্রমোদ তরী সারিবদ্ধভাবে তীরে নোঙর করে রাখা হয়েছে।
দূর হতে দেখা যাচ্ছে কিছু কর্মজীবী ও শিক্ষার্থী সাইকেলে প্যাডেল চাপিয়েছে। গোটা দুয়েক প্রাইভেট কার অলস গতিতে পাশাপাশি চলছে। কারো কোনো ব্যস্ততা নেই। আমি বিমুগ্ধ হয়ে বলটিক তীরের আধুনিক সভ্যতার ছবি তুলে চলেছি। একই সাথে অপেক্ষা করছি লাল সূর্যোদয়ের। এরই মাঝে তীব্র শীতের মধ্যে স্থানীয় প্রজাতির এক ঝাঁক হাঁস আমাকে দেখেই পানিতে ঝাঁপ। মনে মনে ভাবছিলাম আমাদের দেশিয় প্রজাতির হাঁস এরকম প্রায় শুন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানিতে ঝাঁপ দিয়ে বেঁচে থাকতো কী। একই বলে অভিযোজন! সকালের ক্লাশ ও দুপুরবেলা মাইনিং সাইট পরিদর্শন দিয়েই ভাস্তারভিক ভ্রমণ এখানেই শেষ। বিদায় ভাস্তারভিক!
স্টকহোম: ১৯ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে একই বাসযোগে ভাস্তারভিক থেকে রাত নয়টার কিছু পরে স্টকহোমে এসে পৌঁছি। স্টকহোমের অলভিকের পাশে StayAt Hotel Apartments, Bromma-য় আমাদের অবস্থান। নিজ দেশে না ফেরা পর্যন্ত এখানে অবস্থান। স্টকহোম শুধু সুইডেনের রাজধানীই নয় একে স্ক্যান্ডিনেভিয়ানের রাজধানীও বলা হয়ে থাকে। এর সিটি এরিয়া ১৮৮ ব.কি.মি আর জনসংখ্যা মাত্র ৯ লক্ষের কিছু বেশি। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় শহর। আর আমাদের ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা দেড় কোটি। যা সুইডেনের পুরো দেশের লোকসংখ্যার দেড় গুণের অধিক।
এই শহরটি ছোট বড় বেশকিছু দ্বীপপুঞ্জের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে এখানকার পরিবহন ব্যবস্থা। অবশ্য পুরো সুইডেনের পরিবহন ব্যবস্থাই একররকম। Storstockholms Lokaltrafik (SL)-এর অধীনে স্টকহোম মেট্রো (Tunnelbana তুন্নেলবানা), কমিউটার ট্রেন (Pendeltåg পেন্দেলতগ), বাস ও ট্রাম লাইন পরিচালিত হয়। প্রতিটি স্টেশনে ডিসপ্লে বোর্ডে কতসময় পর কোন যানবাহন আসছে এবং কোথায় যাবে তা এলইডি স্ক্রিনে শোভা পাচ্ছে। এমন কি মোবাইল ফোনে অনলাইনের মাধ্যমেও এসব তথ্য মুহূর্তের মধ্যে যে কেউ জানতে পারছে। সমস্ত যানবাহন চলাচল করছে ঘড়ির কাঁটায় মেপে মেপে। এ ছাড়া স্টকহোম শহরে এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যাতায়াতের জন্য সড়ক/সেতু ছাড়া নৌপথের সুব্যবস্থা রয়েছে।
স্টকহোমের এই হোটেলটির প্রতিটি রুমেই রান্না করা ব্যবস্থা রয়েছে। রান্নার জন্য ইনডাকশন ওভেন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, সসপ্যান, ফ্রাইপ্যান, ছুরি, কাঁচি, নানা রকমের কাটলারিজ, ক্রোকারিজ কী নেই। হ্যাঁ নেই শুধু বাঙালির চাল, ডাল আর তেল, মশলা!
স্টকহোম শহরের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের জন্য আমাদেরকে সাতদিনের জন্য একটি ট্রান্সপোর্ট কার্ড দেয়া হয়। এ কার্ড দিয়ে স্টকহোম সিটির মধ্যে বাস, ট্রাম, ট্রেন ইচ্ছেমতো ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ আমাকে আর ভাড়া দেবার নগদায়নের প্রয়োজন নেই। প্রায় প্রতিদিন ক্লাশ শেষে দলবেঁধে অলভিক স্টেশনে ছুটে যাওয়া। তারপর ট্রেন বা ট্রাম চেপে দূরে কোনো শপিং মলে কেনাকাটা কিংবা ঘুরে দেখা। আবার উল্টো ট্রেন বা ট্রামে করে হোটেল ফিরে আসা। কোনো কোনো স্টেশনগুলো ভূতলের বেশ নিচে। উপরে নিচে ওঠা-নামার জন্য নানানদিকে রাস্তা। এই নিচের ভূতল স্টেশনগুলো কেমন যেনো একটু ভুতুরে মনে হতো। যে টানেলে ট্রেন বা ট্রাম আসতো ঐ পথটি থাকতো আলো-আঁধারীময়।
প্রথমদিকে একবার সবাই মিলে শপিং শেষে ফিরে আসার সময় কোনো এক ভূতল স্টেশনে আমি হঠাৎ দলছুট হয়ে একাকী হয়ে যাই। নানানদিকে উপরে-নিচে খুঁজে কাউকে না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম একাই হোটেলে ফিরবো। সুইডিশরা সবাই ভালো ইংরেজি জানেন। তাই কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে হোটেলে যাওয়ার ট্রেন কোনটি জেনে নিয়ে উঠে গেলাম। আমি যথাসময়ে ফিরেও এলাম। ভাবলাম আমার দেশের বাকী সঙ্গীরা তো নিশ্চয় আমাকে খুঁজবে। হোটেলে লবিতে দীর্ঘসময় বসে থাকার পর তারা ফিরে এলো। আমাকে পেয়ে তো একজন কেঁদেই ফেলল। তাঁরা হন্যে হয়ে বিশাল বড় সেই স্টেশনের উপর-নিচ খুঁজে বেড়িয়েছে। অবশেষে পুলিশে খবর দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে হোটেলে ফিরে এসে দেখে আমি বহাল তবিয়তে হোটেলে এসেছি। উল্লেখ্য, ২/১ দিন আগেই প্যারিসে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী ঘটনার কারণে ওঁরা ভেবেছিল আমাকে হয়তো কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপ অপহরণ করেছে। বিদেশ বিভুঁইয়ে এক বাংলাদেশি আরেক বাংলাদেশির জন্য এরকম ভালোবাসা আমাকে সত্যিই অবাক করেছে। আমি ক্ষমা চেয়ে আমার অপরাধ স্বীকার করে নিলাম।
উপসলা: সুইডেনের ভূ-তাত্ত্বিক গবেষণা ও খনিজ জরিপ এবং এতদসংক্রান্ত পরিবেশগত টেকসই ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জ্ঞানলাভের জন্য ২৪ নভেম্বর ২০১৫ তারিখ উপসলায় অবস্থিত সুইডিশ জিওলজিক্যাল ইন্সটিটিউট যাই। পাশেই উপসলা ইউনিভার্সিটি। স্টকহোম শহর থেকে প্রায় ৭০ কি.মি. উত্তরে অপেক্ষাকৃত নিরব, নিস্তব্ধ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান। পৃথিবীর নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্যতম। ১৪৭৭ সালে নির্মিত এটি সুইডেনের সবচেয়ে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশাল বড় ক্যাম্পাস। চারিদিকে পরিকল্পিতভাবে লাগানো বিভিন্ন ধরনের গাছগাছালির সমাহার অন্যরকম প্রেমময় আবেগ সৃষ্টি করেছে। শীতের কারণে প্রকৃতি কিছুটা ম্লান মনে হচ্ছিল। গ্রীষ্ম-বসন্তকালে নিশ্চয়ই অভূতপূর্ব সৌন্দর্য্য পেখম মেলে দেয় তা আর বলার অবকাশ রাখে না।
লেখক: পরিবেশবিদ, গবেষক।