মাশরাফির বিদায়ী ম্যাচে বাংলাদেশের দুর্দান্ত জয়স্টাফ রিপোর্টার :: মাঠের বাইরের ঘটনাপ্রবাহ ক্ষণিকের জন্য ভুলে যান, মাঠে থেকে আন্তর্জাতিক টি২০কে যেভাবে বিদায় জানালেন মাশরাফি বিন মর্তুজা, এর থেকে খুব ভালো কিছু বুঝি আর চাওয়ার ছিল না তার নিজেরও। সতীর্থরা চেয়েছিলেন অনুপ্রেরণাদায়ী ক্যাপ্টেনকে বিজয়ীর বেশে বিদায় দিতে, তাদের সেই চাওয়াটাও পূর্ণ হয়েছে। বৃহস্পতিবার সিরিজের দ্বিতীয় টি২০ ম্যাচে ৪৫ রানের জয়ে শ্রীলংকা থেকে প্রথমবারের মতো টিম বাংলাদেশ ফিরতে একটিও সিরিজ না হারার প্রাপ্তি নিয়ে। টেস্ট সিরিজের পর ওয়ানডে সিরিজেও ড্র করেছিল টাইগাররা, এবার ড্র হলো টি২০ সিরিজ। কাকতালীয়ভাবে প্রতিটি সিরিজেরই ফল ১-১!

বিদায়ী ম্যাচে ব্যাটে-বলে যেমন পারফরম্যান্স চেয়েছিলেন, তেমনটা হয়তো করতে পারেননি মাশরাফি। ব্যাটহাতে ছিলেন রানশূণ্য, প্রথম বলেই বোল্ড। বোলিয়ে ৩০ রান খরচায় একটি উইকেট পেয়েছেন। শেষ ম্যাচ, তাই হয়তো কিছুটা আবেগী ছিলেন, ম্যাচে পূর্ণ মনোসংযোগে যেটা বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল। রানআউট মিস করেছেন। অভিষিক্ত মেহেদী হাসান মিরাজের বলে লংকান দলপতি উপুল থারাঙ্গার সহজ ক্যাচটা যেভাবে ফেলে দিলেন, মাশরাফি অমনোযোগী থাকলেই কেবল এমনটা সম্ভব! তবে তার সতীর্থরা যে ম্যাচে কিছুটা হলেও বাড়তি মনোযোগী ছিলেন, তাকে জয় উপহার দিতে ঢেলে দিয়েছেন নিজেদের সেরাটা। ম্যাচে জয় পেতে তাই তেমন কোনো সমস্যা হয়নি টাইগারদের।

একাদশে কিছুটা পরিবর্তন এনে মাঠে নামা টিম বাংলাদেশ শুরু থেকেই ছিল বেশ ইতিবাচক। ইমরুল কায়েস আর সৌম্য সরকারের ব্যাটে ব্যাটিংয়ের শুরুটা ছিল দুর্দান্ত। পরে দারুণ কার্যকরী এক ইনিংস খেলেছেন সাকিব আল হাসান। লাসিথ মালিঙ্গার হ্যাটট্রিকের পরও তাতেই টাইগারদের ঝুলিতে জমা পড়েছে ৯ উইকেটে ১৭৬ রান। সেই রানটাকে পুঁজি করে বোলিংয়ের শুরুটাও হলো দুর্দান্ত। যার অগ্রভাগে থাকলেন ভাবী টি২০ অধিনায়ক এবং ম্যাচসেরা সাকিব (৩/২৪) আর কাটার মাস্টার মুস্তাফিজুর রহমান (৪/২১)। শুরু থেকেই ধুঁকতে থাকা লংকানরা গুটিয়ে গেল ১৩১ রানেই। তখনো ম্যাচের ১২ বল বাকি।

ইনিংসের শুরুতেই এদিন মাশরাফি বল তুলে দিয়েছেন সাকিবের হাতে। প্রথম বলেই বাউন্ডারি হজম করার পর বাঁহাতি স্পিনার ফিরলেন দারুণভাবে, পরের বলেই বোল্ড আগের ম্যাচে লংকানদের জয়ের নায়ক কুশাল পেরেরা। নিজের পরের ওভারে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ক্যাচ বানিয়ে তিনি ফিরিয়েছেন দিলশান মুনাবিরাকে। আরেক প্রান্তে থারঙ্গা তবু তেড়েফুড়েই খেলছিলেন। ২১ বলে ২৩ রান করেও ফেলেছিলেন। তবে মাহমুদউল্লাহ তাকে আর এগোতে দেননি। লংঅনে থারঙ্গার ক্যাচটা দারুণভাবেই তালুবন্দি করেছেন মিরাজ।

লংকানদের সবথেকে বড় ধাক্কাটা দিয়েছেন মুস্তাফিজ। ম্যাচে নিজের প্রথম বলেই আসেলা গুনারত্নেকে মোসাদ্দেক হোসেনের ক্যাচ বানিয়েছেন তিনি। ঠিক এর পরের বলেই এই বাঁহাতির শিকার মিলিন্দা সিরিবর্ধনে। মনে হচ্ছিল মালিঙ্গার হ্যাটট্রিকের জবাবটা এদিন আরেকটা হ্যাটট্রিক দিয়েই দেবে বাংলাদেশ। শেষতক যদিও তা আর হয়নি। তবে ৪০ রানের মধ্যে ৫ উইকেট তুলে নিয়ে লংকানদের ঠিকই ম্যাচ থেকে ছিটকে দিয়েছেন সাকিব-মুস্তাফিজরা।
ষষ্ঠ উইকেটে ৫৮ রানের একটা জুটি গড়ে কিছুটা হুমকি দিচ্ছিলেন থিসারা পেরেরা আর চামারা কাপুগেদারা। দ্বিতীয় স্পেলে বোলিংয়ে এসে সাকিব সেটাও ভেঙে দিয়েছেন। ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আসা থিসারা (২৩ বলে ২৭ রান) ব্যাটে নিতে পারেননি বলটা, দ্রুত স্টাম্প ভেঙে দিয়েছেন মুশফিক। সিকুগে প্রসন্নকে (১১) সরাসরি বোল্ড করেছেন মাশরাফি। এরপরও লড়ছিলেন ম্যাচে একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে হাফসেঞ্চুরি পাওয়া কাপুগেদারা। ৩৫ বলে ৫০ করা এই ব্যাটসম্যান হয়েছেন মুস্তাফিজের তৃতীয় শিকার। ওই ওভারে মালিঙ্গাকে ফিরিয়ে জয়টা একপ্রকার নিশ্চিতই করে দিয়েছেন মুস্তাফিজ। ভিকুম সঞ্জয়াকে ফিরিয়ে টি২০ ক্রিকেটে প্রথম উইকেটের স্বাদ পাওয়া সাইফুদ্দিন শুধু আনুষ্ঠানিকতাই সেরেছেন।

একাদশে পরিবর্তনটা ছিল ফলপ্রসূ। প্রথম টি২০ ম্যাচে ব্যর্থ তামিম ইকবালকে সরিয়ে এই ম্যাচে খেলা ইমরুল ছিলেন দুর্দান্ত। ছন্দে থাকা সৌম্যর সঙ্গে তার উদ্বোধনী জুটিতেই ভিন্ন চেহারায় দেখা গেল বাংলাদেশকে। মাত্র ৩৯ বলে তারা গড়েছেন ৭১ রানের জুটি। ম্যাচে বড় পুঁজির ভীত টাইগাররা পেয়ে গেছে সেখানেই। সেই ভীতে দাঁড়িয়ে পরবর্তী ব্যাটসম্যানরা পুঁজিটাকে ততটা ফুলিয়ে ফেঁপিয়ে তুলতে না পারলেও লড়াইয়ের জন্য তা যথেষ্টই ছিল।
শুরু থেকেই রুদ্ররূপে আবির্ভূত সৌম্য। প্রথম টি২০ ম্যাচের মতো এদিনও বাঁহাতি ওপেনার ফিরেছেন আক্ষেপ জাগিয়ে। এর আগে ৪টি চার আর ২টি ছক্কায় সাজানো ১৭ বলে ৩৪ রানের ইনিংসে লংকান বোলারদের ওপর দিয়ে রীতিমতো ঝড় বইয়ে দিয়েছেন তিনি। সৌম্যর মতো অতটা আগ্রাসী না হলেও দারুণ ব্যাটিং করেছেন ইমরুল। রানআউটের খড়গে কাটা পড়ার আগে ২৫ বলে খেলেছেন ৩৬ রানের ইনিংস, ৪টি চারের সঙ্গে একটি ছক্কাও হাঁকিয়েছেন।

সপ্তম ওভারের তৃতীয় বলে বোলার গুনারত্নেকে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরেছেন সৌম্য। ইমরুল ফিরেছেন ঠিক এর পরের ওভারেই। টানা দুই ওভারে উইকেট খুয়ানোর কিছুটা প্রভাব শুরুতে কিছুটা হলেও ছিল সাবি্বর আর সাকিবের ব্যাটে। গুনারত্নেকে ছক্কা হাঁকানোর পরও তাই ১৮ বলের ইনিংসে ১৯ রানের বেশি করতে পারেননি সাবি্বর, সঞ্জয়ার বলে লাইন মিস করে সরাসরি বোল্ড হয়েছেন।

সাকিব ফিরতে পারতেন সাবি্বরেরও আগে। সিকুগে প্রসন্নর এক ওভারেই দুবার তার ক্যাচ ফেলে দিয়েছেন লংকান ফিল্ডাররা। স্বাগতিকদের এই উপহার সাকিব অবশ্য তেমনভাবে কাজে লাগাতে পারেননি। নুয়ান কুলাসেকারাকে টানা দুই বলে সীমানা ছাড়া করলেন, কিছুটা শ্লথ হয়ে যাওয়া রানের চাকা ফের সচল হতেও শুরু করে। পরে সেই কুলাসেকারাকেই সাকিব খেলতে পারলেন ঠিকভাবে, বোল্ড হওয়ার আগে ৩১ বলে ৪টি চারের মারে করেছেন ৩৮ রান।

উইকেটে থিতু হওয়ার পর মালিঙ্গাকে টানা দুই বলে ছক্কা আর চার হাঁকিয়ে ভালো কিছুর আভাস দেয়া মোসাদ্দেক হোসেন (১১ বলে ১৭) হতাশ করলেন। ব্যাটিং অর্ডারে রদবদলে অনেকটাই নিচে নেমে যাওয়া মুশফিক অবশ্য থিতু হওয়ার চেষ্টা করেননি। ব্যাটিংয়ে যখন নেমেছেন ততক্ষণে ১৮তম ওভার শুরু হয়ে গেছে। দলের রান যথাসম্ভব বাড়িয়ে নিতে তাই ব্যাট চালাতেই হয়েছে তাকে। ম্যাচের মালিঙ্গার হ্যাটট্রিকে প্রথম শিকার হওয়ার আগে ৬ বলে করেছেন ১৫ রান।

বিদায়ী ম্যাচ খেলতে নামা মাশরাফির স্টাম্প উপড়ে দেয়ার পর অভিষিক্ত মিরাজকে এলবিডবিস্নওর ফাঁদে ফেলে টি২০ ক্যারিয়ারে প্রথম হ্যাটট্রিকের আনন্দে মাতেন মালিঙ্গা। এই নিয়ে পঞ্চম হ্যাটট্রিক দেখল টি২০ ক্রিকেট। মালিঙ্গার ক্ষণিকের ওই ঝড়ের বড় ভূমিকা থাকল বাংলাদেশের পুঁজি প্রত্যাশিত মাত্রা না পাওয়ার পেছনে। শেষের ১০.১ ওভারে ৭৫ রান হলো। ১০ ওভার না পেরোতেই শতরানের গ-ি ছাড়িয়ে যাওয়া ইনিংসটি থামল ১৭৬-এ। ওই পুঁজিতেই অবশ্য টি২০ ক্রিকেটে শ্রীলংকার বিপক্ষে দ্বিতীয়বার জয়ের স্বাদ পাওয়া গেছে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here