ঝিনাইদহ: মহাসড়কে স্যালোইঞ্জিন চালিত তিন চাকার যানবাহন চলাচলে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ঝিনাইদহের বিভিন্ন রুটে অবৈধ যানবাহন চলাচল করছে। স্থানীয়ভাবে এগুলো নসিমন, করিমন, আলমসাধু ও গ্রামবাংলা নামে পরিচিত।

এগুলোর রোড পারমিট ও ফিটনেস কোনটিই নেই। অবৈধ এসব যানবাহন চলাচলের কারণে বাড়ছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা, একই সঙ্গে স্যালো চালিত ইঞ্জিনের বিকট শব্দে প্রতিনিয়ত শব্দ দূষন হচ্ছে। জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতিসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন এসব অবৈধ যান বন্ধের দাবিতে একাধিকবার ধর্মঘট, অবরোধ ডেকেও কোন কাজ হয়নি। অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের গাফিলতি ও দায়িত্ব অবহেলার কারণে এসব অবৈধ যানবাহন বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আর প্রশাসনকে ম্যানেজ করার নামে শ্রমিক সংগঠনের নেতারা গাড়িপ্রতি ২ শত টাকা করে আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অবৈধ এসব যান্ত্রিকযানের সরকারী কোন রেজিষ্টেশন না থাকায় সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি জেলা বিআরটিএ অফিস থেকে। তবে গ্যারেজ মালিক ও চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলার ৬টি উপজেলার সবকটি সড়ক-মহাসড়কে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন এসব অবৈধ যান্ত্রিকযান চলাচল করছে এবং প্রতিদিনই এর সংখ্যা বাড়ছে। স্যালোইঞ্জিন দ্বারা নির্মিত এসব যান্ত্রিকযানের ভাড়া তুলনামূলক কম হওয়ায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে অল্পদিনেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। পাশাপাশি এগুলোর মূল্যও কম হওয়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ খুঁজে পেয়েছে কর্মসংস্থানের সুযোগ।

ঝিনাইদহ জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রোকনুজ্জামান রানু জানান, দীর্ঘদিন ধরে এসব অবৈধ যানবাহন জেলার সড়ক-মহাসড়কগুলোতে চলাচল করছে। প্রথম থেকেই এসব যানবাহনের ব্যাপারে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন সোচ্চার থাকলেও সংশিষ্ট প্রশাসনের গাফিলতি ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। ধীরে ধীরে অবৈধ যানবাহনের পরিমান ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া এবং দরিদ্র জনগোষ্টির বৃহৎ একটি অংশ এসবের সঙ্গে সংশিষ্ট হয়ে পড়ায় এখন বন্ধ করাও কঠিন হয়ে পড়বে বলে জানান তিনি।

ঝিনাইদহ বিআরটিএ অফিসের মোটরযান পরিদর্শক বিলাশ সরকার জানান, রোড পারমিট ছাড়া যানবাহন চলাচল বেআইনী। কিন্তু অবৈধ যানবাহনের মালিকরা রোড পারমিট কিংবা গাড়ির রেজিষ্ট্রেশনের জন্য বিআরটিএ অফিসে আসেন না। তিনি বলেন, রেজিষ্ট্রেশন বিহীন যানবাহনের জন্য ৫ হাজার টাকা ও ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া যানবাহন চালানোর জন্য ৫ শত টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধে স্থানীয় প্রশাসনকে একাধিকবার অনুরোধ করা হয়েছে। সর্বশেষ হাইকোর্ট থেকে এসব যানবাহন চলাচল বন্ধে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. মনিরুজ্জামান জানান, লাখ লাখ টাকা ভর্তুকী দিয়ে কৃষিকাজের জন্য ট্রাক্টর আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু তা দিনরাত মালামাল পরিবহন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃষিকাজ ছাড়া সাধারণ পরিবহন কাজে এগুলোর ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।  জেলা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটির আহবায়ক মাসুদ আহম্মেদ সঞ্জু বলেন, ৭০ ডেসিবল পরিমাণ শব্দ মানুষের জন্য সহনীয়। কিন্তু এসব যানবাহন ১২০ থেকে ১৩০ ডেসিবল শব্দ ব্যবহার করে থাকে। ফলে এসব যান মানুষের শ্রবণশক্তির ক্ষতি করছে। পুলিশের সাথে অলিখিত চুক্তির মাধ্যমে এসব যানবাহন চালানো হচ্ছে।

সদর উপজেলার দোগাছি গ্রামের নসিমন চালক ফিরোজ হোসেন বলেন, ‘নসিমন চালানো অবৈধ হলেও আমরা গরীব মানুষ। লেখাপড়া করিনাই বলে চাকরি হয়নি। তাই নসিমন চালাই খাই’। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কালিচরণপুর গ্রামের এক আলমসাধু চালক জানান, পুলিশকে যানবাহনপ্রতি মাসিক ২শত টাকা চাঁদা দিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। টাকা না দিলে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় গাড়ি। থানা থেকে গাড়ি ছাড়াতে পুলিশকে ২/৩ হাজার  টাকা উৎকোচ দিতে হয়।

অভিযোগ রয়েছে, ঝিনাইদহ শহরের পুলিশ লাইনের পাশে, বিসিক শিল্পনগরীর সামনে, চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যাণ্ডে, ক্যাডেট কলেজের সামনে, সদর উপজেলার হাটগোপালপুর ও বিষয়খালী বাজারে সাদা পোশাকে নসিমন করিমন চালকদের নিকট থেকে চাঁদা তোলা হয়। চাঁদা আদায়কারীরা বলছেন, এই চাঁদার টাকা পুলিশের কনষ্টেবল, এসআই এমনকি উচ্চ পর্যায়ে ভাগবাটোয়ারা হয়ে থাকে বলে।

এ বিষয়ে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান বলেন, হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার পর মহাসড়ক থেকে অবৈধ যানবাহন আটকের জন্য অভিযান চলছে। ইতিমধ্যে ঝিনাইদহ জেলায় শতাধিক নসিমন ও  করিমন আটক করা হয়েছে। তবে পুলিশের চাঁদা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, অবৈধ যানবাহন থেকে পুলিশের চাঁদা আদায় ও ভাগবাটোয়ারার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। পুলিশের কোন কর্মকর্তা এধরণের কাজের সাথে জড়িত নয়। তবে পুলিশকে ম্যানেজ করার নামে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নোতারা নসিমন চালকদের নিকট থেকে চাঁদা আদায় করছে। এ নিয়ে কয়েকটি মামলাও বিচারাধীন রয়েছে।

আহমেদ নাসিম আনসারী/

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here