ভয়াল ১২ নভেম্বরএএইচএম নোমান:: ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর গভীর রাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা দিয়ে ভয়াল জলোচ্ছ্বাস বন্যা বয়ে যায়। হিংস্র তান্ডবে বেসরকারীভাবে ১০ লাখ (সরকারীভাবে ৫ লাখ) আদম সন্তানের সলিল সমাধি ঘটে। কোটি কোটি টাকার পশু সম্পদ, ফসল- ফসলাদি, স্কুল কলেজ, মাদ্রাসা, স্থাপনা, ঘরবাড়ী, গাছ-গাছালি, রাস্তা ঘাট, ব্রীজ, সাঁকো স-ব লন্ডভন্ড করে দেয়।

ঐ মহাদূর্যোগে শুধু উপকূলবাসী নয়, সারা দেশবাসী সম্বিত হারিয়ে দিশেহারা। পথ খোঁজার রাস্তা, ক্ষুধার তাড়না, সহায় সম্পদ স্বজনহারা আশ্রয়হীন জীবন জীবিকাহীন বেঁচে থাকাদের আহাজারী, চোখের পানি শুকিয়ে ধ্বংসকে সৃষ্টির হাতছানির বজ্র কঠিন ভীত তৈরী হলো। শ্লোগান ব্যবহার করা হলো। The Dead need not us but we need them, they may serve us still. (মৃতদের জন্য আমাদের প্রয়োজন নেই কিন্তু এখনও তাঁরা আমাদের সেবা দিতে পারে)।

পড়শী আত্মীয় স্বজন, দেশী বিদেশীরা ত্রাণ সামগ্রী, চালডাল, তেল, লবন দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। তাঁবু, কম্বল, চাষের গরু, ট্রাক্টর, বীজ, পানের বরজের জন্য বাঁশ, ঘর ও জেলেদের জন্য নৌকা-জাল ইত্যাদি  দিয়ে পুনর্বাসনের কার্যক্রম। চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বে সিএসপি আবদুর রব চৌধুরীকে এবং তৎকালীন বৃহত্তর বরিশাল জেলার সিএসপি মোকাম্মেল হক সাহেবকে দায়িত্ব দিয়ে সরকারীভাবে ত্রাণ পুনর্বাসনে কাজ শুরু হলো। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিল খোদ পাকিস্তানী শাসকরা কোথায় ?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ উপকূল গ্রামে চরে, ঘাটে, হাটে, ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে যোগ ও জোর দিলেন।  পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ১ (এক) দফায় পরিনত হলো, ভাসানী সাহেব ওয়ালাইকুম ছালাম জানিয়ে পাকিস্তানীদেরকে বিদায় বার্তা জানিয়ে দিলেন। সারা দেশবাসী রাজনৈতিকভাবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার আন্দোলনকে বেগবান ও এগিয়ে নিলেন।

উপকূলীয় রামগতি, হাতিয়া, সূধারাম, দৌলতখাঁ, মনপুরা, সন্দ্বীপসহ সারা এলাকায় কৃষক জেলে সমবায় সমিতি গঠন করে ৭ রং এর রংধনু পতাকা উঁচিয়ে সংগঠিত হলো। পুনর্বাসন, উৎপাদন, ত্রাণ ও বন্টন ব্যবস্থা নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লো। শ্লোগান ছিলো ‘প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’।

কবি গুরুর ভাষায় ‘যাহা চাই যেন জয় করে পাই গ্রহণ না করি দান হে সর্বশক্তিমান’। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলা শুরু হলো ‘ভিখারীর হাত থেকে কর্মীর হাতিয়ার’। জানান দিল .We Want Release Not Relief.

স্বাধিকার আন্দোলন লক্ষ্যে রোপিত বীজ ৬ দফা আন্দোলন ১ (এক) দফায় ত্বড়িৎ গড়াতে লাগল, পাকিস্তান জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৭০ সাইক্লোন বিধ্বস্ত উপকূলীয় এলাকায় স্থগিত করা হলো। মৃতদের জীবনের বিনিময়ে দেশের ও দুনিয়ার উপলব্ধির জাগরণের ফসল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষিত হয়ে মুক্তি যুদ্ধ শুরু হলো।

দীর্ঘ মেয়াদি যুদ্ধের আশংকায় ‘একই সঙ্গে উৎপাদন যুদ্ধও শুরু হলো। পুনর্বাসন কার্যক্রমে যার ভিটা তার ঘর, এবং গুচ্ছকারে সার্বিক উন্নয়ন মডেল বিশ্বগ্রাম স্থাপন হলো। কৃষি পুনর্বাসনে শীতকালীন শবজী, বীজ, আলু, বাদাম, সোয়াবীন, ভুট্টা, গম, গাজর, লেটুস, ফুল কপি, বাঁধা কপি ইত্যাদি চাষাবাদ করা হলো। ব্রিটিশ সাহায্য সংস্থা সিবিসি ভোলা সদর, আলেকজান্ডার ও সুধারামের চর জব্বারে ট্টাক্টর ওয়ার্কশপ স্থাপন করে ৪০টি ট্টাক্টর দিয়ে বিএডিসি’র আওতায় সমবায়ের মাধ্যমে যান্ত্রীক চাষাবাদ শুরু করল। যার ফলশ্রুতিতে লক্ষ্মীপুর এখন সোয়াবীন জেলা নামে পরিচিত। নৌকা জাল ও যান্ত্রীক, মাছ ধরার লঞ্চ দিয়ে জেলেদের পুণর্বাসন কাজ চলল।

এভাবেই সবজি ভাত ও মাছ, মুরগী, গবাদি পশু (মামুগ) আন্দোলন শুরু করা হলো। এভাবেই বেঁচে থাকার তাগিদে শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে জীবন যুদ্ধে ব্যবহার করা হলো এগিয়ে যাওয়ার পথ রচনা। ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার দ্বি-স্তর বিশিষ্ট সেলফ জেনারেটিং রামগতি থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও সেক্রেটারী হিসাবে এসব কর্মযজ্ঞ জীবন দিয়ে রচনা করা ও গড়া আমার জীবনের বিশাল আত্মতৃপ্তি। সৃষ্টি হলো নিজের পায়ে দাড়ানর শক্তিমালা। জাতি হাতরিয়ে নিল লেট দ্যা ডেড সার্ভ দ্যা লিভিং পংতিমালা অর্থাৎ মৃতদেরকে জীবিতদের সেবা করতে দিন।

শুধু যাতনায় ভুগছি ধনী-গরীব বৈষম্য দিন দিন যেভাবে বাড়ছে তাঁর সমাপ্তি কোন দিন কিভাবে হবে? ১২ই নভেম্বর ১৯৭০ স্মরণে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় এ বছর এই দিনে Devastating Cyclone and Coastal Resilience’  গবেষণা সেমিনার আয়োজন করেছে। গবেষকরা গবেষণার কি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করবেন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট কিভাবে উপস্থাপন করবেন তা জানতে জাতি অবশ্যি অপেক্ষা করছে।  এসডিজি ১৭টি এজেন্ডার ১নং এজেন্ডা  Ending poverty কে চূড়ায় রেখে মাতৃত্বকালীন ভাতা কেন্দ্রীক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন, কর্মসংস্থান, সেভিংস প্লাস সরকারের মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের পরিচালিত স্বপ্ন প্যাকেজেই পারে ন্যয্যতা-সাম্যতা ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে।

 

লেখক:: এএইচএম নোমান, প্রতিষ্ঠাতা, ডরপ এবং গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার বিজয়ী। nouman@dorpbd.org

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here