আপনি কি অফিসের কাজে সময়নিষ্ঠ, কর্মঠ, পরিশ্রমী একজন চাকুরে?

আপনি কি বন্ধুদের মধ্যমণি?

আপনি কি অফিসের কাজে নিবেদিত প্রাণ?

আপনার আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, কলিগ এবং বসরা কি আপনাকে অনেক পছন্দ করে?

আপনি কি সবসময় সবার কাছে ভালো হয়ে থাকার চেষ্টা করেন?

তবে আপনাকেই বলছি।

শেষ কবে স্ত্রীর কাছে মন থেকে আগ্রহ নিয়ে জানতে চেয়েছেন সে কেমন আছে?

শেষ কবে স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনের কথা বুঝতে চেয়েছেন?

শেষ কবে রান্নাঘরে স্ত্রীকে সাহায্য করেছেন?

আপনি কি জানেন আপনার স্ত্রী সারাদিন অপেক্ষা করে আপনার একটা ফোন কলের আশায়?

সারাদিন অফিসে অনেক কাজ করে, অনেক লোকের সাথে অনেক কথা বলে বাসায় ফিরেন ক্লান্ত হয়ে। তখন স্ত্রীর দুই একটা প্রশ্নও আপনার কাছে মনে হয় কৈফিয়ত। তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ দুটো কথাও মনে হয় অকারণ বকবক। আপনি প্রচণ্ড বিরক্তি সহকারে হয় দুই একটা উত্তর দেন, নয়ত এমন কিছু বলেন যে সে চুপ হয়ে যায়। এরপর বসে পরেন মোবাইল, ল্যাপটপ, কিংবা টিভির রিমোট নিয়ে। হারিয়ে যান সামাজিক মাধ্যম, অফিসের কাজ, কিংবা বিনোদনের জগতে। কিন্তু একবারও ভেবে দেখেছেন কি সারাদিন এই মানুষটি আপনার সাথে একটু কথা বলার জন্য অপেক্ষা করে ছিল? হয়ত অনেকবার ভেবেছে আপনাকে একটা কল দিবে, কিন্তু আপনি ব্যাস্ত আছেন ভেবে দেয়নি। কিংবা সে সাহস করে দিয়ে থাকলেও আপনি তা রিসিভ করেন নি, কিংবা তার কথা শেষ হবার আগেই ব্যাস্ততা দেখিয়ে ফোন রেখে দিয়েছেন। আর আপনি নিজেও হয়ত সারাদিনে একটি কল দিয়ে তার খোজ নেয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। সারাদিনে সে আপনাকে একটুও পায়নি। হয়ত সারাদিনে একটু কথা বলার জন্য তার কাছে একটি মানুষও ছিলোনা। একবারও ভেবে দেখেছেন সে যে দিনে দিনে কথা কমিয়ে দিচ্ছে। সে যে তার ভাষা হারিয়ে ফেলছে। বাকশক্তি থাকা সত্তেও, মনের মধ্যে অনেক কথা থাকা সত্তেও, সে বোবা হয়ে যাচ্ছে। সে যে আর আগের মত যা মনে আসছে বলছে না, ইচ্ছামত হাসছে না। মেপে মেপে প্রয়োজনীয় কথাটুকু বলেই চুপ হয়ে যাচ্ছে। সে জানছে না আপনার দিন কিভাবে কাটে আর আপনিও জানছেন না তার দিন কিভাবে কাটে। কেউই কারো কাছে কিছু বলেননা। অথচ এমনটা হবার কথা ছিলোনা।

আপনি দিনের পর দিন অফিসে দুই একঘণ্টা করে বেশি সময় দিয়ে আসছেন বসের মন পাবার জন্য। অথচ একদিন একটু আগে যেতে চাইলে বসের মুখ কালো হয়ে যায়। আর আপনি যদি সবসময়ের চেয়ে একদিন আধাঘণ্টা আগে বাড়ি ফিরেন আপনার স্ত্রী কতটা খুশি হয় একবার খেয়াল করেছেন? আপনি বাসায় ফিরেও অফিসের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, পুরনো কলিগদের খোঁজ খবর নেন, বর্তমান কলিগদের খোঁজ খবর নেন, বন্ধুবান্ধবদের সাথে যোগাযোগ করেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সামাজিকতা বজায় রাখেন। কিন্তু একবারও ভেবে দেখেন না আপনার সবচেয়ে আপন মানুষটিরও একটু খোঁজ খবর নেয়া উচিত। সেও আপনার কাছ থেকে দুই একটা মিষ্টি কথা আশা করে।

আপনি কি জানেন আপনি অফিস শেষে যেই কলিগদের সাথে সময় কাটান, কিংবা ছুটির দিনে যেই বন্ধুদের সাথে সময় কাটান, আপনি অসুস্থ হলে তাদের দুই একজন দুই একটা এসএমএস কিংবা কল করবে, আর সর্বোচ্চ দুই একজন একবার দেখতে আসবে। কিন্তু আপনার স্ত্রীটি কি করবে জানেন? দিনরাত আপনার সেবা করবে। রাতের পর রাত আপনার পাশে জেগে থাকবে। সৃষ্টিকর্তার কাছে দিনরাত দোয়া করবে আপনার সুস্থতার জন্য। পৃথিবীতে যদি মৃত্যু পর্যন্ত যেকোনো পরিস্থিতিতে কেউ আপনার পাশে থাকার সংকল্প করে থাকে, সে একমাত্র আপনার স্ত্রী।

আপনি হয়ত বন্ধু কিংবা কলিগদেরকে খুশি করার জন্য, কিংবা নিজে আনন্দ পাবার জন্য তাদের সাথে ঘুরতে যান, রেস্টুরেন্টে খেতে যান, তাদেরকে খাওয়ান। তারা কতখানি খুশি হয়? কিংবা আপনি কতখানি খুশি হন? হয়ত দিনশেষে একটা শীতল উপহাসও অনেক সময় ভাগ্যে জোটে যে আপনি কোন একটা বিষয়ে কৃপণতা করেছেন। কিন্তু আপনি যদি আপনার স্ত্রীকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যেতে চান কিংবা রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে চান, প্রথমেই সে না করে বলবে, “শুধু শুধু টাকা নষ্ট করার কি দরকার? যেতে হবে না। চল আজ বাসায় একসাথে থাকি। দু’জন মিলে স্পেশাল কিছু রান্না করে খাই”। আর তারপরও যদি নিয়ে যান কি হবে জানেন? আপনি তার চোখে মুখে দেখতে পাবেন খুশির জোয়ার, আনন্দের ফোয়ারা, আর কৃতজ্ঞতার ঝর্ণাধারা। যা আপনার কাছে মনে হওয়া উচিত অপার্থিব উপহার। কিন্তু আপনি সেই অপার্থিব উপহারের ধার ধারেন না।

আপনি হয়ত খুবই সাহায্যকারী একজন বন্ধু কিংবা কলিগ। ছুটির দিনে, অফিস শেষে, অবসর সময়ে আপনি আপনার বন্ধু কিংবা কলিগদের কাজে সাহায্য করেন। কখনও বা সারাদিনের জন্য বেড়িয়ে পরেন কারও সাহায্যার্থে। কিন্তু কখনও আপনার স্ত্রীর অফিসের খোঁজ নিয়েছেন? তার কাজের খোঁজ নিয়েছেন? সে যেন ক্যরিয়ারে ভালো করতে পারে সেজন্য সাহায্য করেছেন? তার ঘরের কাজটি করে দিয়ে তাকে বাইরের কাজটি ভালোভাবে করতে সাহায্য করেছেন?

বন্ধু, কলিগ, ক্লাইন্টদের পিছনে কত কত অর্থ ব্যয় করে কি পান আপনি? দুটো ধন্যবাদ আর একটি পলিশ করা কর্পোরেট হাসি। স্ত্রীর জন্য দশ টাকার একটি গোলাপ কিংবা বেলি ফুলের মালা নিয়ে গেছেন কখনও? নিয়ে গিয়ে দেখবেন কি পান। সেই ফুল সে মাটিতে রাখবেনা পিঁপড়ায় খাবে, আর মাথায় রাখবেনা উকুনে খাবে বলে। সেই ফুল সে বুকের মধ্যে রাখবে পরম যত্নে। একদিন মুদি দোকান থেকে ১ টাকার বিনিময়ে ফেরত পাওয়া একটি চকলেট নিয়ে গিয়ে তাকে দিলে দেখবেন সে তার থেকেও আপনাকে একটু ভাগ দিতে চায়। তার পছন্দের কোন কিছু বছরে একবার তাকে উপহার দিলে, কিংবা তার প্রিয় কোন খাবার বছরে দুইবার তাকে খাওয়ালে, দিনে তিনবার তা মনে করে সে আহ্লাদিত হবে।

আপনার স্ত্রীর চোখের পানি মুছে দিয়েছেন কখনও? হয়ত না। কারণ সে আপনার সামনে ভাব দেখায় পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী স্ত্রীর, আর আপনার অগোচরে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। যে মানুষটি তার পরিবার, বাসস্থান, চিরচেনা পরিবেশ, সংস্কৃতি, সংস্কার সব ছেড়ে শুধুমাত্র আপনাকে ভালোবাসার জন্য, আপনার ভালোবাসা পাবার জন্য আপনার হাত ধরে আপনার কাছে চলে এসেছে সারাজীবনের জন্য, তার চোখে যদি আপনারই কারনে পানি আসে, তবে আপনি বড়ই অকৃতজ্ঞ। কারণ তারমত আপনাকে কিছুই ছাড়তে হয়নি। কিছুই হারাতে হয়নি। আপনার সবকিছুই আগের মত। সবটুকুই পাওয়া। আর আপনার স্ত্রীর? দেখবেন ধীরে ধীরে তার হাসি মিলিয়ে গেছে। তার ঠোটদুটো আগের মত আর তৈরি থাকেনা খুব সামান্য কিছুতেই ফিক করে হেঁসে ফেলার জন্য। তার চোখগুলো আগের মত আর ঝলঝল করে না। চোখগুলো কথা বলেনা। ইশারা করেনা। কেমন যেন নির্লিপ্ত, উদাস, ফ্যাকাসে।

এরই মধ্যে সে হয়ত আপনাকে দুটো বাচ্চা উপহার দিবে। সবাই বলবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন শক্ত করতে এসেছে সন্তান। বরং এবার আপনারা আরও দূরে চলে যাবেন। যদি আগে থেকেই ভালোবাসার বন্ধনটা শক্ত করে না রাখেন, সন্তান এসে সেটাকে আর শক্ত করতে পারবে না। তখন আপনি ব্যস্ত হয়ে যাবেন সন্তানের জন্য বাড়তি খরচ জোগাতে। আর আপনার স্ত্রী ক্যারিয়ার এবং সংসারের পাশাপাশি এবার ব্যস্ত হয়ে পরবে সন্তান সামলাতে। আপনার জন্য ভেবে ভেবে, অপেক্ষা করে করে, কেঁদে কেঁদে, আগে যেই সময়টা সে ব্যায় করত, এখন সে সেটা দিবে সন্তানের জন্য। সে কখনই আপনার জন্য রাখা সময়টা সন্তানকে দিতে চায়নি। সে সারাজীবন আপনাকে আপনার স্থলেই চেয়েছিলো। আর ভেবেছিলো আপনারা দু’জন মিলে দুজনার সন্তান মানুষ করবেন। কিন্তু আপনাকে পাশে না পেয়ে না পেয়ে সে একাই সন্তান লালন পালনের দায়িত্ব নিয়েছে। ফলে আপনার জন্য রাখা সময়টাও ব্যায় করতে শুরু করেছে সন্তানদের পিছনে।

এমনি করতে করতে একদিন দেখবেন আপনার চাকরির মেয়াদ শেষ। আপনার শরীরের শক্তি কমে এসেছে। আপনার এখন আর বাইরে গল্প করার, সময় কাটানোর ইচ্ছা হয়না। খরচ করার মত টাকাও হয়ত খুব বেশী থাকেনা। শরীরটাও মাঝে মাঝেই খারাপ করে। এখন আপনি বাসায়ই থাকতে চান। স্ত্রীর সাথেই সময় কাটাতে চান। স্ত্রীর যত্ন চান। কিন্তু আপনার দীর্ঘদিনের নিয়মিত উপেক্ষায় আপনার এবং আপনার স্ত্রীর মধ্যে তৈরি হয়েছে লম্বা দূরত্ব, যা সহজেই গুচিয়ে ফেলার নয়। এখন আপনার স্ত্রী আপনার কাছে আর আগের মত এক্সপেকটেশন রাখে না। সে নিজের ক্যারিয়ার, সন্তান এবং সংসারের মাঝেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আপনার একমাত্র সঙ্গী এখন আপনার স্ত্রী। তখনও হয়ত আপনার স্ত্রী আপনাকে সময় দিবে, আপনার সেবাও করবে, কিন্তু সেটা ভালোবাসা নয়। সেটা শুধুই মায়া, হয়তবা কিছুটা দায়বদ্ধতা।

নিশ্চই আমরা কেউই সেই দিন দেখতে চাইনা। আর সেই দিন দেখতে না চাইলে, আপনের চেয়েও যে আপন, হৃদয়ের চেয়েও যে কাছের, জীবন মরণের যে সঙ্গী, তাকে আপন করে রাখুন, তার আপন হয়ে থাকুন। জীবনের যে কোন পরিস্থিতিতে তাকে কাছে রাখুন, তার কাছে থাকুন। যেকোনো বিষয়ে তাকে গুরুত্ব দিন, তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকুন। খুটিনাটি থেকে বড় বড় সকল বিষয় তার সাথে শেয়ার করুন, তার সকল বিষয়ে আগ্রহ দেখান।

আজকে আপনি হয়ত আপনার বাবা-মায়ের, সন্তানদের, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের, কিংবা আপনার স্ত্রীর ভালো থাকার জন্যই এত পরিশ্রম করেন, বাইরের সবার সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে চান। কিন্তু বিশ্বাস করেন, আপনি যদি তাকে ভালো রাখেন, তার একটু খোজ নেন, তার জন্য একটু সময় রাখেন, তার কাছে সবকিছু শেয়ার করেন, তার সাথে মিথ্যা না বলেন, তাকে অগ্রাধিকার দেন, তাকে অবমূল্যায়ন না করেন, তাকে বোঝার চেষ্টা করেন, আপনার, আপনার বাবা-মায়ের, সন্তানদের, আপনার সংসারের সকল দায়িত্ব সে হাসিমুখে পালন করবে। আপনি সব ভুলে গেলেও কোন ক্ষতি হবেনা। দেখবেন সব ঠিকঠাক চলছে। আপনাকে খুশি করার জন্য, আপনাকে একটু যত্ন করার জন্য, আপনার সেবা করার জন্য, তার যে পরিমাণ প্রচেষ্টা থাকে, তার দশভাগের এক ভাগও যদি আপনি তার জন্য দেখান, দেখবেন আপনি এবং আপনার স্ত্রী দু’জনেই এগিয়ে যাচ্ছেন। আপনাদের রয়েছে একটি ঈর্ষনীয় সুখের সংসার।

চ্যালেঞ্জ করে বলছি, সুখী হবার জন্য উপরে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য, নিচে পিতামাতার দোয়া, আর পাশে এই একটি মানুষই যথেষ্ট।

প্রতিজ্ঞা করে বলছি, এই লেখা যদি আপনার মধ্যে পরিবর্তন আনে, আপনি ঠকবেন না।

ভালো থাকুক ভালোবাসার প্রজাপতিরা…

 

লেখকঃ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, একজন সচেতন হাসবেন্ড ।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here