নূসরাত ইমা :: ১৪ ফেব্রুয়ারি। আমি বলে না দিলেও সবাই জানেন এই দিনটা হল ভালোবাসার দিন। বিশ্বে যতগুলো দিবস রয়েছে তার মাঝে সম্ভবত সবচে জনপ্রিয় দিবস এটি । প্রতিবারের মত ২০১৫ সালের আজকের দিনটি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। কিন্তু এবার বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসে, বাতাসে ভালোবাসার বার্তার চেয়ে শোক বার্তাই বেশি ভাসছে। এই শোকের কারন আর কিছুই নয় আমাদের দুই নেত্রী, একে অন্যের প্রতি এবং দেশের প্রতি চরম ভালোবাসার প্রকাশ!
আমরা সাধারন জনতা তাই আমাদের ভালোবাসার প্রকাশও সাধারন। আমরা যখন প্রিয় কোন বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করি তখন হয়তো কিছু উপহার দেই। যখন অভিমান করি রাগ করি তখন হয়ত ভালোবাসার বন্ধুটির সাথে কথা বলি না। মুঠোফোন বন্ধ করে রাখি ।
কিন্তু আমাদের দুই নেত্রি তো সাধারন নন। তাদের একে অন্যের প্রতি এবং দেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। তারা একটা সময় প্রিয় বন্ধুর মত রাজপথে সংগ্রাম করেছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। তাই তারা যখন একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেন তখন এই দেশের মানুষ আশায় বুক বাঁধে!
কিন্তু দুর্ভাগা দেশের দুর্ভাগা মানুষ আমরা। ৯০ এর দশকের পর থেকে আমরা এই দুজন সাবেক বন্ধুকে তাদের একে অন্যের প্রতি অভিমানের প্রকাশই শুধু দেখতে পাচ্ছি। অভিমান যেহেতু ভালোবাসা প্রকাশেরই একটি রূপ তাই ধরে নিলাম তাদের মাঝে ভালোবাসা এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। তাছাড়া প্রতি মুহূর্তে দেশের প্রতি তাদের অগাধ ভালোবাসার প্রকাশ করছেন।
তো গত ৬ জানুয়ারি থেকে দেশে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে আমাদের দুই নেত্রি কি ভাবে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরার চেষ্টা করছি ।
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত গত ৩৮ দিনে এই দুই নেত্রির (একজন জননেত্রি, অন্যজন দেশনেত্রি) দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের বলি ৮৭ জন। এর মাঝে পেট্রোল বোমা ও আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন ৫২ জন। নানা সংঘর্ষে নিহত ১৩ জন। ক্রস্ফায়ারে নিহত ১৯ জন। সংখ্যা টি গনমাধ্যম থেকে পাওয়া। মূল সংখ্যা আরও বেশিও হতে পারে।
এক নেত্রির একটু অভিমান হয়েছে তাই তিনি সারা দেশ অচল করে অবরোধ দিলেন তাতেও মন ভরলো না এইবার তিনি হরতাল দিতে শুরু করলেন। দেশের মানুষের প্রতি তার ভালবাসার প্রকাশ হিসেবে রেল পথে নাসকতার ঘটনা ঘটেছে ১১ বার। ১১৭০ টি যানবাহনে আগুন দেয়া ও ভাংচুর করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিট এ ভর্তি হয়েছে ১২৩ জন।
এর মাঝে দেশনেত্রির পুত্রবিয়োগ হল। এই দুঃখজনক ঘটনায় জননেত্রি তাকে সান্তনা দিতে চাইলেন। গেলেন তার ভালোবাসার প্রকাশ করতে কিন্তু হায় এই শোকের দিনে তার বাড়িতে উপস্থিত সবাই দরজা খুলতেই ভুলে গেলেন। তাই জননেত্রি ভগ্ন হৃদয়ে দরজা থেকে ফিরে এলেন। ভগ্ন হৃদয় হলেও কিন্তু তিনি ভালোবাসার প্রকাশ করতে ভুল্লেন না। কঠোর ভাবে দেশ রক্ষার নির্দেশ দিলেন। দেশে গন হারে ধর পাকোর শুরু হল। ফলাফল স্বরূপ ৩৭ দিনে দেশে গ্রেফতার ১৩,৭০০ মানুষ। যে বাড়ির দরজা থেকে নেত্রি ফিরে এলেন কিছুদিন পর সে বাড়ির পানি, বিদ্যুৎ, টেলিফোন ইত্যাদির ব্যাবস্থা বন্ধ হয়ে গেল।
এইভাবে দিনের পর দিন আমাদের দুই নেত্রি কখনো দেশের প্রতি কখনো একে অপরের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেই যাচ্ছেন। তাদের ভালোবাসার এহেন প্রকাশে এই দেশের মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এসএসসি পরিক্ষার অনেগুলো বিষয় স্থগিত করা হয়েছে। এই ছেলে মেয়ে গুলোর শিক্ষা জীবন পড়েছে চরম অনিশ্চয়তার মাঝে। তাতে কারু ভ্রুক্ষেপ নেই।
আমাদের নেত্রিরা কেউ হাসপাতালে গিয়ে চোখের জল ফেলছেন, তো কেউ বলছেন সরকারই সব কিছুর জন্য দায়ি। কিন্তু তারা কেউই আলোচনায় বসার ব্যপারে একমত হন না। কেউ বলেন খুনির সাথে আলোচনা নয়, তো কেউ বলেন গনতন্ত্রের জন্য এসব করছি। আদতে কেউই দেশের বা মানুষের স্বার্থে করছেন না কিছুই। যা কিছু ঘটছে যা কিছু আমরা সাধারণ মানুষ ভুগছি তার সবই আপনারা নিজেদের স্বার্থে করছেন, না এই দেশের প্রতি আপনাদের ভালোবাসা আছে না এই দেশের মানুষের প্রতি?
প্রতিবারের মত এইবারও ১৪ ফেব্রুয়ারি আসেছে। কিন্তু যে মানুষ গুলো বার্ন ইউনিটে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, যে মানুষ গুলো দগ্ধ হয়ে, সহিংসতায় অথবা ক্রস্ফয়ারে মারা গেছে তাদের প্রিয়জনের কাছে কি মূল্য আছে এই ভালোবাসা দিবসের? আজকে যদি এই দুই নেত্রি সত্যিই এই দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে এক টেবিলে আলোচনায় বসতেন। যতি তাদের নিজেদের মাঝে ভালোবাসা আর সম্মানের সম্পর্ক তৈরি করতেন তাহলে এই দেশের মানুষের মাঝে ভালোবাসার অভাব হতোনা!
আমরা বাঙালি, বাংলাদেশের মানুষ। আমরা ভালোবাসতে ভয় পাইনা। একটু ভালোবাসা পেলে আমরা জীবন দিতে রাজি। আমরা আমদের দেশটা কে বড্ড বেশি ভালোবাসি। এই দেশের মানুষ যে দেশের জন্য মরতে পারে তার প্রমাণ বারবার দিয়েছে। প্রিয়জনরা বার-বার মরবে দেশকে ভালোবেসে কিন্তু এ ভাবে অকারণে আর নয়। এভাবে অসহায় মানুষের মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না।
আপনারা দুইজনই আমাদের নেত্রি। আপনাদের হাত ধরেই এই দেশ এগুবে। আপনারা শুধু নিজেদের মাঝে ভালোবাসার সেতু বন্ধন তৈরি করুন। আপনাদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা আর সমর্থনের ঘাতটি হবে না। আমাদের দুই নেত্রি নিজেদের মাঝে ভালোবাসার সেতু তৈরি করবেন আজকের ভালোবাসা দিবসে এই প্রত্যাশা করছি।
লেখক: haider_nusrat@yahoo.com