রুজি-রোজগারের তাগিদে সমাজের নীচুতলার মেয়েদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হয়৷ কিন্তু নানা সামাজিক শোষণের শিকার হতে হয় তাঁদের৷ স্বাস্থ্য, বাসস্থান এবং যৌন নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এঁদের দিকে নজর দেয়া হয় না একদমই৷

ভারতে অভ্যন্তরীণ মাইগ্রেশনকে সামাজিক সমস্যার অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে জাতিসংঘ প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে৷ তাতে বলা হয়, ভারতে এই সমস্যার দিকে নাকি আদৌ নজর দেয়া হয়নি, হয়ও না৷ গত সপ্তাহে প্রকাশিত ঐ রিপোর্টে বলা হয় যে, লিঙ্গভেদে অভ্যন্তরীণ স্থানান্তরণ এক জরুরি সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে৷ সমাজের নীচুতলার নারীরা বাইরে থেকে শহরে আসেন এবং অন্যের বাড়িতে কাজের মেয়ে বা ছোট বাচ্চার দেখভাল করা, যাকে বলে ‘বেবিসিটার’ হিসেবে নিযুক্ত হন৷ এই মেয়েরা সামজিক দিক থেকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর শ্রেণি৷ তাই ভারতে অভ্যন্তরীণ মাইগ্রেশনকে সামাজিক সমস্যার অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয় জাতিসংঘের রিপোর্টে৷

দুর্ভাগ্যের বিষয়, সমাজের নীচুতলার মেয়েদের অন্যত্র যেতে হয় রোজগারের তাগিদে৷ কিন্তু তাঁদের রোজগার আয় হিসেবে ধরা হয় না, যেহেতু তাঁদের কাজ ঘরোয়া বা পেশাগত নয়৷ পুরুষদের সঙ্গে তাঁদের আয়ে থাকে বৈষম্য৷ নিয়মিত কাজে তাঁদের নেয়া হয় কম৷ নিলেও পুরুষদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম বেতনে৷ তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্ব-নিযুক্ত৷ শুধু বেতনই নয়, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকেও তাঁরা বঞ্চিত থেকে যান৷ যেমন তাঁদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই, কর্মস্থলে শিশুকে মাতৃস্তন্য পান করানোর সময় দেয়া হয় না, এমনকি ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলতেও কিছু থাকে না তাঁদের৷

বঞ্চনা আর অবহেলার তালিকা অবশ্য এখানেই শেষ নয়৷ যে পরিবেশে বহিরাগত মেয়েদের কাজ করতে হয়, তা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর৷ ফলে গুরুতর শারিরিক অসুস্থতার সহজ শিকার হন তাঁরা৷ কিন্তু মেয়ে বলে নীরবে তা তাঁরা মেনে নেন৷ প্রতিবাদ করার সাহস পান না৷

যৌন নির্যাতন আরেকটি ইস্যু৷ এর সঙ্গেও তাঁদের আপোষ করতে হয়৷ যারা কাজ দেয় বা কাজ দেওযার জন্য নিয়ে আসে, সেইসব দালাল বা এজেন্টদের হাতেই তাঁদের ধর্ষিতা হতে হয়৷ শিকার হতে হয় যৌন শোষণের৷ বাড়ির মালিক বা পুরুষ সদস্যরাও এ থেকে মুক্ত নয়৷ দারিদ্রের চাপে এই মেয়েদের অনেককেই যেতে হয় দেহ-ব্যবসার পথে৷

অনেকেই মনে করেন, দেশের অন্য জায়গা থেকে আসা এই সব গরিব মেয়েরা শহরের ওপর এক বোঝাবিশেষ৷ কিন্তু তা ঠিক নয়৷ নতুন এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, যাকে বলে জিডিপি, তাতে এঁদের অবদান অনস্বীকার্য৷

সস্তায় শ্রম কেনা যায় এঁদেরই কাছ থেকে৷ যেমন ম্যানুফ্যাকচারিং বা পরিষেবা ক্ষেত্রে এমন অনেক কাজ করানো হয় বহিরাগতদের দিয়ে, যেটা শহরের মানুষ করতে চায় না বা করে না৷ এখানেই শেষ নয়৷ শহরের জঞ্জাল অপসারণ বা নানা ধরণের বিপজ্জনক কাজও করিয়ে নেয়া হয় বহিরাগত শ্রমিকদের দিয়ে৷ সেখানে সংবিধানে বর্ণিত স্বাধীনতা বা মর্যাদা তাঁদের কাছে এক অশ্রুত শব্দবন্ধ৷

নীতি নির্ধারক বা শহর পরিকল্পনাকারীরা এই সব বহিরাগত পুরুষ ও মহিলা শ্রমজীবীদের দেখে নেতিবাচক দৃষ্টিতে৷ ভারতে অভ্যন্তরীণ বহিরাগত শ্রমশক্তি শহরের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ৷ আর এটা বেড়েই চলেছে৷ এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন অ্যামেরিকাতে এই সংখ্যা শহরের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ৷ ভারতে এই হার সব থেকে বেশি৷ গুজরাটের সুরাট শহরে ৫৮ শতাংশ, দিল্লি ও মুম্বই মহানগরিতে কাজ করছেন ৪৩ শতাংশ বহিরাগত শ্রমিক৷

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here