ইশরাত ইভা
লেখক: ইশরাত ইভা

ইশরাত ইভা :: বাংলাদেশ থেকে শিশু ও নারী পাচার দীর্ঘ কয়েক যুগ যাবৎ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই একই রকম চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশি নারীদের ভারতে পাচারের সংখ্যা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। গত সাড়ে পাঁচ বছরে বিভিন্ন দেশ থেকে, ফেরত আনা হয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার নারী ও শিশুকে। যাদের সিংহভাগকে বিক্রি করা হয়েছিল, ভারতের বিভিন্ন যৌনপল্লীতে। এই মানবপাচরের সবচেয়ে বড় পথ হয়ে উঠেছে, যশোরের বেনাপোল সীমান্ত। অভিযোগ আছে, পাচারকারী চক্রের সাথে, স্থানীয় প্রভাবশালীদের পাশাপাশি জড়িত দুদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। ভারতের মুম্বাইয়ের এই নিষিদ্ধ পল্লির কুৎসিত কোলাহলে ঢাকা পড়ে আছে শত শত নারীর স্বপ্ন ভঙ্গের আর্তনাদ। সেই সব নারী যাদের এখানে বিক্রি করে দিয়েছে পাচারকারীরা।

শুনে কষ্ট লাগলেও, এটা সত্য ভারতের এমন অনেক পাতিতালয় থেকে নিয়মিতই উদ্ধার হচ্ছেন বাংলাদেশি মেয়েরো। ভাল চাকরির লোভ দেখিয়ে, তাদের পাচার করা হয়েছিল। মূলত গরীব ও পারিবারিক অশান্তিতে থাকা কম বয়সী মেয়েদের টার্গেট করে পাচারকারীরা। ‘বেশিরভাগ নারীদের আনা হচ্ছে ডেডলাইন এরিয়া থেকে। গোয়া থেকে শুরু করে এমন কোন জায়গা নেই যে বাংলাদেশি নারী না পাওয়া যায়’।  ভারতে মানব পাচরের সবচেয় বড় পথ, যশোরের বেনাপোল সীমান্ত। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মেয়েদের এনে এই রুটে পাচার করা হয়।

বেনাপোলের একজন পাচারকারী, পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে পাচারে সহায়তা করে সীমান্তরক্ষী বাহিনী। আর পাচারকারীদের সাথে যোগসাজশ আছে, রাজনৈতিক নেতাদেরও। ভারতের পাবলিক বিএসএফ নিয়ন্ত্রণ করে। ওরা বাংলাদেশে টেলিফোন করে বলে দেয় এখন পার করে দেন বিএসএফ কিছু বলবে না’।  স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, গত সাড়ে পাঁচ বছরে ভারতে উদ্ধার পাওয়া সাড়ে ৬ হাজার মেয়েকে প্রত্যাবাসন করা হয়েছে। ভারতের অধিকার কর্মীরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে নারী পাচার দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে উদ্ধার পাওয়া অধিকাংশ মেয়েই দেশে ফিরে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন না। কেউ কেউ মামলা করলেও, নানা জটিলতায় বিচার পান না। উদ্ধার পেলেও, মুক্তি মেলেনা।

নারী ও শিশু পাচার আদৌ বন্ধ হবেভয়াবহ স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায় তাদের প্রতিনিয়ত। সহজভাবে তাদের কাউকেই মেনে নেয় না সমাজ। এমনই একজন নারী যে কিনা পরিবারে সচ্ছলতা ও স্বপ্ন পূরণের জন্য বিদেশে পাড়ি জমান। কিন্তু সেটি আর বাস্তবে রূপ নেয়নি। দালালের খপ্পরে পড়ে পাচারকারী চক্রের হাতে পড়ার পর তাকে হত্যা করা হয়। খুলনা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে বরুনা গ্রাম। এই গ্রামেরই হতভাগ্য এক নারী তিনি। গত ১৭ জুন ভোরে বাবার বাড়িতেই তার কফিনবন্দি লাশ আসে। তার বিয়ে হয়েছিল। ১১ বছরের সংসার জীবনে তাদের দুটি ছেলে সন্তানও আছে। স্বামী এলাকায় রিকশা চালান, মাঝে মধ্যে দিনমজুরির কাজ করেন। আয়ের নিশ্চয়তা ছিল না। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মাঝেমধ্যে ঝগড়া হতো। কখনো কখনো শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকা আনার জন্য চাপ দিতেন স্বামী।

এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিবেশী নন্দনপুর গ্রামের ফজলে হওলাদারের স্ত্রী নাসিমা বেগম বিদেশে যাওয়ার লোভ দেখান তাকে। বলেন, বিদেশে গেলে অনেক টাকা। তার মেয়ের জামাই ফুলতলা উপজেলার বাসিন্দা জাকারিয়া বিদেশে লোক পাঠায়। নানা প্রলোভনের পর বিদেশে যেতে রাজি হন এই নারী। ৭০ হাজার টাকা দালালদের দিয়ে মাসিক ১৫ হাজার টাকা বেতনে জর্দানে যাওয়ার ব্যাপারে চুক্তি হয় নাসিমার মেয়ের জামাই জাকারিয়ার সঙ্গে। পাসপোর্ট ও ভিসা করে দেন তার বাবা-মা। গত ১৫ এপ্রিল ঢাকা বিমানবন্দরে স্ত্রীকে বিদায় দেন স্বামী। কিন্তু বিধিবাম। বাংলাদেশের সহজ সরল নারী বন্দি হন অচেনা এক অন্ধকার জগতে।

স্বজনরা জানান, মোবাইল ফোনে স্বামী, বোন ও বাবা-মায়ের সর্বশেষ কথায় ছিল বাঁচার আকুতি। তিনি কাঁদছিলেন আর বলেছিলেন, ‘আমি আর পারছি না। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও।’ এরপর ৮ জুন জর্দানের বাংলাদেশি দূতাবাস থেকে স্বজনদের জানানো হয় এই নারীর মরদেহ পাওয়া গেছে। সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোনের কললিস্ট পরীক্ষা করে ফোন করেছে দূতাবাস। তবে কীভাবে তিনি মারা গেছেন তা রহস্যে ঘেরা রয়ে গেছে আজও। হয়তো এর থেকে আরো করুন পরিস্থিতি হয় বা হচ্ছে অন্যান্য পাচার হওয়া নারীদের সাথে। তা হয়তো আমরা কোনদিন জানতেও পারবো না।

নারী ও শিশু পাচার আদৌ বন্ধ হবেএভাবে প্রতি বছর এই নারীর মতোই বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৫ হাজার নারী ও শিশু অবৈধভাবে পাচার হয়ে যাচ্ছে। পাচারের শিকার হয়ে বাংলাদেশের ভাগ্য বিড়ম্বিত নারীদের স্থান হয় বিদেশের যৌনপল্লীর অন্ধকার জগতে। একই সঙ্গে শিশুদের সুন্দর শৈশবের আনন্দ মিলিয়ে যায় দুঃস্বপ্নে। মরুভূমিতে উটের জকি হিসেবে ব্যবহার করা হয় শিশুদের। নির্মমভাবে হত্যার পর বিক্রি করা হয় শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। চড়া দামে বিক্রি করে দেওয়া হয় নিঃসন্তান দম্পতিদের কাছে। পাচারকৃত নারী ও শিশুদের জীবনে বয়ে আনে দুঃসহ বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। বিয়ে, চাকরি আর মোটা অঙ্কের বেতনের প্রলোভনে পড়ে বাংলাদেশের নারী ও শিশুরা বিদেশে অমানবিক জীবনযাপন করছে।

তবে পুলিশের দাবি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা পদক্ষেপে মানবপাচার কমতে শুরু করেছে। পাচারের সংখ্যা নিয়ে সরকারি তথ্য আর এ বিষয়ে কর্মরত বেসরকারি সংস্থাগুলোর তথ্যের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সরকারিভাবে প্রতি বছর নারী ও শিশু পাচারের যে সংখ্যা স্বীকার করা হচ্ছে আসলে পাচারের প্রকৃত সংখ্যা তার প্রায় পাঁচগুণ বেশি বলে তথ্য দিচ্ছে এ বিষয়ে কর্মরত বেসরকারি সংস্থাগুলো।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাকিস্তান, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যে পাচারের ৬০ ভাগেরও বেশি কিশোরী। এদের বয়স ১২ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশ হতে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার নারী ও শিশু দালালের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হচ্ছে। এদের মধ্যে ছেলেশিশুর সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার আর মেয়েশিশু প্রায় ১৩ হাজার। ২০০১ সালের ৪ জুন গ্লোবাল নিউজের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে প্রায় ২ লাখ নারীশিশু বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে। ফ্রান্সের একটি দৈনিকের ২০০৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ২০ হাজার নারী ও শিশু পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়।

এছাড়া টাইমস অব ইন্ডিয়ার ২০০৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছর ৫০ হাজার নারী ও শিশু বাংলাদেশ থেকে ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়। পাচারকারীরা দেশের ১৮টি স্থান দিয়ে নারী ও শিশু পাচার করে থাকে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য আছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ৪ হাজার ২২২ কিলোমিটার এবং মিয়ানমারের ২৮৮ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা রয়েছে। পাচারকারীরা ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত ব্যবহার করে পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে নারীদের পাচার করে।

বাংলাদেশ হতে ভারতে যাওয়ার জন্য যশোরের বেনাপোল অত্যন্ত সহজ রুট। বেনাপোল থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁও শহর। বাস ও ট্রেনে পাচারকারীরা খুব সহজেই কলকাতা পৌঁছতে পারে। বৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম আর অবৈধ অনুপ্রবেশের মাধ্যমে পাচারের উদ্দেশ্যে নারী ও শিশুদের প্রথমে ভারতের বনগাঁওয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে পাচারকারীরা সাধারণত ভোমরা, কলারোয়া, দর্শনা, জীবননগর ও ঝাউডাঙ্গা সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে নারী ও শিশু পাচার করে থাকে। দেশে ৯০ শতাংশ নারী ও শিশু বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়। কলকাতার সঙ্গে সহজ যোগাযোগই এ রুট ব্যবহারের প্রধান কারণ। বর্তমানে দেশের উত্তর সীমান্ত সোনামসজিদ স্থলবন্দর ও গোদাগাড়ি দিয়ে নারী এবং শিশু পাচারের সংখ্যা বেড়েছে। রংপুর, পঞ্চগড়, কুমিল্লা, দিনাজপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, সিলেট সীমান্তপথ দিয়ে নারী পাচার বেশি হচ্ছে। ওই অঞ্চলের সীমান্ত এলাকার ১১টি রুট নারী ও শিশু পাচারের জন্য ব্যবহ্নত হয়।

নারী ও শিশু পাচার আদৌ বন্ধ হবেসম্প্রতি টেকনাফ অঞ্চলের রোহিঙ্গা শরণার্থী নারী ও শিশু এবং পার্বত্যাঞ্চলের উপজাতীয় নারী ছাড়াও সিডর ও আইলা আক্রান্ত এলাকা পাচারকারীদের অন্যতম টার্গেটে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে সাধারণত স্থলপথই ব্যবহৃত হয়। এছাড়া জল ও আকাশপথও পাচারের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। মানবপাচার নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে, ১৯৯০ সাল হতে গত ২০ বছরে শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই বাংলাদেশের প্রায় দুই লাখের বেশি নারী ও শিশু পাচার হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ পাচার হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তানে। শুধুমাত্র পাকিস্তানের বিভিন্ন যৌনপল্লীতে কমপক্ষে দুই লাখ বাংলাদেশি মেয়ে কাজ করে।

এছাড়াও বাহরাইন, সৌদি আরব, লেবানন, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াসহ বিশ্বের নানা দেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের নারীরা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশি নারীদের ধনী ব্যক্তির রক্ষিতা, যৌন দাসী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ নিয়ে ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনও অস্বস্তিতে রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায়, পাচারের শিকার একজন নারী পরবর্তী সময়ে দেশে ফিরে এসে পাচারকারীচক্রের সঙ্গে মিলে অন্য নারীদের পাচারে সাহায্য করছে। এমনকি অনুমোদনহীন কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির দালালরাও মধ্যপাচ্যে ভালো কাজ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে নারী পাচার করছে।

সাধারণত অভ্যন্তরীণ, বহির্গমন ও আন্তঃসীমান্ত পদ্ধতিতে নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে পাচারকারীরা আত্মীয় সেজে পাচারে অংশ নেয়। বাংলাদেশ থেকে তাদের ভারত, লেবানন, দুবাই, মধ্যপাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করা হচ্ছে। দেশে পাচার নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলো জানায়, আগের তুলনায় পাচারের মামলা ও অভিযোগ বেশি পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ পাচারের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, পাচারকৃত শিশু-কিশোরদের শতকরা ৯০ জনকেই জোরপূর্বক দেহব্যবসায় নামানো হচ্ছে এবং পাচার হওয়াদের ১৩.৮ শতাংশই কলকাতার পতিতালয়ে রয়েছে।

 

 

লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক খুলনার কন্ঠ ও খুলনা প্রতিনিধি, দৈনিক ভোরের কলাম

ইমেইল: Skeva70@gmail.com

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here