ভবিষ্যতে এ দেশে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হবে অনলাইনষ্টাফ রিপোর্টার :: বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি দু’ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ই সংখ্যায় বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। তবু কাঙ্ক্ষিত উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন না বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও জায়গা দিতে পারছে না।
গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান বলছে, উচ্চশিক্ষা স্তরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ফি বছর বাড়ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে অদূরভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষার জন্য বিকল্প ভাবতে হবে বিশাল জনগোষ্ঠীর ছোট্ট বাংলাদেশকে।

বিশ্বখ্যাত ইংরেজি পত্রিকা ইকোনমিস্ট-এর ইন্টেলিজেন্স ইউনিট চলতি বছরের শুরুতে ব্রিটিশ কাউন্সিলের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ মডেল নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় উচ্চশিক্ষার প্রতি যেভাবে আগ্রহ বাড়ছে, তাতে এখানে উচ্চশিক্ষার নতুন মডেল নিয়ে ভাবতে হবে। সেটা হতে পারে অনলাইনে উচ্চশিক্ষা।

অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান মনে করেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি হতে আরো সময় লাগবে। এজন্য সরকারি নীতি দরকার। তা ছাড়া কারিগরি সক্ষমতা আছে কি না_ তাও দেখা দরকার। তিনি বলেন, একটি গবেষণা বলছে, আগামী ২০-২৫ বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৪০০ বিশ্ববিদ্যালয় দরকার হবে। কিন্তু সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। সেটা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। সরকার একা সব করতে পারবে না। বেসরকারি উদ্যোগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি এটাও ভাবতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় মানে শুধু দালানকোঠা নয়। জ্ঞান সৃষ্টি, ধারণ ও বিতরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
তবে ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য অনলাইন সত্যিকার অর্থেই একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। সরকারকে এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেয়া এবং তা মাথায় রেখে এখন থেকে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
এরই মধ্যে অনলাইনে উচ্চশিক্ষা বিশ্বকে নাড়া দিতে শুরু করেছে, যা পরিচিতি পেয়েছে ‘ম্যাসিভ ওপেন অনলাইন কোর্সেস (মুকস)’ নামে। হয়তো বাংলাদেশেও ভবিষ্যতের উচ্চশিক্ষা হবে কাঠামোগত বিশ্ববিদ্যালয় আর অনলাইন_ এই দুয়ের সমন্বয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) হিসেবে, ২০০৪ সালে দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ১৯টি। শিক্ষার্থী ছিলেন এক লাখ ১২ হাজার ৩২৭ জন। ১০ বছরের মাথায় ২০১৩ সালে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪টিতে। আর শিক্ষার্থী ২০ লাখ ২০ হাজার ৫৪৯।
এই ১০ বছরের মধ্যে দুই বছর বাদে প্রতিবছরই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। এখানে জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ/মাদ্রাসার শিক্ষার্থীও হিসাবে ধরা হয়েছে। এগুলো বাদে সরকারি ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা ২০১৩ সালে ছিল দুই লাখ ১০ হাজার ৬০২ জন।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেড়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
সেখানেও প্রতিবছর বাড়ছে শিক্ষার্থী। ইউজিসি পৃষ্ঠা ১৫ কলাম ৪ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬ সালে ৫১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছিলেন এক লাখ ২৪ হাজার ২৬৭ জন। ২০১৩ সালে ৬৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ছিলেন তিন লাখ ২৮ হাজার ৭৩৬ জন। এখানে প্রতিবছরই শিক্ষার্থীর সংখ্যা শতকরা হারে বেড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থী দুটোই যেমন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, একই সঙ্গে আবার একটি বড় অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। কারণ প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের আসনসংখ্যার চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক পাস করছেন। বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড স্টাটিস্টিকসের (ব্যানবেইস) হিসাবে ২০১৩ সালের হিসাবে ৩২টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাতীয় ও উন্মুক্ত বাদে) প্রথম বর্ষে ভর্তির জন্য নির্ধারিত আসন আছে ৫৭ হাজার ১৬২টি।
আর ৬৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতক সম্মান প্রথম বর্ষে আসনসংখ্যা ছিল এক লাখ ৪৫ হাজার ২৫টি। অর্থাৎ জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বাদে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে আসন ছিল দুই লাখ দুই হাজার ১৮৭টি। আর ২০১৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিকের চৌকাঠ পেরিয়েছিলেন পাঁচ লাখ ৭৯ হাজার ২৯৭ জন। এর বাইরে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড থেকে পাস করেছিলেন আরো ৮০ হাজার শিক্ষার্থী। ২০১৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ছয় লাখ ৯২ হাজার ৬৯০ জন।
২০০৪ থেকে ২০১৩ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, উচ্চ মাধ্যমিকে পাসের হার ১০ বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০০৯ সাল বাদে প্রতিবছরই পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে।
বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোয়ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থী বাড়ছে দ্রুততার সঙ্গে। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন বলছে, ২০০০ সালে সারাবিশ্বে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় ছিলেন তার ১২ দশমিক ১৫ শতাংশ ছিল এই অঞ্চলের। ২০৩০ সাল নাগাদ এ হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু যে হারে এই অঞ্চলে শিক্ষার্থী বাড়ছে, সে হারে উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র বাড়ানো যাচ্ছে না।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের জায়গা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এ সুযোগে বাড়ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলোর শিক্ষার মান নিয়ে সংশয় আছে।
দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ‘এ’ লেভেল বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের আসনের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। আফগানিস্তানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আসনের বিপরীতে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী প্রায় চারজন। বাংলাদেশ ও শ্রীলংকায় প্রায় পাঁচজন করে। নেপালে দুজনের বেশি। আর ভারত-পাকিস্তানে একজনের বেশি। ইকোনমিস্ট বলছে, এই অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে উচ্চশিক্ষার জন্য নতুন নতুন ধারণার প্রতি ঝুঁকতে হবে। এর একটি হলো অনলাইনে উচ্চশিক্ষা বা ‘ম্যাসিভ ওপেন অনলাইন কোর্সেস (মুকস)।’
ইতোমধ্যে এ অঞ্চলে নতুন এই পদ্ধতি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে, বিশেষ করে ভারতে। বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন কোর্স হার্ভার্ডএক্স তার প্রমাণ। এই কোর্সে সারাবিশ্ব থেকে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী আছেন, তার আট শতাংশের বেশি ভারতের। ভারতের মতো না হলেও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর শিক্ষার্থীরাও কোর্সটিতে আছেন। বাংলাদেশের শিক্ষার্থী আছেন মোট শিক্ষার্থীর দশমিক তিন শতাংশ, পাকিস্তানি আছেন এক শতাংশ, নেপালের শিক্ষার্থী দশমিক দুই এবং শ্রীলংকার শিক্ষার্থী আছেন দশমিক এক শতাংশ।
বিশ্বে অনলাইনে উচ্চশিক্ষা সবচেয়ে বেশি প্রসারিত হচ্ছে এশিয়ায়। এ অঞ্চলে অনলাইনে উচ্চশিক্ষা বৃদ্ধির হার ১৭ শতাংশের বেশি। ই-লার্নিং বেশি এমন ১০টি দেশের সাতটি এশিয়ার। নেপাল ও পাকিস্তানে ২০১৩ সালে এ হার ছিল ৩০ শতাংশের ওপরে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য অনলাইন সত্যিকারভাবেই একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌতকাঠামো দুর্বল। হলগুলোয় হানাহানি, রাস্তায় যানজট। এসব হয়তো সামনে আরো বাড়বে। এক সময় শিক্ষার্থীরা এসব থেকে মুক্তি নেবে। তথ্যপ্রযুক্তি যেভাবে এগোচ্ছে, দেশে সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে যেভাবে কাজ হচ্ছে, ইন্টারনেট সংযোগ সহজলভ্য হচ্ছে, তাতে অনলাইনে উচ্চশিক্ষা কঠিন কিছু হবে না। তা ছাড়া ডিসটেনস লার্নিং বা দূরশিক্ষার ঐতিহ্য বাংলাদেশে আছে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় তা করছে।
মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, প্রথাগত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা অনলাইননির্ভর করা গেলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর চাপ কমবে। গবেষণা বাড়বে। তিনি মনে করেন, উচ্চশিক্ষার প্রধানত দুটি উদ্দেশ্য। একটি হলো জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। আরেকটি হলো আলোকবর্তিকা হওয়া। এমন হতে পারে যারা চাকরি বা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী, তারা অনলাইনে পড়বেন। আর যারা শিক্ষকতা ও গবেষণা এ ধরনের বিষয়ে আগ্রহী, তারা প্রথাগত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন।
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here