ঢাকা: হায় ব্রাজিল, হায় নেইমার-সিলভা, হায় সাম্বার দেশ, হায় ফুটবলের দেশ। বেলো হরিজন্তের সঙ্গে পুরো ফুটবলবিশ্বই এখন ডুকরে কাঁদছে ফুটবলের দেশ ব্রাজিলের জন্য। কারণ মঙ্গলবার রাতে জার্মানদের হাতে যে নিষ্ঠুর বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে স্বাগতিকদের। এস্তাদিও মিনেইরাওতে জার্মানরা যখন ব্রাজিলিয়ান ‘আনাড়ি’ ডিফেন্সের ফাঁক গলিয়ে একটি একটি করে গোল উদযাপন করছিল তখন গ্যালারি যেন ডুকরে কেঁদে উঠছিল, ‘এ কোন ব্রাজিল, এ কেমন ডিফেন্স পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের?’

মঙ্গলবার রাতে বিশ্বকাপের বিংশ আসর থেকে বিদায় ঘটেছে আয়োজক ব্রাজিলের। সেমিফাইনালে জার্মানদের দেওয়া গুনে গুনে ৭টি গোল হজম করে নিজের মাঠের বিশ্বকাপকে অশ্রুসিক্ত চোখে বিদায় জানিয়েছে সেলকাওরা। ম্যাচের শেষ মুহূর্তে একটি মাত্র গোল শোধ করে ব্রাজিলিয়ানদের চোখের জল শুধুই বাড়িয়েছেন অস্কার।

খেলায় জার্মানির পক্ষে প্রথমার্ধে গোল উদযাপন করেন যথাক্রমে প্রথমবার থমাস মুলার (১১ মিনিটে), দ্বিতীয়বার মিরোস্লাভ ক্লোসা (২৩ মিনিটে), তৃতীয় ও চতুর্থবার টনি ক্রস (২৪ ও ২৬ মিনিটে) এবং পঞ্চমবার স্যামি খেদিরা (২৯ মিনিটে)। আর দ্বিতীয়ার্ধে ৬৯ ও ৭৯ মিনিটের মাথায় সেলেকাওদের জালে ষষ্ঠ ও সপ্তমবারের মতো বল পাঠিয়ে এ ব্যবধান আরও নিষ্ঠুরভাবে বাড়ান আন্দ্রে শুরলে।

দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম পর্যন্ত চারটি গোল হয়েছে মাত্র ছয় মিনিটের মধ্যে। এটা যে কোনো ফুটবল ম্যাচের রেকর্ডও বটে। খেলার একেবারে শেষ মুহূর্তে একটি মাত্র গোল শোধ করেন ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার অস্কার।

খেলার প্রথম মিনিটেই জার্মান উইঙ্গার বাস্তিয়ান শোয়ানস্টাইগারকে ছুঁয়ে মাঠের বাইরে যাওয়া বলে কর্নার কিক পায় ব্রাজিল। সে যাত্রায় প্রথম আক্রমণ করে ব্রাজিল। তবে ডি-বক্সের বাইরে থেকে মার্সেলোর বাম পায়ের শটটি ভ্রষ্ট হয়। সেই লক্ষ্যভ্রষ্ট শটটিই যেন ব্রাজিলিয়ানদের সেমিফাইনাল যাত্রা ভ্রষ্ট করে দেয়।

৮ মিনিটের মাথায় মেসুত ওজিলের পাসে ডি-বক্সের মাঝ থেকে স্যামি খেদিরার শট ফিরিয়ে দেয় ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্স।

এরপরই শুরু হয় জার্মানদের গোল উৎসব। মাত্র ২৯ মিনিটের মধ্যেই পাঁচ পাঁচবার গোল উদযাপন করে জার্মানি।

মার্সেলোর পা ছুঁয়ে যাওয়া বলে কর্নার পায় জার্মানরা। সেই কর্নার থেকে টনি ক্রসের কিকে ১১ মিনিটের মাথায় ডি-বক্সের মাঝ থেকে ডান পায়ের শটে ব্রাজিলের জালে বল জড়ান এবারের আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা থমাস মুলার। এ গোল এ আসরের পঞ্চম মুলারের।

২১ মিনিটে স্যামি খেদিরার পাসে ডি-বক্সের বাইরে থেকে ডান পায়ের শটে প্রতিপক্ষের জাল বল জড়ানোর চেষ্টা করেন মিরোস্লাভ ক্লোসা। তবে সেই শট রুখে দেন জুলিও সুজার।

এরপর আবারও ২৩ মিনিটের ‍মাথায় ‍আক্রমণ করে বসেন ক্লোসা। এবার বল পান মুলারের কাছ থেকে। ডি-বক্সের মাঝ থেকে তার ডান পায়ের এই শটও ফিরিয়ে দেন সিজার।

এই শট ফিরিয়ে দিলেও সিজার ও তার দলের ডিফেন্ডারদের সঙ্গে বোঝাপড়ার অভাবে তৃতীয়বার ক্লোসাকে ফেরাতে পারেননি তিনি।

ক্লোসা-ক্রুসরা ব্রাজিলের ডি-বক্সের আশপাশে ঘোরাফেরা করলেও বল সেখানে আনাড়ির মতো পাস খেলতে থাকেন ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডাররা। ব্যস, এই বোকামিকে পুঁজি করে ডি-বক্সের মাঝ থেকেই বল কেড়ে নিয়ে ডান পায়ের শটে জালে জড়িয়ে দেন ক্লোসা। এই গোলের মাধ্যমে বিশ্বকাপের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতার আসনে বসে যান ক্লোসা। ১৬ গোল করে তিনি পেছনে ফেলেছেন ব্রাজিলিয়ান তারকা রোনালদোকে (১৫)।

দুই গোলের পর ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্স যেন ঘোরে পড়ে যায়। ডি-বক্সের আশপাশ থেকে বল ক্লিয়ার করতে হবে সেটাই যেন তারা ভুলে যাচ্ছিলেন।

এই ঘোরে থাকার খেসারতে ২৪, ২৬ ও ২৯ মিনিটেই যথাক্রমে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম গোল হজম করতে হয় সেলেকাওদের।

তৃতীয় গোল উদযাপন করেন টনি ক্রুস। অধিনায়ক ফিলিপ লামের বাড়িয়ে দেওয়া বল ডি-বক্সের মাঝখান থেকে বাম পায়ের শটে সেলেকাওদের জালে জড়িয়ে উল্লাস করতে থাকেন ক্রুস।

২৬ মিনিটের মাথায় আবারও হন্তারক ক্রুস। এবার স্যামি খেদিরার বাড়িয়ে দেওয়া বল ঠিক ডি-বক্সের মাঝ থেকেই ডান পায়ে শট নেন তিনি, সিজার আর তার অনুকূলের ডিফেন্সকে বোকা বানিয়ে বল জড়িয়ে যায় জালে।

তিন মিনিট পর এবার গোল উদযাপনে যোগ দেন স্যামি খেদিরা। মেসুত ওজিলের বাড়িয়ে দেওয়া বল ডি-বক্সের মাঝ থেকে ডান পায়ের শটে সেলেকাওদের জালে জড়িয়ে দেন খেদিরা।

জার্মানির একেকটি গোল যেন কান্নার রোল বাড়িয়ে দিচ্ছিল এস্তাদিও মিনেইরাও স্টেডিয়ামে।

৫-০ গোলে পিছিয়ে থাকা ব্রাজিল যেন এবার ডিফেন্স সামলাতেই ব্যস্ত হয়ে গেল, যেন জার্মানদের গোল উৎসব থামিয়ে লজ্জা এড়াতে হবে। কিন্তু তা আর এড়ানো গেল কই?

৩২ মিনিটে লামের পাসে ক্রুস বল নিয়ে এগিয়ে যেতে চাইলে ডি-বক্সের বাইরে থেকে তা ফিরিয়ে দেয় সেলেকাওদের রক্ষণভাগ।

তারপর খেলায় মিনিট দশেকের মতো ব্রাজিলের এলোমেলো বল পাস দেখা গেলো। গোল উৎসব করে কিছুটা ক্ষ্যান্তি দিতে দেখা গেল জার্মানদেরও।

প্রথমার্ধের শেষের দিকে ৪২ মিনিটের মাথায় ডেভিড লুইজের বাড়িয়ে দেওয়া বল নিয়ে অস্কার ডি-বক্সের বাম পাশ দিয়ে ছুটে যেতে চাইলে তাকে রুখে দেয় জার্মান ডিফেন্স।

ব্যস, এই অর্ধে আর গোল উৎসবের প্রয়োজন মনে করেনি জার্মানি, গোল শোধের চেষ্টা করতে দেখা যায়নি ব্রাজিলকেও, অবশ্য বিধ্বস্ত ব্রাজিল পারেনি বললেও ভুল হবে না।

দ্বিতীয়ার্ধে খেলতে নামলেও আগের অর্ধের ধকল কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছিল না বিবর্ণ সেলেকাওদের। আক্রমণে গিয়েও ভালো শেষ করতে পারছিলেন না অস্কার-রামিরেস-ফ্রেডরা।

৪৭ মিনিটের মাথায় মার্সেলোর পাসে রামিরেস বল নিয়ে এগিয়ে গিয়েও ডি-বক্সের বাম পাশে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন, ব্যর্থ হয় তার সে প্রচেষ্টা।

তবে প্রথমার্ধের মতো দ্বিতীয়ার্ধেও জার্মান ডিফেন্স ও গোলরক্ষক ন্যুয়েরের কাছে হার মেনে থাকতে হয়েছে ব্রাজিলিয়ান আক্রমণভাগকে।

৫১ মিনিটে আবারও সেই রামিরেসকে ডি-বক্সের বাইরে থেকে ফিরে ‍আসতে হয়। এবার বল পেয়েছিলেন ফ্রেডের কাছ থেকে।

এক মিনিট পর রামিরেসের কাছ থেকেই পাওয়া বল ডি-বক্সের ডান পাশ দিয়ে জালে জড়ানোর চেষ্টা করেন উইঙ্গার অস্কার। তবে তা দুর্দান্তভাবে রুখে দেন জার্মান গোলরক্ষক ন্যুয়ের।

৫৩ মিনিটে ডি-বক্স থেকে মার্সেলোর শট ফিরে আসলে একইসময়ে রামিরেসের হেড থেকে পাওয়া বল বাম পায়ের শটে ডি-বক্সের বাম পাশ থেকে জালে জড়ানোর চেষ্টা করেন পলিনহো। কিন্তু ভাগ্য যে জার্মানদের পক্ষে, এই শটটিও আকড়ে নেন ন্যুয়ের।

এই একইসময়ে পলিনহোরই নেওয়‍া আরেকটি শট ব্রাজিলের দুর্ভাগ্যের লক্ষণ স্পষ্ট করে ন্যুয়েরের গ্লাভসে আটকা পড়ে।

খেলায় জার্মানদের মুহুর্মূহু আক্রমণের সময় যেমন ডিফেন্ডার ও অধিনায়ক থিয়েগো সিলভাকে অনুভূত হচ্ছিল, তেমনি এসব ব্যর্থ আক্রমণের সময় পুরো মাঠ আর গ্যালারিজুড়ে যেন ‘নেইমার’শূন্যতা অনুভূত হচ্ছিল।

খেলার ৫৮ মিনিটের মাথায় জোয়াকিম লো তার অন্যতম প্রধান ‘অস্ত্র’ ক্লোসাকে উঠিয়ে আন্দ্রে শুরলেকে উঠিয়ে নেন। কিন্তু কে জানতো এই শুরলেকেই যে ব্রাজিলিয়ানদের কফিনে ষষ্ঠ ও সপ্তম পেরেকটি ঠুকতে নামিয়েছেন লো।

৫৯ মিনিটে ব্রাজিলের ফ্রেডের ডি-বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া বাম পায়ের শট ফিরে এলে ৬১ মিনিটের মাথায় সিজারের হাত ছুঁয়ে যাওয়া বলে কর্নার পায় জার্মানি। এ কর্নার থেকে ক্রুসের নেওয়া কিকে ডি-বক্সের বাইরে থেকে বাম পায়ে শট নেন মুলার। তবে তা আকড়ে নেন সিজার।

মিনিট আটেক পর বদলি শুরলে দলের পক্ষে ষষ্ঠবারের মতো ব্রাজিলের জালে বল জড়ান। লামের পা থেকে পাওয়া বল ডি-বক্সের মাঝ থেকে ডান পায়ে শট নেন শুরলে।

এরপর আবারও ব্রাজিলের অগোছালো আক্রমণে যাবার চেষ্টা। ৭২ মিনিটে উইলিয়ানের লক্ষ্যভ্রষ্ট শটের পর ৭৪ মিনিটে পলিনহোর ডি-বক্সের ডান পাশ থেকে ডান পায়ে নেওয়া শট রুখে দেন ন্যুয়ের।

৭৪ মিনিটের মাথায় খেদিরাকে উঠিয়ে জুলিয়ান ড্রাক্সলারকে নামান লো। ৭৭ মিনিটে লুইজের ফাউলে পাওয়া ফ্রি-কিকে থমাস মুলারের বাড়িয়ে দেওয়া বল ডি-বক্সের বাম পাশ থেকে বাম পায়ের শটে জালে জড়িয়ে নিজের দ্বিতীয় গোল উদযাপন করেন শুরুলে।

নিজেদের ফুটবলের ইতিহাসে ৭-০ গোলে একেবারে নাস্তানাবুদ হয়ে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলাররা যেন পুরোপুরি ঘোরে পড়ে যান, ‍আবারও অগোছালো আক্রমণে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

৮১ মিনিটের মাথায় মার্সেলোর শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও ৮৫ মিনিটের মাথায় রামিরেস গন্তব্যমুখীই শট নেন, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই আটকে দেন জার্মান ‘দেওয়াল’ ন্যুয়ের।

এরপর আরও কয়েকটি এলোমেলো-লক্ষ্যভ্রষ্ট আক্রমণের পর ৯০ মিনিটের মাথায় একমাত্র গোলের দেখা পান অস্কার। মার্সেলোর বাড়িয়ে দেওয়া বল অনেকটা দূর থেকে কাটিয়ে নিয়ে জার্মানদের জালে জড়ান এ উইঙ্গার। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ম্যাচের বিদায়ের সুর উঠে গেছে, বিদায়ের সুর বেজে গেছে ব্রাজিলেরও, পতন হয়েছে সাম্বার ছন্দেও।

খেলায় বল দখলে ছিল সমানে সমান। ব্রাজিল ৫১ শতাংশ বল পায়ে রাখলেও ৪৯ শতাংশ বল পায়ে রেখেই ৭-১ গোলে জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে জার্মানরা।

ম্যাচে একটি মাত্র হলুদ কার্ড হজম করেছেন ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার দান্তে।

এই ম্যাচে জয়ের ফলে জার্মানি উঠে গেল স্বপ্নের ফাইনালে, আগামী ১৩ জুলাই রিওডি জেনিরোতে আর্জেন্টিনা বা নেদারল্যান্ডসের মুখোমুখি হবে তারা। আর স্বপ্নভঙ্গের দুঃখে খুব দ্রুত ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে চাইবেন পাঁচবারের চ্যাম্পিয়নরা।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here