ষ্টাফ রিপোর্টার ::  জামায়াতসহ কয়েকটি ইস্যুতে মতপার্থক্যের মধ্যেই অবশেষে এক মঞ্চে আসলেন যুক্তফ্রন্ট চেয়ারম্যান ও বিকল্পধারা সভাপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যুক্তফ্রন্ট নেতা ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি’র সভাপতি আ স ম আবদুর রব এবং যুক্তফ্রন্ট নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদু্র রহমান মান্না।
কার্যকর গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’র উদ্যোগে গতকাল শনিবার রাজধানীর গুলিস্তানে মহানগর নাট্যমঞ্চে আয়োজিত ‘নাগরিক সমাবেশ’-এ তারা বক্তব্য রাখেন। বক্তারা বললেন, এর মধ্য দিয়ে কার্যত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের যাত্রা শুরু হলো।
ড. কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও ড. আবদুল মঈন খান, ডাকসু’র সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকিও বক্তব্য রাখেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি জয়নাল আবেদীনও বৃহত্তর ঐক্য ও এর দাবিসমূহের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য দেন।
সবার বক্তব্য শেষে এই সমাবেশ থেকে একটি যৌথ ঘোষণা পাঠ করা হয়। এতে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন; নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন করে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এবং তফসিল ঘোষণার আগে বর্তমান সংসদ ভেঙ্গে দিতে সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়।
আগামী ১ অক্টোবর থেকে ঐক্যের নেতারা দেশব্যাপী সভা-সমাবেশে যোগ দেবেন বলেও ঘোষণা দেয়া হয়। এই গণদাবি আদায়ের লক্ষ্যে প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে মুক্তিসংগ্রামের চেতনায় বিশ্বাসী সকল রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি, শ্রেণী-পেশা ও নাগরিক সমাজের সমন্বয়ে ‘বহত্তর জাতীয় ঐক্য’ এর কমিটি গঠন করতে এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধভাবে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ গণজাগরণের কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে দেশবাসীর প্রতি যৌথ ঘোষণায় আহ্বান জানানো হয়।
ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ঘোষণায় দাবি জানিয়ে বলা হয়, ন্যায়বিচারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে অগ্রাহ্য, ব্যাহত ও অকার্যকর করে অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আইনগত ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীসহ সকল রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আনীত মিথ্যা মামলাসমূহ প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির এবং এখন থেকে নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার না করারও দাবি জানানো হয় ঘোষণাপত্রে।
শেখ শহীদুল্লাহ ঘোষণাপত্রটি পাঠ করার পর ড. কামাল হোসেন উপস্থিত সবাইকে হাত তুলে এতে সমর্থন দেয়ার আহ্বান জানান। এসময় ড. কামাল বলেন- ‘পাস, পাস’।
সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক বি. চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ প্রতিবাদি জাতি। এরশাদের মতো স্বৈরশাসক ও পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানকেও এই জাতি বরদাশ্ত করেনি।
সমাবেশ করতে কেন পুলিশের অনুমতি লাগবে? সামনে আমরা সমাবেশ করব, কোনো অনুমতির তোয়াক্কা করব না। তিনি বলেন, আমরা চাই অপশাসন দূর হয়ে যাক। চাই জাতীয় ঐক্য।
চাই গণতন্ত্র ফিরে আসুক। যারা সরকার গঠন করবে তারা শুধু ক্ষমতা দেখাবেন না, দায়িত্ব পালন করবেন- এটা দেখতে চাই। এখানে যারা উপস্থিত রয়েছেন তাদেরও বিষয়টি মন খুলে শুনতে হবে, বুঝতে হবে; অপব্যাখ্যা করবেন না।
আমরা শান্তি-সুখের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চাই। ভবিষ্যতেও যেন আরেকটা স্বৈরশাসক আসতে না পারে সেজন্য ভারসাম্যমূলক রাজনীতি, মন্ত্রিসভা, সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচারবিভাগ দেখতে চাই।
তিনি বলেন, যারা আমার মানচিত্রকে স্বীকার করে না, যারা এখনও রক্তে ভেজা আমাদের জাতীয় পতাকাকে শ্রদ্ধা করে না তারা ছাড়া গণতান্ত্রিক সকল দল ও মানুষের ঐক্য চাই।
সভাপতির বক্তব্যে ড. কামাল হোসেন বলেন, আজকের এই ঐক্যের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ জেগে উঠেছে। গণজাগরণের মধ্য দিয়ে যে শক্তির উদ্ভব হলো সেই শক্তি দিয়ে দেশকে স্বৈরশাসনমুক্ত করে আমরা আইনের শাসন ও আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ নিশ্চিত করব।
তিনি বলেন, জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আছে। এখন দরকার অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনে বিশ্বাসী গণতান্ত্রিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার। আমার বিশ্বাস, এই ঐক্য সফল হবে।
ড. কামাল আরও বলেন, জনগণের ভোটাধিকার, মৌলিক অধিকার, সংবিধান ও আইনের শাসন এবং কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কেউ কেউ এই জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে ক্ষমতায় যাবার ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন। যারা জনগণের ঐক্যকে ভয় পান তারাই ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। এই ধরনের কথা বলার মানে জনগণকে অপমান করা।
সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই সমাবেশের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের পথে আমরা আরেক ধাপ এগিয়ে গেছি। অতিদ্রুত ঐক্যকে আরও দৃঢ় করে আমরা সামনে এগিয়ে যাব। বি. চৌধুরী ও ড. কামালের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আসুন ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করি। খালেদা জিয়াসহ সকল রাজবন্দিকে মুক্তি এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন দিতে সরকারকে বাধ্য করি। খালেদা জিয়া জেলে যাবার আগেও জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে গেছেন। এখন জেল থেকেও তিনি জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য খবর পাঠিয়েছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে এ সরকারের পতন ঘটাতে হবে। অর্থবহ নির্বাচনের দাবিতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, আজকের দিন বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য মাইলফলক। আমরা নতুন যাত্রা শুরু করলাম। পাঁচ দফার ভিত্তিতে আমাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে। এই ঐক্যকে এখন আরও সুসংহত করতে হবে। দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ড. মঈন খান বলেন, দেশের গণতন্ত্র আজ মৃত। আসুন সবাই মিলে বাংলাদেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করি।
আ স ম আবদুর রব বলেন, সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। এই মুহূর্তে দেশে দরকার জাতীয় ঐকমত্যের সরকার। আর কোনো গ্রেপ্তার, গুম, খুন চলবে না। আমরা ন্যায়বিচার ও পরিবর্তন চাই। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, জনগণ অপরাজেয়। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায়ে এই ঐক্য জনগণকে সাহস যোগাবে। মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন,  দেশ আজ গভীর সংকটে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আমাদের সবার দাবি। বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান বলেন,  দেশ ও জনগণ আজ সর্বপ্রকার অধিকারহারা। অধিকার কেউ প্লেটে এনে কাঁটা চামচ দিয়ে দেবে না, আদায় করতে হবে। গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, অবাধ নির্বাচনের দাবিতে সারাদেশের মানুষ ঐক্য হয়ে আছে। গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টু বলেন, ’৫২ ও ’৭১ এর মতো দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বিরোধী দলকে কথা বলতে দিতে হবে। কারও গায়ে হাত দেওয়ার জন্য এই ঐক্য নয়, এই ঐক্য দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন বলেন,  বিচারপতি এস কে সিনহাকে দেশত্যাগে বাধ্য করার পর সরকার খালেদা জিয়াকে জেলে নিয়েছে। সকল রাজবন্দির মুক্তি হবেই। সুলতান মোহাম্মদ মনসুর বলেন,  দলে-দলে কিংবা নেতায়-নেতায় নয়; এই ঐক্য করতে হবে ঘরে-ঘরে, গ্রামে-গ্রামে। জোনায়েদ সাকি বলেন, জাতীয় সনদের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হতে হবে। সমাবেশ পরিচালনা করেন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সদস্য সচিব ড. আ ব ম মোস্তবা আমীন। সমাবেশে অন্যদের মধ্যে ২০ দল শরিক বিজেপি চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ, ২০ দল শরিক জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মহাসচিব মোস্তফা জামাল হায়দার ও প্রেসিডিয়াম সদস্য আহসান হাবীব লিংকন, বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান, ২০ দল শরিক এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here