নাজমুন নাহার ::

আটলান্টিকের সীমানা ছাড়িয়ে সুরিনামের আকাশে যখন বিমানটি পৌঁছালো আমার দু’ চোখ তখন জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বিস্তৃত এক সবুজ বনভূমির দিকে। জানালা দিয়ে আমি তাকিয়ে দেখছিলাম কি অপূর্ব অসাধারণ সুরিনামের সবুজ বনভূমি। প্লেন থেকে নেমেই লাল সবুজের পতাকা হাতে সুরিনামের মাটিতে যখন আমি পা দিলাম তখন ঠিক মধ্য দুপুর। চারিদিকে শুনশান নিরবতা। নেদারল্যান্ড থেকে একটানা চলমান বিমানটি যখন এসে থামল সুরিনামের মাটিতে যেন সবুজ বনভূমি ফুল ফল আর পাখির কুজনের মাঝে নিস্তব্ধতা ভেঙে জেগে উঠলো এই রেইন ফরেস্ট দেশটি।
ছোট্ট সুন্দর কটেজ বিমানবন্দরের সামনে আমি টুক করে একটা ছবি তুলে নিলাম। প্যারামারিবোর এই জোহান অ্যাডলফ পেঙ্গেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে বুকের ভিতর এক ধরনের চাপা আনন্দ কাজ করছে। একটা নতুন দেশে পা রেখেছি মানে আমার কাছে যেন নতুন বিশালতাকে আবিষ্কার করার মত অনুভূতি হচ্ছে। ভাবতে ভাবতে বিমানবন্দরের ভেতরে আমি ঢুকে পড়লাম। তারপর ইমিগ্রেশনের সাথে লাগানো ছোট্ট সুন্দর একটি কাঠের স্টাচু ‘মামা শ্রানাং” পার হয়ে ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়ালাম। ইমিগ্রেশনের লাইনের বেশিরভাগ মানুষের লুক ইন্ডিয়ান, অনেকটা দেখতে আমাদের মত। আমার পাশে দাঁড়ানো ছিল ঋষি নামে একটি ছেলে। তার সাথে কথা হলো। সে আমাকে বলল তার অরিজিন উড়িষ্যা থেকে এসেছে। তাঁর বাবা এবং সে তাঁদের অরিজিন খোঁজার জন্য গিয়েছিল একবার ইন্ডিয়াতে। কিন্তু অনেক খুঁজেও তারা তাদের বংশধর কিংবা কোন আত্মীয়-স্বজন কাউকেই পায়নি। হতাশ হয়ে ফিরে এসেছে। কিন্ত তাদের আত্মার সম্পর্ক যেন পূর্ব ভারতীয় মানুষদের সাথে মিশে আছে।
আমি এন্ট্রি ভিসা ভাউচার দেখিয়ে ইমিগ্রেশন ক্রস করলাম। ইমিগ্রেশন অফিসার আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল কতদিন থাকবো এবং হাসি মুখে বলল ওয়েলকাম।
আমি একটা গুড ইম্প্রেসন নিয়ে যখন ইমিগ্রেশন পার হয়ে এরাইবাল হলের কাছে মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ১০০ ডলার চেঞ্জ করলাম তাতে আমি পেলাম ৩,৭৩৮ সুরিনামিজ ভলার। আমি একটা এয়ারপোর্ট ট্যাক্সির সাথে কথা বললাম। আমাকে সিটি সেন্টারে আমার হোস্টেল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে ভাড়া আমেরিকান ৪৫ ডলার চাইলো। একটু অবাক হলাম। বোঝা গেল ট্রান্সপোর্টেশন সহ সবকিছুই খুবই এক্সপেন্সিভ। সুইডেন থেকে নেদারল্যান্ডস হয়ে সুরিনাম পৌঁছাতে আমার লাস্ট মিনিট টিকেট পেয়ে ওয়ান ওয়ে ৬৫০ ডলার খরচ হলো। নরমাল টিকিটের দাম ছিল ওয়ান ওয়ে ৮৪৫ ডলার।
এয়ারপোর্ট থেকে সিটি সেন্টার ৪৫ কিলোমিটার। এয়ারপোর্ট থেকে সিটি সেন্টারে কোন ধরনের বাস পাওয়া গেল না। অগত্যা আমি দাম করে ৩৫ আমেরিকান ডলারে একটা ট্যাক্সি পেলাম। ট্যাক্সি ড্রাইভার ছিল একটি মেয়ে। তাঁর নাম শিপ্রা। মেয়েটি ভারতীয় বংশোদ্ভুত। ডাচ ভাষায় কথা বলছে। ওদের ড্রাইভিং সিট ডান পাশে। আমি বাম পাশে উঠে বসলাম মেয়েটির পাশাপাশি। মেয়েটি আমার সাথে ভাঙ্গা ইংরেজিতে দু’চারটা কথা বলল। শিপ্রা আমাকে নিয়ে খুব জোরে গাড়ি চালিয়ে ছুটে চললো রাজধানী পারামারিবোর ডাউনটাউনের দিকে। শিপ্রা বেল্ট বাঁধলো না। আমি সিট বেল্ট বেঁধে বসলাম। কারণ শিপ্রা অনেক জোরে গাড়ি চালাচ্ছিলো। আমি তাকে সিট বেল্ট বাঁধতে বললাম। কিন্তু সে আমার কথা তোয়াক্কা না করে মুচকি হেসে ইগনোর করলো।
আমি সামনের জানালা দিয়ে প্রকৃতির দিকে তাকাতে তাকাতে মনের মাঝে সুরিনামের এক অপূর্ব সবুজ প্রকৃতিকে ধারণ করতে থাকলাম। সবুজ বন প্রকৃতির ভেতর দিয়ে গাড়ি ছুটে চললো একটা সরু স্বচ্ছ সুন্দর রাস্তা ধরে। আমি কিছু ভিডিও চিত্র ধারণ করতে থাকলাম যেতে যেতে। হঠাৎ করে কিছু মানুষের বসতিপূর্ণ একটা স্থান দেখা গেলো। সেখানে একপাশে আমি মসজিদের মিনার দেখতে পেলাম। ঠিক তার উল্টা দিকে একই স্থানে মন্দির দেখতে পেলাম। তারমানে বুঝা গেছে এখানে শান্তিপূর্ণ ধর্মপালিত হচ্ছে। যেতে যেতে দেখতে পেলাম কোথাও ডাচ-স্টাইলের ঘরবাড়ি। আবার কোথাও হিন্দুস্তানি অবয়বে একতলা বিল্ডিং। তবে বেশিরভাগই জনবসতি শূন্য। রাস্তাঘাটে তেমন মানুষজন দেখা গেল না। প্রায় সোয়া এক ঘন্টা পর পারামারিবো শহরের ডাচ কলোনিয়াল অলি- গুলির ভেতর দিয়ে শিপ্রা আমাকে ডাউন টাউন স্ট্রিটের টুয়েন্টিফোর হোস্টেলে নামিয়ে দিল। আমি তাকে টাকা দিয়ে ব্যাকপ্যাক পিছনে নিয়েই হোস্টেলের ভেতর ঢুকে পড়লাম।
রিসিপশন হলে ছিলো আফ্রিকান বংশদ্ভুত একটি মেয়ে। সে আমাকে হোস্টিং করলো। মেয়েটি যখন জানলো আমি বাংলাদেশী তখন আমাকে বলে উঠলো গতবছর এখানে কিছু বাংলাদেশি এসেছিলো। এই হোস্টেলে ছিলো। তারা ইলিগ্যাল এবং আমেরিকা যাওয়ার জন্য এখানে এসেছে। প্রায় দেড় মাসের মত নাকি তারা কয়েকজন এই হোস্টেলের স্টে করেছিলো। আমি কথা না বাড়িয়ে রুমের পেমেন্ট করে ব্যাকপ্যাক নিয়ে রুমে ফিরলাম।
মনটা একটু উদাস হয়ে গেল। যারা এসেছিলো তারা কি আমেরিকায় যেতে পেরেছিল? নাকি পথে মারা গিয়েছিল। এইসব পথে অসংখ্য অবৈধ অভিবাসন হয় যার ফলশ্রুতিতে বহু বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়েছে। আগেও যখন আমি সেন্ট্রাল আমেরিকায় গিয়েছিলাম সেখানেও কয়েকজনের সাথে আমার কথা হয়েছিল এবং তারাও বাংলাদেশী অবৈধ অভিবাসনের ওই পথে যাত্রা করার কথা বলেছিলো। যা খুবই দুঃখজনক আমাদের জন্য। অনেকে অ্যামাজনের জঙ্গল ভেদ করে পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল রাতের অন্ধকারে অজানা পথে পাড়ি জমায়। এক সময় তারা ক্ষুধা ক্লান্তি আর ঝুঁকিপূর্ণ এই পথযাত্রায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যখন আমি গিয়েছি এমন অবৈধ অভিবাসনে বহু মৃত্যুর কথা এবং কঠিন পরিস্থিতির কথা আমি শুনেছি। আমি মনে করি এই অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করে বৈধভাবে বিদেশ যাত্রা করা উচিত তাতে কারোর জীবন যাবে না।
হোস্টেলের রুম থেকে বের হয়ে আমি বারান্দায় গেলাম। বারান্দায় খুব সুন্দর একটি দোলনা ঝুলছিল। আমি দোলনার মধ্যে বসে ঝুলতে থাকলাম। চারিদিকে খুব সুন্দর গাছপালা। হোস্টেলের পরিবেশটি খুব সুন্দর। হোস্টেলটি দেখতে কটেজের মত। তিন তলা কাঠের বাড়ি। তিনতলার একটা এয়ারকন্ডিশন ফিমেল ডর্মে আমার স্থান হল থাকার। তারপর আমি হোস্টেল থেকে বের হয়ে জেসুরুন স্ট্রিট ধরে সামনের দিকে হাঁটতে থাকলাম। আমার পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা। সুরিনামের বিকেলের নরম সোনালী রোদ আমার মাথার উপর এসে পড়ছিল। পেটে প্রচণ্ড ক্ষিদে থাকলেও আমার খুব ভালো লাগছিল রাস্তার আশেপাশে ঘরবাড়ি আর প্রকৃতি দেখে। ওদের অফিসগুলো কটেজ স্টাইলের। বোঝা যায় না কোনটা ঘর আর কোনটা অফিস। তারপর আমি হাঁটতে হাঁটতে সুরিনাম নদীর তীরে চলে আসলাম। সুরিনাম নদীর তীরে সুরিনামের রাজধানী শহর প্যারামারিবো। পুরো রাজধানী জুড়ে অলংকৃত কাঠের ডাচ ঔপনিবেশিক ভবনগুলির জন্য এই শহরের খ্যাতি রয়েছে। নদীর তীরে, ১৭ শতকের ফোর্ট জিল্যান্ডিয়ায় সুরিনামস মিউজিয়াম রয়েছে। যেখানে যাওয়ার পর এই দেশের প্রকৃত ইতিহাস জানা গেছে। এর পাশেই রয়েছে কাঠ-এবং-পাথরের তৈরি রাষ্ট্রপতি প্রাসাদটি। যেটি স্বাধীনতা স্কোয়ারের মুখোমুখি এবং একটি পাবলিক পার্ক পামস গার্ডেন দ্বারা ঘিরে রয়েছে। সন্ধ্যা তখন ঘনিয়ে এসেছে। আমি শহরের একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে তাদের জাতীয় খাবার পম খেলাম। চিকেন, রাইস এবং ভেজটেবল দিয়ে তৈরি এক ধরনের খাবার যা এখানকার জাতীয় ডিশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। পরের দিন শহরে আনাচে-কানাচে সবকিছু ঘুরে দেখলাম, স্কুল ভিজিট করলাম। এখানকার ডাউনটাউন পাম গার্ডেনে ঘুরে দেখলাম। চারিদিকে অনেক খোলা জায়গা গাছপালা পাখির কিচিরমিচির দেখে মনে হয় যেন নিরব কোন স্বর্গ নগরী।
সুরিনাম দক্ষিণ আমেরিকার ক্ষুদ্রতম স্বাধীন দেশ এবং একটি জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময় দেশ। এখানে ৯৪% রেইন ফরেস্ট রয়েছে। জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুবই কম। সুরিনাম প্রাকৃতিক সম্পদ কাঠ, সোনা এবং তেল সমৃদ্ধ। খনি খাত থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখে। এক সময় আখ ও ধান চাষ করার জন্য এখানে পূর্ব ভারত, ইন্দোনেশিয়ার জাভা এবং চীন থেকে শ্রমিক হিসাবে অনেক মানুষকে ডাচরা নিয়ে এসেছে। ভারতবর্ষ থেকে ১৮৭৩ সালে প্রথম আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে এদেশের মাটিতে পূর্ব ভারতীয়দেরকে নিয়ে আসা হয়েছে।
ব্রিটিশ এবং ডাচ ঔপনিবেশিক অভিবাসীদের পূর্বপুরুষ, আফ্রিকান দাস, ইন্দোনেশিয়ান, ভারতীয়, চীনা শ্রমিক এবং আদিবাসী আমেরিন্ডিয়ানরা এখানে বসবাস হয়েছে। কথা বলা এবং খাওয়া উভয়ই একটি দেশে অনেকগুলি মিশ্রণ। এখানে অনেক মুসলমান রয়েছে এবং ভারতীয় হিন্দু রয়েছে। সবাই খুব সৌহাদ্যপূর্ণ ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করে আসছে যুগ যুগ ধরে।
যদিও আজকে দেশটি পরিপূর্ণ স্বাধীন একটি রাষ্ট্র। এখানকার কালচার খুবই মিশ্র। এখানকার মানুষের চেহারা আফ্রিকান, এশিয়ান এবং ইউরোপিয়ান মিক্সড।
ইতিমধ্যে আমি এখানকার আলবিনা, নিকেরি সহ কয়েকটা শহর ভ্রমণ করেছি। সুরিনামে লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে ১৬১ তম দেশ ভ্রমণ শেষে আমি এখন ১৬২ তম দেশ গায়ানা সড়কপথে পাড়ি দেওয়ার জন্য কোরানটিন নদীর তীরে অপেক্ষা করছি। যে নদীটি গায়ানা এবং সুরিনামকে দুই সীমান্তে ভাগ করেছে।
লেখক: নাজমুন নাহার, ১৬১ দেশ ভ্রমণকারী প্রথম বাংলাদেশী পতাকাবাহী
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here