রাতের শুকতারা ডুবে গেছে। প্রভাতের মায়াবী আলোয় ঘুম ভাঙ্গে জহুরুলের। দরজার ঝাপ টেনে উঠোনে নামে। বাসি ধোয়া-পাকলা শুরু করেছেন মা জহুরা বেগম। আলো ফোটা ভোরে বাবা ইউনুস আলী রিক্সা চালাতে বের হয়েছে। মাথায় পাহাড়সম ওর ভাবনা। বেলা বেড়ে গেলে কাজ পাবে না। কাজ না পেলে উপোষ থাকতে হবে। এ চিন্তা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ক্ষুদার তীব্র জালা নিয়ে বাড়ীর বের হয়। জীবন জীবিকার পথ খোঁজে। অবশেষে কাজ পায় চা ষ্টল, হোটেল, রেষ্টুরেন্টে, রাজমিস্ত্রীর জোগাইলা, বেকারী কিংবা ওয়েলডিং কারখানায়। এভাবেই প্রতিদিনের জীবন যুদ্ধ শিশু জহুরুলের। সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামে জহুরুল ইসলামের বাড়ি। পাঁচ সদস্যের ভুমিহীন পরিবার। পরাশ্রয়ী বসবাস। তিন ভাইয়ের মধ্যে জহুরুল বড়। স্কুলে পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। অভাবের সংসারে জহুরুলকে অল্প বয়সেই হাল ধরতে হয়েছে। জহুরুল বগুড়ার ধুনট শহরের এক চা ষ্টলে কাজ করে। বয়স দশ বছর। “ছয় মাস ধইরা এহানে কাম হরি। দিনে ১৫ টেহা পাই। ওই টেহা দিয়া কিছুই অয় না। তার উপর ভুল অইলেই মালিকের হাতে মাইর খায়া নাগে। ভোর থাইক্যা ম্যালা আইত পজ্জন্ত কাম হরি। এত আইত পজ্জন্ত কাম হইরা ব্যানা আর উঠপার পারি না। তবুও কামে আসি। নইলে খামু কি?” একই কথা শোনা গেল হোটেল বয় জামিল, ওয়েলডিং কারখানার মজিদ ও বেকারির নয়নের মুখে। ওরা সবাই শিশু শ্রমিক। বয়স ১০ থেকে ১৪ বছর। সুস্থ-অসুস্থ যাই থাকুক না কেন কাজে তাদের আসতেই হয়। কাজ বন্ধ মানেই যে ওদের খাওয়া বন্ধ। বেচে থাকার তাগিদে শিশুরা বিভিন্ন কাজে নিয়েজিত হতে বাধ্য হচ্ছে। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক শিশু। পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে ছিলেন কবি সুকান্ত। বাস্তব হলেও সত্য কবির স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেছে আজও। যে বয়সে শিশুর স্কুলে যাওয়ার কথা, এককা-দোক্কা, গোল¬াছুট, হা-ডু-ডু সহ বিভিন্ন খেলা করে হাসি আনন্দে বেড়ে ওঠার কথা। তখন সে শিশুকে ধরতে হচ্ছে সংসারের হাল। দারিদ্রতার কারনে বিভিন্ন ঝুকিপূর্ন কাজ করছে শিশুরা। জলন্ত কয়লা, বয়লারের গনগনে আগুনের শিখা, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করছে শিশুরা। এতে শুধু ওদের শারীরিক ক্ষতিই নয়, মস্তিস্ক গঠনেও বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। শিশুরা এ ধরনের কাজের ফলে ভবিষ্যতে উৎপাদনশীল কাজে নিজেকে নিয়োগ করতে পারবে না। ঝুকিপূর্ন কাজ করার ফলে ওদের জীবনে অনেক দূর্ঘটনা ঘটে যায়। ফলে পঙ্গুত্ব ছাড়াও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। জীবনী শক্তি ক্ষয়ে ক্ষয়ে অনেক শিশু মারাও যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে শিশু শ্রমিদের সোনালী শৈশব। ১৯২৩ সাল থেকেই শিশুশ্রম নিরসনে বিভিন্ন আইন রয়েছে। বাংলাদেশ আইএলও কনভেনশনের শিশুশ্রম সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারাসহ মোট ৩৩টি কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেছে। শিশু অধিকার বাস্তবায়নে বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থাও কাজ করছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয় বিভিন্ন প্রকল্পও গ্রহন করেছে। তারপরেও নিরসন হচ্ছে না শিশুশ্রম। কমছে না ওদের সংখ্যা। ধুনট উপজেলায় বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে আছে প্রায় ৫ হাজার শিশু শ্রমিক। কিন্তু শিশু শ্রম প্রতিরোধে সরকারী, বেসরকারী সংস্থা ও এনজিও গুলোর কোন উদ্যোগ নেই। প্রতিবছর ১২ জুন ঘটাকরে পালিত হয় শিশু শ্রম প্রতিরোধ দিবস। “আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত” -এ শে¬াগান এখন শুধু বই পুস্তক আর বক্তব্যের ভাষায় শোভা পায়। বাস্তব চিত্র ভিন্ন। শিশুর উন্নত ভবিষ্যত গড়তে সমাজের সর্বস্তরের বেবেকবান মানুষকে মানবিক দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এটাই জাতীর প্রত্যাশা।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here