রিপন আশরাফ

রিপন আশরাফ :: মাত্র কয়েকদিন আগে সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাসিত প্রতিবেদনে বলা হয় করোনার সময়কালীন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভারত ও পাকিস্থানীদের রাখা আমানত উল্লেখ যোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছে। কত হারে হ্রাস পেয়েছে তা বলেনি তারা। তবে আলোড়িত একটি মন্তব্যে এই সংস্থা বলে যে বাংলাদেশিদের আমানত হ্রাস পায়নি বরং বৃদ্ধি পেয়েছে।যা পরিমান প্রায় ৫০০০ কোটি টাকা । এটা হচ্ছে আমাদের টাকা আমরা বিদেশের ব্যংকে যে ভাবে পাচার করছি তার একটি খণ্ড চিত্র মাত্র কারন সুইস ব্যাংক ছাড়াও বিদেশে অনেক ব্যাংক আছে যার সঠিক প্রতিবেদন আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হয়না।কারন ব্যাংকগুলি আমানতকারীদের সম্পর্কে কঠোর ভাবে তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করে চলে।

অবধারিত ভাবে আমরা অর্থ পাচার বলতে শুধু বাংলাদেশি ভিআইপিদের কেই বুঝে এসেছি।যার পুরোটা সত্য না।শুধু বাংলাদেশি নাগরিক নন।বিদেশ থেকে বৈধভাবে বাংলাদেশে এসেছেন কিন্তু পরে বিদেশিদের দুর্নীতিবাজ হয়ে ওঠার এমন আরো কিছু ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) একটি গবেষণা প্রতিবেদনে।

বিদেশিরাও যখন বুঝে গেছে বাংলাদেশের নীতি পদ্ধতির আড়ালে কি ভাবে কর ফাকি দিতে হয় এবং বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে কর ফাকি দিয়ে বাংলাদেশের বাইরে টাকা নিয়ে যাবার সহজ চ্যানেল বা সংঘবদ্ধ সহায়ক সিন্ডিকেট আছে যারা এই কাজে সাহায্য করে থাকে। বর্তমানে করোনাকালীন ছুটিতে দেশে ফিরে যাবার আগের হিসেবে  দেশে আড়াই লাখ বিদেশি নাগরিক কাজ করেন । সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন-  “সব খাতে বিদেশি শ্রমিকের প্রয়োজন নেই।

এ ব্যাপারে সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।বৈধভাবে যাদের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে, তাদের ব্যাপারে আরেকটু যাচাই-বাছাই করতে হবে। তবে প্রশ্ন হল অবৈধদের নিয়ে। এর আগেও  অবৈধ বিদেশিদের নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছিল। বিষয়টি উদ্বেগের। কারণ অবৈধভাবে কাজ করবে, এটি কোনো দেশই এখন আর মেনে নেয় না। এতে দেশের অর্থনীতির বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। কারণ অনুমতি ছাড়া কাজ করার মানে হল, তারা যে পরিমাণ অর্থ নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে, তার পুরোটাই অবৈধ। দ্বিতীয়ত, বিষয়টি হল দেশের নিরাপত্তা। এসব অবৈধ  বিদেশি জঙ্গি হামলাসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিদেশে পাচার করছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।”

বাংলাদেশে সবচাইতে বেশি কর্মী  শ্রমিক কাজ করে  ভারতের। সরকারি হিসাবে দেশটির ৩০ হাজারের বেশি নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করেন। এটির বাইরেও বিপুল কর্মী কাজ করে যার সঠিক ডাটা নেই সরকারের কাছে। এর পর চীন, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, নরওয়ে এবং নাইজেরিয়া উল্লেখযোগ্য।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা কমপক্ষে ২ লাখ ৫৬ হাজার। এদের ন্যূনতম মাসিক বেতন ১ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার।  আর বিদেশি কর্মীদের মোট বার্ষিক আয় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে দেশে নিয়ে যায় ৩ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার।প্রতি ডলার ৮৫ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ২৬  হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈধভাবে নিয়ে যাচ্ছে ৩৯১ কোটি এবং অবৈধভাবে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর ফলে বছরে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি ১২ হাজার কোটি টাকা।যা দেশের পদ্মাসেতুর বাজেটের প্রায় সমান।

বিদেশিদের বেতন দেয়ার ক্ষেত্রেও তথ্য গোপন করছে দেশের বিভিন্ন কোম্পানি। টিআইবি বলছে, প্রাথমিকভাবে ১০টি ক্যাটাগরিতে চাকরি করছেন বিদেশিরা। এর মধ্যে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে বেতন দেখানো হচ্ছে ৩ থেকে ৩.৬ হাজার ডলার। কিন্তু এদের প্রকৃত বেতন ১০-১২ হাজার ডলার। এ ছাড়া প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা পদে ৮-১০ হাজার ডলারের স্থলে ২.৫-৩ হাজার ডলার দেখানো হয়। কমপ্লায়েন্স বা সোশ্যাল অডিটর পদে ৯.৫-১১ হাজার ডলারের জায়গায় ৩-৩.৫ হাজার ডলার, জেনারেল ম্যানেজার ৬-৮-এর পরিবর্তে ১.৮-২.৫ এবং হেড অব ডায়িং ৫-৭-এর পরিবর্তে ১.৫-২ হাজার ডলার বেতন দেখানো হচ্ছে। সরকারকে কর ফাঁকি দেয়ার জন্য কোম্পানি এবং বিদেশি কর্র্মীদের যোগসাজশে এসব করা হচ্ছে।

অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যানুসারে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিদেশি কর্মীর সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৫০০। আলোচ্য সময়ে তাদের মোট আয় ছিল ৬০৩ কোটি টাকা। আর এখান থেকে সরকারকে কর দিয়েছে ১৮১ কোটি টাকা। তবে টিআইবি বলছে, এটি সঠিক তথ্য নয়। এখানেও আয়কর ফাঁকি দেয়া হয়েছে। কারণ এই তথ্য অনুসারে প্রতিজন বিদেশি কর্মীর মাসিক আয় ৫৩ হাজার টাকা। যা একেবারে অসম্ভব। কারণ এই পরিমাণ বেতনের জন্য কেউ বাংলাদেশে আসে না।

যেসব খাতে বিদেশি শ্রমিক কাজ করছেন এগুলো হল- তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, বায়িং হাউস, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, মোবাইল ফোন কোম্পানি, তথ্যপ্রযুক্তি, চামড়া শিল্প, চিকিৎসাসেবা, কার্গো সেবা, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডস, আন্তর্জাতিক এনজিও, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, বহুজাতিক তেল ও গ্যাস কোম্পানি, অডিট, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, প্রকৌশল, ফ্যাশন ডিজাইন, খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন, পোলট্রি খাদ্য উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

সংস্থাটির গবেষনা প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশিদের দ্বারাই  অবৈধ ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমেই বিদেশিদের থাকার ক্ষেত্রে দফা রফা হয় । এ ক্ষেত্রে সরকারের ৮টি সংস্থাকে ২৩-৩৪ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। এর মধ্যে ভিসা সুপারিশ পত্রের জন্য ঘুষ নিচ্ছে ৫-৭ হাজার টাকা, বিদেশে বাংলাদেশ মিশন থেকে ভিসা সংগ্রহ ৪.২৫ থেকে ৮.৫ হাজার, ভারত ও পাকিস্তানের নাগরিক ৯০ দিনের বেশি অবস্থানের ক্ষেত্রে নিবন্ধনের জন্য ২-৩ হাজার, কাজের অনুমোদনের জন্য বিডা, এনজিও ব্যুরো ও বেপজায় ৫-৭ হাজার, নিরাপত্তা ছাড়পত্র নিতে পুলিশকে ৫-৭, নিরাপত্তা ছাড়পত্র নিতে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ৩-৫, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২-৩ এবং ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরকে ৩-৫ হাজার টাকা দিতে হয়। বাংলাদেশের  অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিষয়টি উদ্বেগজনক।

সঙ্গত কারনেই বিদেশিরাও এখন বাংলাদেশে দেশে এসে সুযোগ পেয়ে চাকরির নামে হাজার হাজার কোটি টাকা নিজেদের দেশে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছেন। অঙ্কের হিসাবে বিদেশি কর্মীর মাধ্যমে পাচার হওয়া টাকার পরিমাণ বছরে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি। অথচ বৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে রেমিট্যান্স যাচ্ছে মাত্র ৩৯১ কোটি ২১ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

পোশাক খাতসহ বেশ কিছু ইন্ডাস্ট্রিতে এখন বিদেশিরা ব্যাপকভাবে কাজ করছেন। তবে আশপাশের দেশের নাগরিক হওয়ায় তাঁদের আলাদাভাবে খুব একটা চেনা যায় না। তবে টিআইবি তাদের গবেষণার মাধ্যমে এদের একটি ভয়ংকর রূপ চিনিয়ে দিল। তাদের গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, এ দেশে যত না বিদেশি কর্মীরা বৈধভাবে কাজ করেন, তার প্রায় তিন গুণের কাছাকাছি কাজ করেন অবৈধভাবে। বৈধ ও অবৈধরা এ দেশ থেকে বছরে অবৈধভাবে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছেন ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, যেখানে বৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে রেমিট্যান্স যাচ্ছে প্রতিবছরে ৪৬ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৯১ কোটি ২১ লাখ ৬০ হাজার টাকা)। ফলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে বাংলাদেশ। রেমিট্যান্স হিসেবে আমরা যত টাকা আয় করি, তার চেয়ে বেশি অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে।’

শুধু অবৈধরা নন, বৈধভাবে যেসব বিদেশি কর্মী এ দেশে কাজ করছেন, তাঁরাও এখন বুঝে গেছেন, কীভাবে বাংলাদেশে ট্যাক্স ফাঁকি দিতে হয়। বিদেশিদের এসব ফাঁকিবাজির কারণে বছরে বাংলাদেশের ক্ষতি হচ্ছে ১২ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশি কর্মীরা যেখানে খুবই অপর্যাপ্ত বেতন পান, সেখানে বিদেশিরা এ দেশে গড় বেতন পান এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। অথচ ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য দেখান ৫৩ হাজার টাকা। টিআইবির বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বৈধ ও অবৈধভাবে এ দেশ থেকে বিদেশি কর্মীরা যে অঙ্কের টাকা রেমিট্যান্স নিয়ে যাচ্ছেন, তা এখন বাংলাদেশিরা বিদেশ থেকে যে রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন, তার কাছাকাছি চলে এসেছে।

টিআইবির মতে, সংখ্যার হিসাবে এ দেশে বিদেশি কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আছেন ভারতীয় নাগরিকরা। আর অবৈধভাবে এ দেশে বিদেশিদের কাজ করার মূল সুযোগটি তৈরি হয় পর্যটন ভিসার মাধ্যমে। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে শিক্ষিতদের মধ্যে ৪৭ শতাংশই বেকার। সেখানে বাংলাদেশে বিদেশি শ্রমিক বাড়ছে। এতে কর্মসংস্থান আরও সংকুচিত হচ্ছে। চার দশক আগে বাংলাদেশে বিভিন্ন শিল্প বিকাশের সময় যে বিদেশি কর্মী প্রয়োজনীয় ছিল, বর্তমানে তার প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ।

আমাদের কথা যে ‘বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে টাকা পাচারের স্বর্গ রাজ্য এবং এখানে আইন ফাকি দিয়ে কাজ করা সহজ ব্যাপার’– বিদেশিদের মধ্যে বিরাজমান এই মনোভাব বহির্বিশ্বে ভাবমূর্তি ক্ষুন্যকারি বিষয় এবং তার চাইতেও বড় বিষয় হচ্ছে প্রতি বছর বিশাল অংকের রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। অবৈধ বিদেশি নাগরিক কাজ করার ক্ষেত্রে আইন রয়েছে। এ আইনের প্রয়োগ নেই। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে।

 

 

 

লেখকঃ রাজনৈতিক অর্থনীতি ও উন্নয়ন গবেষক। ashrafdemocrat@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here