স্টাফ রিপোর্টার: আগামী ৬ মাসের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিটিসিএলকে সম্পূর্ণ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানীতে রূপান্তরের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে রক্ষা করে একে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি। আজ রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে ‘বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক ফলোআপ প্রতিবেদনের প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই আহ্বান জানানো হয়।

এতে মূল প্রতিবেদনের সারাংশ উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার দীপু রায়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম. হাফিজউদ্দিন খান, টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।

গঠন হওয়া থেকে এ পর্যন্ত বিটিসিএলের উল্লেখযোগ্য অর্জসমূহের মধ্যে রয়েছে অপটিক্যাল নেটওয়ার্কের ৭২টি এক্সচেঞ্জ স্থাপন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩টি জেলার ১৭টি এক্সচেঞ্জ স্থাপন , ৪৭,০০০ এডিসিএল ব্রডব্রান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দেয়ার সক্ষমতা অর্জন, সরকারি কার্যালয়ে ও ডিসি অফিসে ই-সিস্টেম চালু, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে টেলিফোন সংযোগ ফ্রি করা, সারাদেশে টেলিফোন সংযোগ ফি, কল রেট ও ইন্টারনেট ফি কমানো, ১০৮টি ইউনিয়ন পরিষদে অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপন, ইন্টারনেট প্রোটোকল বেইজড ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স) স্থাপন ইত্যাদি।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী অধিকতর দক্ষ ও মুনাফাভিত্তিক করার লক্ষ্যে ২০০৮ সালে বিটিটিবিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি (বিটিসিএল) হিসেবে ঘোষণা করা হলেও পরিকল্পনায় ঘাটতি এবং বাস্তবায়নজনিত দুর্বলতার কারণে প্রতিষ্ঠানটি একটি কার্যকর পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জন করতে পারেনি। নতুন অর্গানোগ্রাম অনুসারে লোক নিয়োগ না হওয়া ও দক্ষ জনবলের অভাব, রাজনৈতিক প্রভাব এবং প্রাইভেট কোম্পানীর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট টেলিযোগাযোগ নীতিমালা বাস্তবায়নসহ নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতির ফলে লাভজনক হওয়ার পরিবর্তে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব হারাচ্ছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরের পর থেকে এ পর্যন্ত বিটিসিএলের কিছু উল্লেখযোগ্য অর্জন থাকলেও অনিয়ম – দুর্নীতিসহ নানাবিধ সংকটে প্রতিষ্ঠানটি এখন অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি। প্রাতিষ্ঠানটিকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহের মধ্যে রয়েছে প্রধানত সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে পরিচালনা বোর্ড গঠন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগে জটিলতা, কোম্পানী হিসেবে নিজস্ব ক্রয় নীতি না থাকা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ফলে যুগোপযোগী যন্ত্রপাতি ক্রয় না হওয়া, দক্ষ ও পর্যাপ্ত জনবলের ঘাটতি এবং নতুন অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী জনবল নিয়োগ করতে না পারা প্রভৃতি।

এসব চ্যালেঞ্জ ছাড়াও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা ও নানাবিধ অনিয়ম দুর্নীতির কারণে বিটিসিএল এর আয় উদ্বেগজনকভাবে কমে গেছে। বাজার ও চাহিদা বিবেচনায় না এনে ২৫টি কোম্পানিকে আইজিডব্লিউ লাইসেন্স প্রদান করার কারণে বিটিসিএলের আন্তর্জাতিক ইনকামিং কলসংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছে। ২০১০ সালে ইনকামিং কল সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫৭ কোটি মিনিট যা ২০১৩ সালে এসে কমে দাঁড়ায় প্রায় ২০৯ কোটি মিনিটে। কল রেকর্ড না থাকার কারণে বিটিসিএল রাজস্ব হারানোসহ মোট ১৫০০ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অন্যদিকে বেআইনীভাবে বিটিসিএলের গেটওয়ে ব্যবহারের মাধ্যমে অবৈধ ভিওআইপি চালিয়ে যাওয়ায় বিটিসিএল বিপুল পরিমান রাজস্ব হারাচ্ছে। এছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় পদায়ন, বদলি ও পদোন্নতি, জবাবদিহিতার অভাব, প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, অবৈধভাবে কোম্পানির ভূমি দখল প্রদান, প্রাইভেট কোম্পানিকে অবৈধভাবে সুবিধা প্রদান, সিবিএ নেতাদের দুর্নীতি ও সেবার বিনিময়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে অবৈধ অর্থ আদায়, পরিবহন খাতে দুর্নীতিসহ বহুমাত্রিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অস্তিত্ব রয়েছে।

টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম. হাফিজউদ্দিন খান বলেন, “বিটিসিএলকে কোম্পানীতে পরিণত করার পর প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক সেবার মান উন্নয়নের বদলে নি¤œগামী হয়েছে। কোম্পানীতে পরিবর্তন করে শুধু লাভ নয় বরং গ্রাহক সন্তুষ্টি এবং সেবার মান উন্নয়নে মনোনিবেশ করা অত্যন্ত জরুরী। ”

টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন: “সরকারের যুক্তি ছিল বিটিসিএল বেসরকারীকরণ হলে অধিকতর দক্ষ ও মুনফাভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। কিন্তু বেসরকারীকরণ করা হলেও এটি সরকারের যথাযথ কর্মপরিকল্পনার অভাবে একটি অকার্যকর ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সরকারের উচিত অনতিবিলম্বে একটি সুনির্দিষ্ট সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়ন করে বিটিসিএল-এর বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা।”

অব্যাহত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এবং গ্রাহক সেবার মান উন্নয়নে বিটিসিএলকে লাভজনকভাবে পরিচালনার জন্য টিআইবি’র গবেষণায় ১৫ দফা সুপারিশ করা হয়। সুপারিশসমূহের মধ্যে অন্যতম হল: পরিচালনা বোর্ডে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কমানো; নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থায়ী ভিত্তিতে বোর্ডের সদস্য নিয়োগ দান; বিটিসিএল, টেলিটক এবং বিএসসিসিএল (সাবমেরিন কেবল কোম্পানী লি.) এই তিনটি কোম্পানীকে একত্রীভূত করে একটি কোম্পানীতে রূপান্তর এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুঁজি বাজারে শেয়ার ছাড়া; কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ সুবিধা ও পদায়নের জটিলতা নিরসণে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ; আইজিডব্লিউ অপারেটরদেরকে অভিন্ন প্লাটফর্মের নিয়ন্ত্রণে ব্যবসা পরিচালনা করার ব্যবস্থা; ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্যান্য সকল নিয়োগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন; ট্রেড ইউনিয়নকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা; বাৎসরিক ভিত্তিতে সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব ও বিবরণ প্রকাশ এবং নিরীক্ষার পরে চিহ্নিত অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। উল্লেখ্য যে, বিটিসিএল নিয়ে টিআইবি ধারাবাহিকভাবে গবেষণা করে আসছে। এর অংশ হিসেবে ২০১০ সালের মার্চে প্রথম গবেষণাটি পরিচালিত হয়।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here