Forruk_Ahmedসাইদুর রহমান  ::সুখী সংসারের জন্য পরিবারের সদস্য সংখ্যা কত হওয়া উচিত? কতজন ছেলে-মেয়ে হলে স্বামী-স্ত্রী সুখী জীবন যাপন করতে পারবেন?

উত্তর হয়ত এমন আসবে – “ছোট পরিবার সুখী পরিবার”, “ছেলে হোক মেয়ে হোক দু’টি সন্তানই যথেষ্ঠ, একটি হলে আরো ভালো হয়৷” চুরি, দূর্নিতী না করে ঘুষবিহীন সৎ ভাবে উপার্জন করে দু’টি নয়, চারটি নয় এগারটা সন্তান নিয়ে সুখী জীবন যাপন করা কি সম্ভব? অসম্ভব৷

এই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছিলেন আমাদের রমজান-লিলি দম্পতি৷ রমজান বললে হয়ত অনেকেই চিনবেন না৷ ১৯১৮ সালের ১০ জুন তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার শ্রীপুর থানার অন্তগর্ত মাঝআইল গ্রামের সৈয়দ হাতেম আলীর ঘরে তাঁর জন্ম৷ পিতা নাম রেখেছিলেন ফররূখ আহমদ, কিন্ত রমজান মাসে জন্ম বলে দাদী তাঁকে আদর করে রমজান নামে ডাকতেন৷ ছয় বছর বয়সে তাঁর মা মারা যায়, দাদীই তাঁকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেন৷

আশা করি রমজানকে চিনতে পেরেছেন৷ না চিনতে পারলে বাংলা মুসলিম সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের পাশে কার নামটি যুক্ত করা যায় খোঁজতে থাকুন, পেয়ে যাবেন তাঁকে৷ ইসলামী রেঁনেসার এই কবির প্রতিভা এবং জীবনী নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে গেলে দিনের পর দিন শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আলোচনা বাকি থেকে যাবে৷ আমাদের বিস্ময় তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে!

১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে আপন খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুন (লিলি)-এর সঙ্গে ফররুখ আহমদের বিয়ে হয়। খুব রোমান্টিক ছিলেন এই কবি৷ কবি-সাহিত্যিকরা সাধারণত রোমান্টিকই হন, তবে সে রোমান্টিকতা তারা প্রয়োগ করেন অন্যের স্ত্রীর সঙ্গে৷ কিন্তু আমাদের রমজান ছিলো আদর্শবান ছেলে৷ স্ত্রী কে উৎসর্গ করে ‘উপহার’ নামে একটি কবিতা লেখেন যা ‘সওগাত’ পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩৪৯ সংখ্যায় ছাপা হয়৷

সৈয়দা তৈয়বা খাতুনও কি কম ভালোবেসেছেন তাঁকে! আজকের দিনে আপনি যতই ভালোবাসার কথা বলেন, একটা, দু’টোর বেশি সন্তান জন্ম দেওয়ার মত স্ত্রী সহজে খুঁজে পাবেন না সারা দেশে৷ শুধু জন্ম দেওয়াটাই বড় কথা নয়৷ যেখানে আজকাল এক, দুইটা সন্তান সামলাতে গিয়ে স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই হিমশিম খেতে হয়;সেখানে লিলি একা কি করে এগারটি সন্তানকে মানুষ করেছেন!

কবিরা সাধারণত স্বপ্নচারী হয় তাই তাদের মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করে৷ এই অস্থিরতা তাদের কোথাও স্থির থাকতে দেয় না, এটাকে অনেকে পাগলামী মনে করে৷ তাইতো শেখ সাদী বলেছেন, “বাস্তব বিবর্জিত মানুষ কবি হয়, নয়তো পাগল হয়৷”

রমজানের মাঝেও অস্থিরতা ছিলো৷ যেটা আমরা দেখতে পাই তাঁর কর্মজীবেন৷ তিনি আই.জি.প্রিজন অফিস, সিভিল সাপ্লাই, ফার্ম, পত্রিকা অফিস সহ অনেক জায়গায় জব করেছেন৷ তবে শেষ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে চাকরি করেন ঢাকা বেতারে৷

অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বলেছেন, “ফররুখ আহমদ কখনও কারো কাছে কোনো অনুগ্রহ গ্রহণ করেননি। এমনকি রাষ্ট্রীয় অনুগ্রহও তিনি গ্রহণ করেননি। পাকিস্তান আমলে সরকার তাকে যেসব সম্মাননা প্রদান করেছেন তিনি নিজে তা কখনও গ্রহণ করেননি৷ তার বাড়িতে এসে কেন্দ্রীয় সরকারের একজন সচিব সে সম্মাননা তাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন৷ তিনি কখনো আমন্ত্রণ পাওয়া সত্ত্বেও কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের সফরসঙ্গী হননি। তিনি বারবার আমন্ত্রণ পাওয়া সত্ত্বেও দেশের বাইরে এমনকি পশ্চিম পাকিস্তান সফরেও যাননি৷ কারো কোনোরূপ অনুগ্রহ বা পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণ করেননি। এই দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ী এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ সমাজে অতিশয় বিরল৷”

কবি প্রথম জীবনে বামপন্থী ছিলেন৷ এটা কবির দোষ না৷ বৃটিশ প্রণীত শিক্ষা ব্যবস্থাটা প্রণীত হয়েছে এমন ভাবে যেখানে উপমহাদেশের লেকেরা সরাসরি খৃষ্টান না হয়ে খৃষ্টানদের কাছাকাছি পর্যায়ের হবে৷ তাদের প্রণীত শিক্ষা ব্যবস্থায় হিন্দুরা পেয়েছে “ব্রাক্ষ্ম সমাজ” আর মুসলমানরা পেয়েছে “বাম ধারা”৷ বাংলা সাহিত্যের বেশির ভাগ লেখকই এই দুই ধারার অন্তর্ভূক্ত৷ কিন্তু জন্মসূত্রে ইসলামী আদর্শ ও ঐতিহ্যের অধিকারী ফররুখ আহমদ বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ধর্মীয় চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে পড়েন৷

ফররূখ আহমেদের ধর্মীয় চিন্তা নিয়ে ”সওগাত” সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, ‘‘বিগত ২২ শে জুন (১৯৭৪) নজরুল জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সওগাত সাহিত্য মজলিসের অনুষ্ঠানে বহু কবি-সাহিত্যেকের সমাগম হয়েছিল। কিন্তু এ অনুষ্ঠানে ফররুখ আহমদকে পাইনি৷ একজন প্রখ্যাত কবিকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, ফররুখ আহমদ এলেন না কেন? তিনি বললেন, কবি আজকাল ঘর থেকে বড় বেশি বের হন না৷ তিনি নাকি ইসলামী তমদ্দুনের কবি, তাই অপরাধী৷ জানি না কবে পর্যন্ত তার অপরাধের সমাপ্তি হবে এবং তিনি আমাদের সাথে আবার মিলিত হবেন।’’

এই যে এতগুলো সন্তান জন্ম দেওয়া, তাদের মানুষ করা, একটার পর একটা চাকুরী ছেড়ে দেওয়া, সরকারী উচ্চ পর্যায়ে হাত থাকার পরেও সৎভাবে জীবন-যাপন করা, আদর্শের জন্য বন্ধু সঙ্গ ত্যাগ এসব কিছুই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি কবির কাব্য চর্চা এবং সংসার জীবনে৷ কারন তিনি মুক্ত ছিলেন স্ত্রীর ঘ্যানর ঘ্যানর থেকে৷

কবির স্ত্রী সৈয়দা তৈয়বা খাতুন (লিলি) স্বামী সম্পর্কে বলেন, ‘‘তার রোজগার খুব বেশি ছিল না, তাই আমাদের সংসারে প্রাচুর্য ছিল না কখনোই৷ কিন্তু সুখ ছিল অভাব-অনটনের সংসারে, প্রশান্তি ছিল৷”

সুখী হওয়ার জন্য আজকাল আমরা পরিবার- পরিকল্পনা করি, নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে সম্পদের পাহাড় বানাই, ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা না করে ক্ষমতাবানদের পদলেহন করি, সৎ-অসৎ চিন্তা না করে স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্বের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলি কিন্তু সুখ নামের পায়রাটার সাথে কি আমাদের দেখা মিলে? কয়জন দম্পতি রমজান-লিলির মত সুখী জীবন যাপন করতে পারে?

জীবনে সুখী হওয়ার মূল মন্ত্র কবি প্রকাশ করে গেছেন আমাদের কাছে –

“তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া
তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া৷”

যদিও শিরোনামের সাথে লেখাটা প্রাসঙ্গিক নয়, তারপরেও উল্লেখ করি আমরা কি আচরণ করেছি কবির সাথে?

কবি পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে দুঃখ করে বলতেন, “আমার লেখা ঢাকায় পত্রিকার সম্পাদক সাহেবরা প্রকাশ করেন না, প্রকাশ করেন পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকার সম্পাদকরা৷”

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে কবিকে তাঁর ২৪ বছরের কর্মস্থল “ঢাকা বেতার” থেকে বহিস্কার করা হয় , এমনকি বেতন, ইনক্রিমেন্ট, পেনশন কিছুই দেওয়া হয় নি৷

মাত্র ৫৬ বছর বয়সে ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর আমাদের কাছ থেকে অনেক অভিমান নিয়ে কবি পরপারে চলে যান৷ তাঁর চিকিৎসক বলেছিলেন, “ফররুখ আহমদ ঠিকমতো চিকিৎসা, ওষুধ ও পথ্য পেলে আরো কিছুদিন জীবিত থাকতেন৷”

তাঁকে শুধু পরপারে পাড়িয়েই আমরা ক্ষ্যান্ত হইনি, তাঁর জন্মদিন বা মৃত্যু দিবস উপলক্ষ্যে তেমন কোন আলোচনা করা হয় না মিডিয়াতে৷ অথচ অনেক আদর্শহীন ব্যক্তির জীবনী নিয়ে মাতামাতি হয়৷ যে জাতি তাদের আদর্শবান লোকদের এমন অনাদর আর অবহেলা করে, সে জাতির ঘোর অমানিশা কবে কাটবে হে পাঞ্জেরী!

চলবে………

লেখকঃ কলামিষ্ট

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here