কলকাতা: গত প্রায় দুই দশক ধরে অত্যাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে কলকাতায় একের পর এক বেসরকারি হাসপাতাল তৈরি হয়েছে।

এর ফলে দক্ষিণ ভারতে চিকিৎসা করাতে যেতেন পূর্ব-উত্তরপূর্ব ভারতে যেসব মানুষ, তাদের অনেকেরই এখন হাতের নাগালে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা।

বাংলাদেশ থেকেও হাজার হাজার মানুষ কলকাতার হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসা করাতে যান প্রতিবছর।

বাংলাদেশি রোগীদের নিয়ে সেখানে চলে হাসপাতালগুলোর মধ্যে ব্যবসা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা, সঙ্গে রয়েছে দালালদের ফাঁদ।

দক্ষিণ-পূর্ব কলকাতার ইস্টার্ন বাইপাসের ধারের মুকুন্দপুর এলাকাটা একসময়ে ছিল জলা জমি। কিন্তু এখন প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই ব্যস্ত।

গত দেড়-দুই দশকে সেখানে গড়ে উঠেছে একের পর এক বড় বেসরকারি হাসপাতাল।

বিশিষ্ট ক্যান্সার-সার্জন গৌতম মুখোপাধ্যায় এই অঞ্চলের বেসরকারি চিকিৎসা পরিষেবার সঙ্গে একেবারে গোড়া থেকেই যুক্ত।

তিনি বলছিলেন, সরকারি হাসপাতালগুলির যা অবস্থা হয়েছিল, যে বিপুল সংখ্যক রোগী সেখানে যেতেন, তা হাসপাতালগুলির পক্ষে সামলানো অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।

‘সেই সুযোগটা নেয় কর্পোরেট সংস্থাগুলো। বছর কুড়ি ধরে তারা কলকাতায় আসতে শুরু করে। বাইপাসের ধারেই তো ১৫–২০ টা হাসপাতাল হয়ে গেছে’, বলেন তিনি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ কার্ডিয়াক সায়েন্সেস হাসপাতালটি সাধারণ মানুষের কাছে ভারতের প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দেবী শেট্টির হাসপাতাল নামেই পরিচিত।

ওই গোষ্ঠীর পূর্বাঞ্চলের পরিচালক দীপক ভেনুগোপালন বলছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে পূর্ব ভারত বা বাংলাদেশের মানুষের কাছে দক্ষিণ ভারতই চিকিৎসার জন্য সেরা জায়গা হয়ে থেকেছে।

হাসপাতাল পাড়া ঘেঁষে গড়ে উঠেছে লজ আর হোটেলের সারি, যেখানে বিশেষ ব্যবস্থা আছে বাংলাদেশিদের জন্য।

কিন্তু মানুষের সেই মনোভাব এখন বদলাচ্ছে।

ভেনুগোপালনের বলেন, গত ৫ বছরে মানুষ আসলে কলকাতার চিকিৎসা-ব্যবস্থার ওপরে ভরসা করতে শুরু করেছেন, কারণ এখানে একের পর এক বিশ্বাসযোগ্য হাসপাতাল তৈরি হয়েছে।

তবে তিনি বলেন, এখনো বেসরকারি হাসপাতালগুলো পুরো ভর্তি হয় না।

‘বাইপাস অঞ্চল আর মধ্য কলকাতা মিলিয়ে প্রায় হাজার তিনেক শয্যা রয়েছে বেসরকারি খাতে যার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ শয্যায় রোগী ভর্তি হন, আর বাকিটা খালিই পড়ে থাকে’,  বলেন ভেনুগোপালন।

‘অর্থাৎ বাজার বৃদ্ধির অনেক সুযোগ রয়েছে।’

‘ঢাকাতেও চিকিৎসা খারাপ হয় না, কিন্তু কলকাতা থেকে চেনাশোনা অনেকে চিকিৎসা করিয়ে ভাল হয়ে ফিরেছেন।

দক্ষিণপূর্ব কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে স্থানীয় মানুষ ছাড়া আর সবথেকে বেশী যারা চিকিৎসা করাতে আসেন, তারা বাংলাদেশের রোগী।

এই অঞ্চলের সব থেকে পুরণো বেসরকারি হাসপাতাল হল পিয়ারলেস।

ওই হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ সমাদ্দার বলছিলেন, তার হাসপাতালে গত বছর প্রায় ১৪ হাজার বাংলাদেশি চিকিৎসা করিয়েছেন।

কেন বাংলাদেশের মানুষ কলকাতায় চিকিৎসা করাতে আসেন এত বেশী সংখ্যায়?

সমাদ্দার জবাব, কলকাতায় এখন অনেক মানুষ চিকিৎসা করাতে আসছেন ঠিকই। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে যাওয়ার যে ধারা তৈরি হয়ে গিয়েছিল, সেটা বদলাতে সময় লাগছে।

‘আমাদের হাসপাতালে আমরা এরকম অনেক রোগী পাই, যারা হয়ত আমাদের টপকিয়ে দক্ষিণ ভারতে গেছেন, কিন্তু এখানেই ফিরে এসে চিকিৎসা করাচ্ছেন আর ভালও হয়ে যাচ্ছেন’, বলেন তিনি।

তাহলে, বাংলাদেশ থেকে রোগী কী ধরনের চিকিৎসার জন্য কলকাতা আসেন?

তিনি বলেন, সহনীয় খরচে উন্নত চিকিৎসার আশায় অনেকে কলকাতা আসেন।

স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ পার্থ প্রতিম বিষ্ণু বলছিলেন, শিশু আর পূর্ণবয়স্কদের ব্রেন টিউমার, মেরুদণ্ডের সমস্যা বা চলাফেরার সমস্যা নিয়েই তার বিভাগে বাংলাদেশ থেকে মানুষ চিকিৎসা করাতে আসেন।

কিডনি বিশেষজ্ঞ দীপক শঙ্কর রায় বলছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাসপাতালে তাদের বিভাগে বাংলাদেশ থেকে আসা বেশীরভাগ রোগীই কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য আসেন।

বাংলাদেশ থেকে আসা একজন  রোগী বললেন, কলকাতা ঢাকার খুব কাছে আর ভাষা বা খাবারের সমস্যা এখানে হয় না।

আরেক মহিলা রোগী বলছিলেন, ঢাকাতেও চিকিৎসা খারাপ হয় না, কিন্তু কলকাতা থেকে চেনাশোনা অনেকে চিকিৎসা করিয়ে ভাল হয়ে ফিরেছেন – সেই ভরসাতেই এখানে আসা।

মুকুন্দপুর অঞ্চলের হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসা করাতে যারা বাইরে থেকে, বিশেষত বাংলাদেশ থেকে আসেন, তাদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করার জন্য রীতিমতো একটা সমান্তরাল শিল্প গড়ে উঠেছে।

সেখানে হোটেল-লজ আর বাংলাদেশিদের পছন্দের খাবারের দোকান, যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে কলকাতা-ঢাকা রুটের বাসের টিকিট কাউন্টার বা বিদেশ থেকে টাকা আনানোর ব্যবস্থা সহ নানা ধরনের সহযোগী পরিষেবা।

এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন লক্ষাধিক মানুষ।

এই অঞ্চলেরই এক লজ মালিক অরূপ দাস বলেন, হাসপাতালগুলো তৈরি হওয়ার পরেই এখানে লজ-হোটেল তৈরি হয়েছে, আরো হচ্ছে। যারা এখানে থাকতে আসেন – বেশিরভাগই বাংলাদেশি।

হাসপাতাল হোক বা লজ-খাবার দোকানের মতো সহযোগী পরিষেবা, সব কিছুই কিন্তু কর্পোরেট সংস্থা বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে, বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ থেকে আসা রোগীদের ভারতীয় ভিসা পাওয়াটা একটা বড় সমস্যা, বলছিলেন পিয়ারলেস হাসাপাতালের দিলীপ সমাদ্দার।

পিয়ারলেস হাসপাতালের বিপণন বিভাগের প্রধান সুগত মজুমদার বলেন, এখানে যারা আসছেন, তাদের অনেক সময়েই দালালের পাল্লায় পড়ে ঠকতে হচ্ছে, বিশেষত বাংলাদেশি রোগীদের।

তবে শুধু যে বাইরে থেকে আসা দালালের কাছে ঠকতে হচ্ছে তাই নয়।

অনেক হাসপাতালই একই চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশি রোগীদের কাছ থেকে একেক রকম টাকা নেয়।

এই অভিযোগ হাসপাতালগুলি মানতে না চাইলেও বেশ কয়েকটি বড় হাসপাতালের সঙ্গে জড়িত শল্য চিকিৎসক দিব্যেন্দু হালদার সেটা স্বীকার করে নেন।

বাংলাদেশের রোগীদের কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া আর সেদেশের রোগীদের পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেন জিন পরীক্ষা কেন্দ্র অ্যামপ্লিকনের কর্ণধার ড. সুরঞ্জনা চৌধুরী। তিনিও একই অভিযোগ করেন।

সূত্র: বিবিসি

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here