আন্তর্জাতিক ডেস্ক/

লন্ডন : যত দূর চোখ যায়, চারপাশে শুধু আল্পসের বরফ আর বরফ। তারই মাঝে অসংখ্য দেহাবশেষ একে অন্যের সঙ্গে দলা পাকিয়ে পড়ে রয়েছে। গত একশো বছর ধরে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এই ভয়াবহ স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আল্পসের পার্বত্য উপত্যকায়।
প্রত্যেক বছর গরম পড়তে না পড়তেই পর্বতারোহীরা আল্পস জয়ে বের হন। বছর দশেক আগে এ রকমই এক দল অভিযাত্রী আল্পস পাড়ি দিয়েছিলেন। ২০০৪ সালে সে বারই প্রথম উদ্ধার হয় তিন অস্ট্রীয় সেনার দেহ। মৃত্যুর প্রায় ১০০ বছর পড়ে সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে আসেন তাঁরা। সেই শুরু। তার পর থেকে প্রায় প্রতি বছরই গ্রীষ্মে ইতালীয় আল্পসের ট্রেনটিনোতে বরফ গলে জেগে ওঠে ইতিহাস। খবর আনন্দ বাজার।
প্রেক্ষাপট প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯১৫ সালের এপ্রিল মাস। আল্পসের পার্বত্য উপত্যকায় ইতালি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি যুদ্ধ। বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ইতালি ও অস্ট্রিয়া বন্ধু দেশ ছিল। কিন্তু শেষ সময়ে ইতালি গোপনে মৈত্রী-চুক্তি করে ফেলে ব্রিটেনের সঙ্গে। নাম লেখায় রাশিয়া-ফ্রান্স-ব্রিটেনের দলে। ক্ষুব্ধ অস্ট্রিয়া তখন ইতালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কখন তুষারঝড়, কখনও তাপমাত্রা শূন্যের ৩০ ডিগ্রি নীচে। এরই মধ্যে টানা তিন বছর ধরে চলে যুদ্ধ। শেষমেশ জিতে যায় ইতালি-ই। কিন্তু দু’দেশের লক্ষ লক্ষ তরুণ শয্যা নেয় আল্পসের বরফ-কবরে।
২০১২ সালেও পাওয়া গিয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দুই সেনার দেহ। হাড়গোড় পরীক্ষা করে দেখা যায়, এক জনের বয়স ১৮। অন্য জনের মাত্র ১৬। দেশের হয়ে ইতালীয় ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন তাঁরা। মাথায় গুলি লেগে মৃত্যু হয় দু’জনেরই। সালটা ছিল ১৯১৮। বিস্মিত প্রত্নতত্ত্ববিদরা বলছেন, “উদ্ধারের সময়ও এক জনের ইউনিফর্মে একটা চামচ আটকে ছিল। একেবারে অক্ষত!”
উদ্ধার হওয়া বেশির ভাগ দেহাবশেষেরই ময়নাতদন্ত করেছেন প্রত্নতত্ত্ববিদ ফ্র্যাঙ্কো নিকোলিস। বললেন, “এ সব দেখলেই মন খারাপ হয়ে যায়। ছেলেদু’টোর দেহ দেখেই ওদের মায়ের কথা মনে হচ্ছিল।” আল্পসের ৪০০ মাইল জুড়ে বরফের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বলি এমন লক্ষাধিক যুবকের দেহ। বরফ গললেই জেগে ওঠে মৃতের স্তূপ। কী না মিলেছে! জামা, জুতো, প্রেমিকাকে লেখা চিঠি, আরও কত কী। আল্পসের পুঁটা লিঁকে শৃঙ্গে তো গোটা একটা কেবলওয়ে স্টেশনই পাওয়া গিয়েছে। তার দেওয়ালে পিন দিয়ে লাগানো ছিল অসংখ্য চিঠি। সে অবস্থাতেই গোটা স্টেশন চাপা পড়েছিল বরফের তলায়। প্রায় এক শতক।
তবে অধিকাংশ স্মৃতিচিহ্নই অধরা থেকে যায়। “কারণ, গোটা দুনিয়ায় চোরের অভাব নেই”, আক্ষেপ নিকোলিসের। বললেন, “আমরা ওই সব হিমবাহে ঘেরা দুর্গম অঞ্চলে যেতে পারি না। তাই ভরসা করতে হয় অভিযাত্রীদের উপর। কখন তাঁরা খবর দেবেন। কিন্তু পুলিশ বা আমাদের খবর দেওয়ার আগে তাঁরাই দেহগুলো থেকে জামা-জুতো-অস্ত্র-চিঠি সব সরিয়ে ফেলে।” কী ভাবে এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন? ক্ষোভ উগরে দিয়ে চটজলদি জবাব তাঁর, “দেখেছি তো, অন লাইনে জিনিসগুলো কেমন চড়া দামে বিক্রি হয়। ইন্টারনেটে বেচবে বলে তো কেউ আর অত দুর্গম জায়গায় প্রাণ হাতে করে যায় না! অতএব এ সব অভিযাত্রীদেরই কাজ।”
বিতর্ক আরও অনেক। যা কিছু মিলেছে, সে তো গত এক দশকে। তার আগে এত দিন কেন কিছু উদ্ধার হয়নি? পরিবেশবিদরা বলছেন, কারণ একটাই ‘বিশ্ব উষ্ণায়ন’। আল্পসের যে অঞ্চলগুলো সারা বছরই বরফের চাদরে গা মুড়ি দিয়ে থাকে, গত এক দশকের গরমে তা পাথুরে রুক্ষ চেহারা বের করেছে। গত বছরটা অবশ্য ব্যতিক্রমী ছিল। নতুন করে কোনও কিছু মেলেনি। বরফও তেমন গলেনি।
ফের একটা গরম আসছে। এ বারেও হয়তো খালি হাতেই থাকতে হবে প্রত্নতত্ত্ববিদদের। বড়দিনের আগে থেকে একের পর এক তুষারঝড়ে বিধ্বস্ত ইউরোপ। পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, যে রহস্য এত দিন গা ঢাকা দিয়েছিল বরফের চাদরে, তা হয়তো ফের মুখ লুকোল। কে জানে কত দিনের জন্য!

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here