মহানন্দ অধিকারী মিন্টু, পাইকগাছা (খুলনা) প্রতিনিধি  ::

খুলনার পাইকগাছায় চিংড়ি উৎপাদন মৌসুমের শুরুতেই বিভিন্ন ভাইরাসে মারা যাচ্ছে বাগদা চিংড়ি। দিশেহারা মৎস্য চাষিরা। আবার বন্ধ হচ্ছে না চিংড়িতে অপদব্র পুশ। চিংড়ী উৎপাদন মৌসুমের শুরুতেই প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যাপকহারে পুশ বাণিজ্য চলছে। বিশ্ববাজারে ফের বাংলাদেশের চিংড়ীর মান নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

প্রশাসন পুশের অপরাধে কয়েকজন অসাধু ব্যবসায়ীকে জরিমানাও করেছেন। ভাইরাসের ব্যাপারে মৎস্য অফিস বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনে অনাবৃষ্টি, ঘেরে পানি স্বল্পতা, অতিরিক্ত পোনা মজুত, তাপমাত্রা ও পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারনে মাছ মরে যেতে পারে। এ কারনে চাষিরা এটাকে ভাইরাস সংক্রমণ বলে ধারণা করছে। আবার অনেকেই মনে করছে পানি ও খাদ্যই চিংড়ির ব্যাপক মড়কের জন্য প্রধানত দায়ী। কোনো ভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না বাগদা চিংড়ির মড়ক। আগ্রহ হারাচ্ছে চাষিরা। এমন অবস্থা চলতে থাকলে উপজেলায় চিংড়ির উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হতে পারে বলে ধারণা করেছেন মৎস্য বিভাগ।

জানাগেছে,সুন্দরবন উপকূলীয় এ উপজেলায় মোট কৃষি জমির পরিমান ৩০ হাজার হেক্টর। যার মধ্যে বর্তমানে প্রায় ১৭হাজার হেক্টর জমিতেই লবণ পানির চিংড়ি চাষ হচ্ছে। মৎস্য অফিস জানায়, এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৮ হাজার চিংড়ি ঘের রয়েছে। চলতি মৌসুমে উপজেলায় চিংড়ি উৎপাদন লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ হাজার মেট্রিক টন। যেভাবে মাছ মারা যাচ্ছে তাতে লক্ষমাত্রা নিয়ে সংশয় রয়েছে। উপজেলায় ৮০’র দশক থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শুরু হয় লবণ পানির চিংড়ি চাষ। সে থেকেই সোনাতন পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের ফলে মাটি অনুজ ও উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়ে গেছে।

এ কারনেই চিংড়ি মাছ মরার আরেকটি কারন হতে পারে বলে সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জানান। দেলুটি ইউনিয়নের চিংড়ি চাষি কার্ত্তিক চন্দ্র মন্ডল জানান, আমার ২০ বিঘার একটি মৎস্য ঘের রয়েছে। বছরের প্রথমে ঘের প্রস্তুত করে বাগদার পোনা ছেড়েছি। ঠিক ৪২ দিনের মাথায় মাছ মরতে শুরু করে। লতা ইউনিয়নের অসিতবরণ বলেন, আমার ৪০ বিঘা ঘের রয়েছে। গত দুই বছর ঘেরে ভালো মাছ হয়নি। সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে এবছর ঘের করেছি। উৎপাদনের শুর থেকেই মাছ মরতে শুরু করেছে। একদিকে সমিতির কিস্তির টাকা অন্য দিকে সংসার চলাতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছি।

চিংড়ি চাষি রেজাউল করিম বলেন, এ বছর মৌসুমের শুরুতেই ঘেরে দেখা দিয়েছে চিংড়িতে মড়ক। এখন পর্যন্ত অনেকে মাছ বিক্রি করতে পারেননি। অনেক ঘেরে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় সকল মাছ মারা গেছে। ঘোষাল গ্রামের অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক মোজাম্মেল হক বলেন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের অনেকেই লাভের আশায় বছরের পর বছর ধার-দেনা করে চাষাবাদ টিকিয়ে রাখে। সফলতা না আসায় এক সময় ঋণের চাপ সইতে না পেরে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন অনেকেই। আবার কেউ কেউ সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছেন।  দুই এক বছর মাছ কিছুটা ভাল হওয়ায় ফের কোমর বেঁধে মাঠে নামেন চাষিরা। তবে মৌসুমের শুরুতেই চিংড়ি ঘেরে আবারো মড়ক অব্যাহত থাকায় নতুন করে বন্ধের উপক্রম হয়েছে সম্ভাবনাময় এ শিল্প।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা পবিত্র কুমার দাশ বলেন, বাগদা চাষের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর লবণসহিষ্ণু মাত্রা হলো সর্বোচ্চ ২৫ পার্টস পার থাউস্যান্ড (পিপিটি)। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারনে পরিবেশের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। পাশাপাশি চিংড়ি চাষের জন্য যে পরিমাণ পানি প্রয়োজন, তা ঘেরগুলোতে নেই। অনাবৃষ্টি, ঘেরে পানি স্বল্পতা, অতিরিক্ত পোনা মজুত ও তাপমাত্রা ও পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারনে মাছ মারা যাচ্ছে। অপর দিকে বাগদা চিংড়ি পোনার দাম কম হওয়ায় চাষিরা অতিরিক্ত পোনা ছেড়েছে। সে কারনে অতিরিক্ত পোনা ছাড়ার কারনে খাদ্য ঘাটতির পাশাপাশি মাছের ঘের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় মাছ মারা যাচ্ছে।

প্রতি বিঘা জমিতে ৫শ’ মাছ ছাড়ার কথা থাকলেও চাষিরা বিঘা প্রতি ৫ হাজার মাছ ছেড়েছে। এ কারনে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। ঘেরে পানি বৃদ্ধি, খাদ্য ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। এদিকে ১৮মে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা পবিত্র কুমার দাস
কপিলমুনি মৎস্য আড়ৎ ও কাশিমনগর চিংড়ি মার্কেচ থেকে ৫ ক্যারেট পুশ কৃত চিংড়ি জব্দ করেন। একই সাথে পুশ করার অভিযোগে রায়পুর গ্রামের অর্জুন কুমার ও তপন মন্ডলকে ৩ হাজার করে ৬ হাজার এবং উত্তর সলুয়া গ্রামের হাফিজুর রহমানকে ১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এর আগে ১৩মে কপিলমুনি বাজার থেকে পুশকৃত ৪০কেজি চিংড়ি জব্দ ও পুশ করার অপরাধে রামনগর গ্রামে হাসান মোড়লকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করেন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here