মহানন্দ অধিকারী মিন্টু, পাইকগাছা (খুলনা) প্রতিনিধি ::
প্রযুক্তির ফাঁদে ফেলে খুলনার পাইকগাছায় ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি নিধন চলছে। উপজেলার বিভিন্ন জলাশয় ও চিংড়িঘের থেকে সংঘবদ্ধ শিকারী চক্র মোবাইলে বিদেশী অতিথি পাখির ডাকের অডিও শুনিয়ে প্রলুব্ধ করে নীচে নামিয়ে ফাঁদে ফেলে প্রতিদিন রাতে শিকার করছে অতিথি পাখি। পাখি নিধন বন্ধে পুলিশ প্রশাসনের যোগসাজশের অভিযোগ অনেকের।
নাম না প্রকাশে অনিইচ্ছুক একজন জানান, উপজেলার লতা ইউনিয়ন থেকে বুধবার পুলিশ অতিথি পাখি নিধন ফাঁদ অ্যামপ্লিফায়ার, ব্যাটারী উদ্ধার করে আনলেও শিকারীদের আটক করা হয়নি। পরে এ দিন সন্ধ্যায় থানা থেকে পাখি নিধন ফাঁদ ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। শীতের শুরুতেই পৃথিবীর বিভিন্ন শীত প্রধান দেশগুলো থেকে কিছুটা উষ্ণতার আশায় হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে দল বেঁধে বাংলাদেশের বিলাঞ্চলে আসে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি। তবে শিকারী চক্রের নিয়মিত অত্যাচার ও অভয়াশ্রমের অভাবে এক প্রকার অবাধে প্রতিনিয়ত অতিথি পাখি নিধন হচ্ছে। এরপর যোগান হচ্ছে রসনা বিলাসের। পাখি শিকার বন্ধে সরকার কঠোর আইন প্রনয়ন করলেও নানা সংকটে এক দিনের জন্য হলেও বন্ধ হচ্ছে না পাখি শিকার।
উপজেলার পৌরসদর থেকে কয়রা অভিমুখে শিববাটী ব্রিজ পার হয়ে অনতিদূরে নির্মাণাধীন কৃষি কলেজের বিপরীতে শামীম হোসেনের ইব্রাহীম গার্ডেন’ নামে বনায়ন প্রকল্পটি অবস্থিত। দিনের শেষে সন্ধ্যার পর থেকে বালিহাঁস, দলকচু, খয়েরী ও দেশীয় বকসহ দল বেধে বিভিন্ন প্রজাতির হাজার হাজার অতিথি পাখি সহ দেশীয় পাখি আশ্রয় নেয় ইব্রাহীম গার্ডেনে। উপজেলার সোলাদানা, গড়উখালী, চাঁদখালী বয়রা, কচুবুনিয়া, বাসাখালী, বাইসারাবাদ, তেঁতুলতলা, লতা, উলুবুনিয়া, পুটিমারী, শংকরদানা, হানিমুনকিয়া, বাহিরবুনিয়া, দেলুটি, সোলাদানা, কপিলমুনি, তালতলা, গোয়ালবাথান, শ্রীফলতলা, প্রতাপকাটি, শামুকপোতা, চকবগুড়া, খড়িয়া, অকাইবাসী, ঠাকুনবাড়ী, আমিরপুর, বাইনবাড়ীয়া, কুমখালী ও পৌরসভার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিভিন্ন এলাকায় বড় বড় খাল-বিল, জলাশয় ও চিংড়ি ঘের রয়েছে। প্রজাতি ভেদে সকাল অথবা সন্ধ্যা নামতেই বিভিন্ন প্রজাতির এসব অতিথি পাখিরা দল বেঁধে খাদ্য সংগ্রহে নেমে পড়ে।
এ সময় সংশ্লিষ্ট ঘের বা জলাশয়ের কর্মচারীদের যোগসাজশে অথবা শিকারী চক্র আগে থেকেই ওৎ পেতে থাকে পাখি শিকারে। স্থানীয়রা জানান, এর আগে তারা বিভিন্ন মাছ ও ফড়িং জাতীয় কীট-পতঙ্গে বিষ, ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে রাখতো। কোথাও কোথাও পেতে রাখা হয় ফাঁদ। এভাবে শিকারী চক্র প্রতিদিন ফাঁদ ও বিষ টোপ দিয়ে বিভিন্ন জাতের পাখি শিকার করতো। তবে এখন এসব পাখি শিকারে শিকারী চক্র প্রযুক্তির সহায়তায় সহজেই বোকা বানাচ্ছে এসব পাখিদের। গুগল থেকে সার্চ দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির ডাক ডাউনলোড করছে স্ব-স্ব মোবাইলে। এরপর রাতের আকাশে পাখিদের আনাগোনা দেখে অ্যামপ্লিফায়ার ও মোবাইলে ওইসব পাখির ডাক বাজানো শুরু করছে। এরপর পাখিরা ওই টোন শুনে মনে করছে তার অন্যান্য সাথীরা সেখানে নিরাপদে অবস্থান করছে।
আর শিকারীদের এসব নিত্য নতুন প্রতারণায় প্রলুব্ধ হয়ে নীচে নামতেই জড়িয়ে পড়ছে পেতে রাখা ফাঁদে। এভাবে প্রতিদিন শিকার হচ্ছে অসংখ্য অতিথি পাখি। সোলাদানা ইউনিয়নের রবিন মন্ডল বলেন, শুধু কি লতা ইউনিয়ন সমস্ত পাইকগাছা থানা জুড়ে চলছে অতিথি পাখি নিধন। অতিথি পাখির ডকের মতো মিউজিক বাজালে ফাঁকা জায়গায় তাদের সাথি সঙ্গীরা আছে মনে করে নেমে পড়ে, আর সেখানে থাকে জালের ফাঁদ পাতা এভাবে চলে নির্মম পাখি গণহত্যা, রাত হলে এ মিউজিকের শব্দ শোনা যায়। দিনের বেলা যেখানে সেখানে বাশ পুতে ফাঁদ পাতার দৃশ্য হরহামেশাই দেখতে পাওয়া যায়। তার মনে হয় পাখি নিধনের রেফারি হল পুলিশ, না হলে পুলিশ আসে কিন্তু কয়েক ঘন্টা মিউজিক বন্ধ হয়। তারপর সব আগের মত, পুলিশ বোধহয় পাখির ভাগ নিতে আসে। কারেন্ট পোকা সহ অন্য ক্ষতি কর পোকা খেয়ে পাখি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এজন্য এদের বাঁচিয়ে রাখা আমদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব।
বরুন পদ মন্ডল বলেন, শুধুমাত্র লতা নয়, এই অকাজ অনেক জায়গাতেই হচ্ছে। থানার অনেক বড় বাবুরাও এখানে সামিল বলে খবর আসছে। পাইকগাছা নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রশান্ত কুমার মন্ডল জানান, প্রতিবছর শীতের শুরুতেই শীত প্রধান দেশগুলো থেকে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি আমাদের দেশে আসে। এরা মূলত শীত ভর করে নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে শুরু করে মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত এলাকায় অবস্থান করে। এরপর আগতদের মধ্যে বেঁচে থাকারা উড়াল দেয় নিজ দেশে। তবে এদের থাকার জন্য তেমন কোনো নিরাপদ আশ্রয়স্থল বা অভয়াশ্রম না থাকায় শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে আসা অতিথি পাখিদের অধিকাংশরাই প্রবাসেই নিধন হয়।
তিনি আরো বলেন, পাখি শিকার বন্ধে মনিটরিং সহ প্রশাসনীক ব্যবস্থা জোরদারের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধির দাবি জানান।
থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জিয়াউর রহমান জিয়া, পাখি শিকারের ব্যাপারে তথ্য পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ সহ আজই অভিযান দিবেন বলে জানান।