শামসুন নাহার রহমান পরাণ (১৯৪০-২০১৫) প্রতিষ্ঠাতা-ঘাসফুল

ছালেহা বেগম::

‘‘তোমরা আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি দেব। নেফোলিয়ান বোনাপার্ট এর শিক্ষিত মা তৈরির পথিকৃত এ প্রজন্মের নারী বেসরকারি সংস্থা ঘাসফুলের প্রতিষ্ঠাতা পরাণ রহমান (১৯৪০-২০১৫)। ৮ মার্চ নারী দিবসে নারী জাগরণের পথিকৃত পরাণ রহমানকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধার সাথে। হে মহিয়সী আপনার চরণে অতল শ্রদ্ধা।

আজকের বহুল পরিচিত ও ঐতিহ্যবাহী উন্নয়ন সংস্থা ঘাসফুল। প্রান্তিক মানুষের প্রতীক হিসেবে পদদলিত, বঞ্চিত ফুল দিয়েই তিনি সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চেয়েছিলেন তিনি। তিনি অসহায় নির্যাতীত পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠি, নারী, শিশুদের মানবমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নিজেকে উৎসর্গ করলেন। মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ থেকে তার প্রতিষ্ঠিত সংস্থার নামকরণ করেন ঘাসফুল। যার ফলশ্রুতিতে দেখা যায় ঘাসফুল এর বহুমূখী কল্যাণমুলক কাজের বদৌলতে চট্ট্রগ্রামের সর্বস্তরের জনগণের কাছে পরাণ আপা নামেই সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করেন।

পরান রহমান ছিলেন সমাজের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের ভরসা ও আশ্রয়ের স্থল। যদিও তাঁর জীবনযাপন ছিলো মধ্যম পন্থীয়।  চলাফেরা ছিল সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের সাথে। এদিক থেকে বিচার করলে নিসন্দেহে তিনি উত্তম মনের অধিকারী ছিলেন। সমাজে চলেছেন তফাৎ বিহীন। একজন ভালো সংগঠক ও উত্তম উন্নয়নকর্মী ছিলেন। পরাণ রহমান সব সময় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। সবাই তাকে আপন করে নিয়েছে খুব সহজেই।

একজন পরাণ রহমানকে আমরা চিনি তার সমাজসেবার কারণে। সমাজের প্রতিটি সেক্টরে তার বিচরণ ছিল অসাধারণ। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ভেঙ্গে নারীদের আলোর পথে আনতে সারাজীবন লেখে গেছেন বেগম রোকেয়া আর প্রয়াত পরাণ রহমানও নারীদের অধিকার ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে নারী মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন লক্ষ লক্ষ নারীকে। গড়ে তুলেছেন সমাজের উন্নয়নমূলক এনজিও ঘাসফুল। সমন্বয় করেছেন বেসরকারি এনজিওগুলোর মধ্যেও। আজ তাই পরাণ রহমান এনজিও উন্নয়ন সেক্টরে একজন অতিপরিচিত এবং নন্দিত নারী ও নারী মুক্তির প্রতীক।

যেসময়ে নারীদের ঘরের বাইরে আসাটাই ছিল একটা বড় বাধা সে সময়ে নারীদের হয়ে সমাজকর্মে পদার্পণ করেন পরাণ রহমান। সমাজের বিধিনিষেধের কঠিন প্রাচীর ভেঙ্গে তিনি শুধু একা বেরিয়ে আসেননি, অন্য নারীদের বের হবার পথও সুগম করেছেন। উন্নয়ন সেক্টরে কাজ করতে আগ্রহী পুরুষদের জন্যও তার চিন্তা ছিল মাইলফলক। উন্নয়ন সেক্টরে কাজ করতে আগ্রহী আজকের প্রজন্মের কাছে পরাণ রহমান একটি প্রতিষ্ঠান।

আজ পরাণ রহমানকে নিয়ে গবেষণা হয়, আলোচনা হয় কিন্তু তিনি আজ নেই আমাদের মাঝে।  একাত্তরের মক্তিযুদ্ধে নির্যাতীত বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে, দেশের অভ্যন্তরে শেল্টার ফোর্স হিসেবে লড়াই করেছেন দেশমাতৃকার জন্য। যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশ পুর্নগঠনের জন্য রিলিফওয়ার্ক কাজের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক সমাজকর্মে আত্মনিয়োগ করেন নিজেকে। তিনি সমাজের অচ্ছুত সম্প্রদায়ের দলিত/ হরিজন কমিউনিটি, উপকুলীয় জেলে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি সাঁওতাল, ওঁরাও সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়ন, শিশু অধিকার, প্রবীণ অধিকার নিয়ে কাজ করেছেন। সত্তরের দশকে ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের রিলিফ ওয়ার্কের মাধ্যমে আর্তমানবতার সেবায় জড়িয়ে নেন।

বর্তমানে ঘাসফুল বাংলাদেশের ছয়টি জেলায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় চার লক্ষ মানুষের কাছে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের সুফল পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। ঘাসফুলের মাধ্যমে সমাজের বহুবিধি উন্নয়নের জন্য সরকার পরাণ রহমানকে মৃত্যু পরবর্তী বেগম রোকেয়া পদকে ভুষিত করেন। রাষ্ট্রিয় এই সম্মান বেগম রোকেয়ার যোগ্য উত্তরসুরি হিসেবে পরাণ রহমানের যথার্থ মুল্যায়ন। এ জন্য ঘাসফুলের পক্ষ থেকে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আজ এ সম্মান শুধু পরাণ রহমানের একার নয়, এ সম্মান সমগ্র বাংলার নারীদের।

পরাণ রহমানকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন, তারা জানেন মানুষ হিসেবে তিনি কতটা সমাজহিতৈষী ছিলেন। তাঁর কাজের সুফল ভোগ করছে আজ লক্ষ লক্ষ মানুষ।  দেশে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের কথা চিন্তা করে তাদের শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা প্রদানে এবং মা-বাবার মৃত্যুর পর নিরাপদ জীবন-যাপনের লক্ষ্যে ট্রাষ্ট গঠনের মাধ্যমে স্থায়ী আবাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। সমাজের বিধবা ও ডিভোর্সী নারীদের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন। সবসময় তাদের কর্ম-সংস্থান সৃষ্টির জন্য উদ্বিগ্ন থাকতেন। এ জন্য চট্টগ্রামে একটি অত্যাধুনিক স্থায়ী প্রবীণ নিবাস স্থাপন করতে চেয়েছিলেন।

পরাণ রহমান চট্টগ্রামে প্রথম প্রশিক্ষিত ধাত্রী নিয়ে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতকরণে কাজ শুরু করেন, যা বর্তমানে জাতীয় নিরাপদ শিশু জন্ম কার্যক্রমভুক্ত হয়। চট্টগ্রমে তিনিই প্রথম হরিজন (মেথর) সম্প্র্রদায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ শুরু করেন।

পরাণ রহমান বিশ্বাস করতেন, উন্নয়ন পরিকল্পনা নীচ থেকেই শুরু করা উচিত। তিনি সরাসরি অনগ্রসর সুবিধাবঞ্চিত এসব জনগোষ্ঠীর কাছে গিয়ে মূল সমস্যা উপলব্দি করার চেষ্টা করতেন। বাংলাদেশে গার্মেন্টসশিল্পের একেবারে শুরুর দিকে তিনি সর্বপ্রথম পোষাক শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে কাজ শুরু করেন। তিনি সেলাই সহায়িকা পুস্তিকা তৈরী করে অস্বচ্ছল পরিবার এবং বস্তিবাসী মেয়েদের স্ব-প্রণোদিত হয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। বে-অব-বেঙ্গল প্রজেক্টের মাধ্যমে উপকুলীয় জেলেদের দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ, সংরক্ষণ, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম (জাল/নৌকা) ইত্যাদি বিতরণের কাজ শুরু করেন এবং পুঁজির যোগান দেন। নওগাঁর আদিবাসী সাঁওতাল, ওরাঁও সম্প্রদায়ের সহজ-সরল মানুষগুলোকে সবাই অবহেলা-অবজ্ঞা ও ঘৃণা করতো।

প্রবীণ অধিকার আন্দোলনে প্রবীণ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় সংগঠকদের মধ্যে তিনি একজন অগ্রসৈনিক ছিলেন। তিনি জাতীয় পর্যায়ের প্রবীণ সংগঠন প্রবীণ অধিকার ফোরাম, প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান ইনষ্টিটিউট প্রতিষ্ঠার দাবীসহ বিভিন্ন ইস্যুতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সামাজিক সংগঠন পরিচালনা এবং স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন।

পরান রহমান ১১ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন। অবসরে তিনি ছোটগল্প, কবিতা, এবং পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন চলমান ইস্যু নিয়ে লেখালেখি করেন। লেখক হিসেবেও তিনি সমাদৃত ছিলেন পাঠক মহলে। তাঁর লেখা ১০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তার জীবদ্দশায়।

আত্মপ্রচারবিমুখী এই মহিয়সী নারী সত্যিই এক বিচিত্র এবং বর্ণিল জীবন রেখে গেছেন আমাদের মাঝে। নারী মুক্তির আন্দোলনে নারীদের জন্য যে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন যেকজন নারী, তাদের অন্যতম আমাদের পরাণ আপা। আন্তজার্তিক নারী দিবসে কৃর্তীমান এই নারীকে স্মরণ করছি রবীন্দ্রনাথের ভাষায়…

তুমি রবে নীরবে/হৃদয়ে মমতুমি রবে নীরবে/নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমা নিশীথিনী সম

নিশীথিনী সম/তুমি রবে নীরবেহৃদয়ে মম/তুমি রবে নীরবেনিবিড় নিভৃত পূর্ণিমা নিশীথিনী সম

লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, ইউনাইটেড নিউজ২৪.কম

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here