মোতাহার হোসেন :: করোনা মহামারিতে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বই আজ প্রায় স্থবির। অর্থনীতি, সংস্কৃতিসহ মানুষের স্বাভাবিক সব কর্মকাণ্ডে ছন্দপতন ঘটেছে। শিল্প,কলকারখানা,উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে ধীর গতিতে। ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকাসহ বিশ্বের বহু দেশ করোনা থেকে পরিত্রাণে ফের লকডাউনে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এপ্রিল মের দিকে লকডাউন ছিল। মানুষের জীবন ও জীবিকার চাকা সচল রাখতে করোনা ধাক্কার শুরুর দিকে সরকার এক লক্ষ সাতাশ হাজার কোটি টাকার ‘অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজ’ ঘোষণা এবং তা দ্রুতই বাস্তবায়ন শুরু করেছে। দ্বিতীয় দফায় সদ্য আরো ১৬ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘সাহসী ও সময়োচিত’, ‘এই ‘অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজ’ই মূলত: দেশের উন্নয়ন, অর্থনীতির চাকাকে সচল, সক্রিয় রাখার পাশাপাশি মানুষের জীবন ও জীবিকার চাকাকে সচল রেখেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে চারটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে করোনাকালে তার সবগুলোই মোটামুটি আশাজনক অবস্থানে। তবে বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে কৃষি ও কৃষক।

করোনা সংক্রমণেরকালে প্রথম দিকে রেমিটেন্স, রির্জাভ, রপ্তানি আয় কিছুটা কম হলেও এখন ধীরে ধীরে সেইসব সেক্টর ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। শুধু তাই নয় দেশকে সম্ভাবনাময়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে ‘কৃষি ও কৃষক’। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কৃষক ও কৃষিবান্ধব কৃষিমন্ত্রী, কৃষিবিদ, কৃষক এবং কৃষির সাথে সম্পৃক্ত বিজ্ঞানী, গবেষক, কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি তথ্য সার্ভিস, বাংলাদেশ ধান গবেণষা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের সর্বস্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীরা এই কৃতিত্বের দাবিদার। করোনাকে উপেক্ষা করে আমাদের খাদ্য উৎপাদন ক্রমাগত বৃদ্ধি ও পুষ্টির নিশ্চয়তা বিধানে নিরন্তর কাজ করা সেইসব কৃষক- কৃষানি, কৃষি শ্রমিক, কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষি গবেষক, কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষিতথ্য সার্ভিস, বিএডিসি, ধান গবেণষা ইনস্টিটিউটের সর্বস্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীকে জাতির পক্ষ থেকে অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ। একই সাথে  কৃষক ও কৃষিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে নের্তৃত্বের অগ্রভাগে থেকে কৃষি-কৃষকবান্ধব কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক এর প্রতিও বিনম্র শ্রদ্ধা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিতে বিশেষ প্রণোদনসহ প্রয়োজনীয় সহায়তায় উন্নয়ন,উৎপাদনের  গতি সচল রাখায় ঘুরে দাঁড়ানো কৃষিখাতের সাফল্যে তাঁর প্রতিও অশেষ কৃতজ্ঞতা। প্রসঙ্গত:‘করোনাকালের অর্থনীতি-করোনাত্তোর অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং আগামী বাজেটে অগ্রাধিকার খাত কি হওয়া উচিৎ’ শীর্ষক সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনায়ও দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড়ো স্বাস্থ্য বিপর্যয় করোনা সংক্রমণ। এ জন্য পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্র বা সরকারই প্রস্তুত ছিলনা। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তবুও সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপে অন্য যে কোনো দেশ অপেক্ষা আমাদের করোনা পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি করোনাকালে মানুষের ‘জীবন ও জীবিকাকে’ সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ঘোষিত একলক্ষ ২৭ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ’ বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকায় এর সুফল মিলছে দেশের সব সেক্টরে। বিশেষ করে আমাদের রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, কৃষি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে ইতিবাচক অগ্রগতি সাধিত হয়। পরিসংখ্যান বলছে, এই করোনায় দেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে সম্ভবনাময় দেশের কৃষি ও কৃষক। শুধু ভাতের সংস্থান করা নয়, সবজি, মাছ, ডিম, মুরগি, দুধ, মাংস, ফল কোনো কিছুর-ই অভাব বোধ করতে দেয়নি এই খাত। লকডাউনের মধ্যে বিগত ধান কাটার মৌসুমে কৃষি শ্রমিকের সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কৃষিমন্ত্রী ও তাঁর দফতর, কৃষিসম্প্রসাণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে শ্রম ঘন এলাকা থেকে বাস ট্রাকে শ্রমিক পাঠিয়ে যথাসময়ে ধান কাটা, মাড়াই করে কৃষকের ঘরে তুলে দিতে সহায়তা করার এক অনন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সরকার। যার ফলে কৃষক ও কৃষকের উৎপাদিত ফসল রক্ষা পেলো বিপর্যয় থেকে। মনে রাখা দরকার, দেশের জাতীয় অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে কৃষি, তৈরি পোশাকশিল্প এবং প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের।

জাতিকে ক্ষুধামুক্ত রাখতে এবং অপুষ্টি থেকে বাঁচাতে আমাদের কৃষক ও কৃষিবিজ্ঞানীদের অবদান খুব কমই আলোচিত হয়। বাংলাদেশ এখন খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে, তার পেছনে ময়মনসিংহসহ দেশের অপরাপর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের অবদান রয়েছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা কৃষি সেক্টরকে আধুনিকায়ন করতে ভূমিকা রেখছেন। ধান, গম, ডাল, তৈলবীজ, ইক্ষু, শাক-সবজি থেকে শুরু করে ফলমূলের উৎপাদন, পশুপালন, হাঁস-মুরগি পালন, মৎস্য পালন প্রভৃতি ক্ষেত্রে কৃষকদের সহযোগিতা করেছেন।

করোনাকালে সুপার সাইক্লোন আম্পানের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয় দেশের কৃষিখাত। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে দেশের ২৫/২৬টি জেলায় কৃষি ফসলের ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমির, টাকার অংকে ১ হাজার ১০০ কোটি। কয়েক দফায় বন্যাও কৃষির ক্ষতি হয়েছে। মৌসুমি ফল আম, লিচু ছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ে বোরো ধান, পাট, পান, তিল, শাকসবজি ও আউশ ধানের চারারও ক্ষতি হয়েছে প্রচুর। আম্পানে বেড়িবাঁধ ভেঙে বহু কৃষকের বাড়িঘর তলিয়ে গেছে, লোনা পানি ঢুকে ফসলের জমি চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে, এমনকি গবাদি পশুও মারা গেছে। এসব সত্বেও সরকারের প্রয়োজনীয় সহায়তায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের কৃষি সেক্টর। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বলছে, বিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রভাবে বড়ো দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা রয়েছে। এতে তিন কোটি মানুষ প্রাণ হারাতে পারে। তাই আগামীতে যাতে খাদ্যের কোনো সংকট না হয়, সেজন্য সরকারি গুদামে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি খাদ্যশস্য মজুদ করেছে সরকার।

২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটে খাদ্য ও কৃষিতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৫ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটের চেয়ে ২ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা বেশি। এছাড়া করোনা-উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রণোদনা সুবিধার আওতায় ৪ শতাংশ রেয়াদি সুদে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কৃষিঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ঋণ জামানত ছাড়া কৃষিকাজে সরাসরি নিয়োজিত প্রকৃত কৃষক; ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, বর্গাচাষিসহ অন্যদের প্রদান করা হবে। এছাড়া ফুল, ফল, মৎস্য চাষ ও পোলট্রি খাতে ৪ শতাংশ সুদে আরো ৫ হাজার কোটি টাকা বিশেষ প্রণোদনা স্কিম গঠন করা হয়েছে। ফলে কৃষিখাতে মোট ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঋণপ্রবাহ সৃষ্টি হবে। এ ঋণের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে করোনা ও আম্পানের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে দেশের কৃষিখাত।

দেশের জনসংখ্যা প্রায় অধিকাংশ মানুষের ডিম ও হাঁস-মুরগির মাংসের চাহিদা পূরণ হচ্ছে পোলট্রি খামার থেকে। এতে করে একদিকে যেমন বেকারত্ব কমেছে, অন্যদিকে প্রোটিনের বা আমিষজাতীয় খাদ্যের অভাব কমেছে। সবজি সংরক্ষণের জন্য দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাকৃতিক হিমাগার তৈরির উদ্যোগ নেয়া দরকার। শাকসবজির সংরক্ষণে প্রাকৃতিক হিমাগার তৈরিতে বরাদ্দ দিলে অর্থনীতিতে যোগ হবে হাজার হাজার কোটি টাকা। এখানে প্রাসঙ্গিক যে, সরকারি কর্মকর্তারা উৎসব ভাতা পান, চিকিৎসা ভাতা ও বৈশাখি ভাতাও পান। কলকারখানার শ্রমিকেরা বোনাস পান, ধর্মঘট করে নানা দাবি আদায় করেন। এদের সবার বছরে নানা রকম ছুটি আছে। কিন্তু কৃষকের কোনো ছুটি নেই। করোনায় লকডাউনকালে সরকারি চাকুরিজীবীদের অনেকেই ঘরে ছিলেন। কিন্তু আমাদের কৃষক ও কৃষি বিভাগের কর্মীরা নিয়মিতই মাঠে ছিলেন। তাঁদের ভোরে উঠে জমি তৈরি করতে হয়। খেতে সার দিতে হয়। সেচের পানি দিতে হয়। শস্য তোলার সময় হলে তা মাঠে ফেলে রাখা যায়না। তাই কৃষককে নগদ সহায়তাসহ তাঁদের সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া দরকার।

এক কথায় অগ্রসর কৃষিখাতকে অধিক মাত্রায় সমৃদ্ধ করতে বহুমুখী পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে। সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা ইতোমধ্যে কৃষিক্ষেত্রে বড়ো পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে বহুবিধ পরিকল্পনা। কৃষিক্ষেত্রে সমৃদ্ধির উচ্চশিখরে আহরণে আমাদের বেশ কিছু ক্ষেত্রে কাজ হাতে নিতে হবে। কৃষিবান্ধব সরকারের কৃষিবান্ধব বিভিন্ন পরিকল্পনার মাধ্যমে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। আগামীর প্রতিটি পরিকল্পনা আমাদের জন্য আর্শীবাদ হয়ে আসবে। উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে উন্নত হবে দেশের কৃষি আমাদের এ স্বপ্ন অচিরেই পূরণ হবে এ প্রত্যাশা হোক সকলের।

পিআইডি ফিচার

 

 

মোতাহার হোসেন: সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জা জার্নালিস্ট ফোরাম।

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here