পুতুলনাচের ইতিকথাঃঃ মনের ভিতরে সহস্র তারাদের ছুটোছুটি ঘোর লাগা চাঁদোয়া রাতের দীর্ঘময়তার আবেদন

শামসুদ্দিন হীরা

ব্যস্ততায় কোন বই একটানে পড়া হয় না আমার।
অল্প অল্প করে পড়ে এগিয়ে যাই আবারও কয়েক পাতা রিউন করে পড়তে হয়। পড়া শুরু করেছিলাম বাংলার অমর উপস্যাস মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা। উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদেই একটি পুতুলের অস্তিত্ব প্রকাশ পায়। বকুল তলায় পড়ে-থাকা ন্যাকড়া-জড়ানো পুতুলটি যে শ্রীনাথের মেয়ের পুতুল, তা বুঝতে পারে ডাক্তার শশী। আর সে এও অনুভব করতে পারে যে, ভোর বেলায় গ্রামের মেয়েরা পুতুলটিকে দেবতা-প্রেরিত বলে ভেবে নেবে। বলা যায়, একরকমভাবেই ঔপন্যাসিক শশী এবং গ্রামবাসীর মধ্যকার পার্থক্যের সুতো বেঁধে দেন। কিছু কিছু গল্প আছে নিস্তরঙ্গ জলের দীঘির মতো নিজেকে ডুবিয়ে ভাসিয়ে সাঁতরিয়ে তীরে এনে লীন করে দেয়। মনের ভিতরে সহস্র তারাদের ছুটোছুটি ঘোর লাগা চাঁদোয়া রাতের দীর্ঘময়তার আবেদনে। নিজের ভাবনার সুতোর জালে নিজেই আটকে পড়ি,অনেকটা অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে পুতুল নেচে যায় যাপিত জীবনের আবাহনে। একজন মহৎ লেখকই পারেন এমন ব্যথাময়তায় গ্রামীন চিত্রকল্পে সমস্ত চরিত্রকে পাঠককের সাথে একাকার করে দিতে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে বিশ্বাস করিয়েছেন গাওদিয়া আমারই দেখা মুন্সিগঞ্জের হয়তো কোন গ্রাম। যে গ্রামে আমার পূর্বপুরুষদের মাটির গন্ধ বইয়ের পাতায় খুঁজে পাই। গোপাল-শশী-পরান-কুসুম-যামিনীকবিরাজ সেনদিদি- যাদব পণ্ডিত-পাগলাদিদি-নন্দলাল- বিন্দু-কুমুদ- মতি, বনবিহারী, জয়া যেন আমাদের গাঁয়েরই আপনজন। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই স্বতন্ত্র জীবন বৈচিত্র্যে স্বার্থক। আমার কাছে কাহিনির মূল চরিত্র বলে অন্য চরিত্রকে খাটো করতে পারবো না, প্রতিটি চরিত্রই জীবন্ত গতিময়। উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ন চরিত্র শশী। শশী-কুসুম সম্পর্ককে শারীরবৃত্তীয় জটিলতা থেকে ঊর্ধ্বে নিয়ে দেখিয়েছেন, মন মানুষের জটিলতার কেন্দ্র,শরীর কেবল বাহ্যিক আবরণ। শশী নিজের সাথেই অন্তযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া পরাজিত এক সত্তা। হৃদয়,আবেগের বশবর্তী হয়েও সে চায় যুক্তি দ্বারা জীবন চালনা করতে।তাই সে বারবার নিজের কাছে নিজেই পরাজিত হয়।কুসুম শশীকে ভালোবাসে।সামাজিক বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা না করেও শশীকে প্রেম নিবেদন করে নানা উপায়ে।কিন্তু শশীর বিক্ষিপ্ত মনের অস্থিরতা তার অনুভূতিগুলোকে অবহেলা করে। মৃত্যু ঘটে কুসুমের হৃদয়ের।প্রকৃতপক্ষে মানবসৃষ্ট এই সঙ্কীর্ণ সমাজে আমরা অনেকেই শশীর মতই বেঁচে থাকি।নিজের আবেগকে জোর করে অবদমিত করি সামাজিকতা নামক এক দুর্ভেদ্য যুক্তির জালে জড়িয়ে। কুসুম অন্যের গৃহবধু হয়েও শশীকে ভালবেসে ফেলা গ্রামীন এক সহজ নারী। স্বামী পরানকে ছেড়ে শশীকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। শশী ততটাই শীতল। মর্মান্তিক উদাসীনতায় বলা তার সেই কথাটি ‘তোমার মন নাই কুসুম !’সংশয়াচ্ছন্ন শশীর রূপ যেমন প্রকাশ করে দেয়, তেমনি ইঙ্গিত দেয় এই সম্পর্কের পরিনতির। বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে রওয়া শব্দকয়টি কত কিছুরই না উৎস মুখ খুলে দেয়। ডাক্তার শশীর বন্ধু কুমুদ এই কাহিনীর এক বৈচিত্র্যময় চরিত্র। অত্যন্ত স্নিগ্ধ মোলায়েম ছন্নছাড়া ছেলে। নাট্যদলের সাথে গ্রাম গঞ্জে ঘুরে বেড়ানো এক বোহেমিয়ান জীবন। বই পড়া নাটকে পাঠ গাওয়া এক মানবিক চরিত্র কুমুদ। তার জীবনে ঘুর্ণিবাতের মতো প্রেমের ঝড় বইয়ে দেয় মতি নামের কিশোরী মেয়েটি। আশ্চর্য-হৃদয়তোলপাড়-করা তুমুল–তীব্র প্রেমে মতিই কুমুদকে করেছে প্রার্থনীয়, আকাঙ্ক্ষার্হ। প্রেম যে সমকালীন সবকালীন মতিকে দেখে বারবার মনে হয়েছে তা। “কুমুদ যখন বই পড়ে, কাজের ফাঁকে বারবার তার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতে পারিয়াই কত সুখ হয় মতির; কুমুদ যখন বাহিরে থাকে তখন দেখে মনে হয় অকারণে কি এক অভিনব পুলকপ্রবাহ অবিরাম বহিয়া যায়।’ আহারে প্রেম – কি সবল , কি সরল ! রবীন্দ্রনাথের মতো, অনুভবে এবং প্রকাশে । মতির মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দৃশ্যে সুধা ছড়ানো রয়েছে- কি অপূর্ব সুখকণা বয়ে চলেছে মতি নামের কিশোরী মেয়েটির চেতনাজুড়ে। প্রেম। কুমুদ তার জীবনাচরণ নিয়ে অর্থবহ হয়ে থাকে গল্পশেষেও অশেষে নিঃশেষ। উপন্যাসের আরেক প্রেমময় চলিষ্ণু জুটি বিন্দু ও নন্দলাল। এ উপন্যাস জীবনের বহু মাত্রিকতায় প্রকাশিত হয়েছে।এখানে সকলেই পুতুল: হারুর শবদেহ থেকে পরান,যামিনী কবিরাজ, সেনদিদি, গোপাল, বিন্দু,সবাই। তবে গভীরতার বিচারে অতলগামী মানিকের সব চরিত্রেই যেন স্বাভাবিক। বজ্রাঘাতে হারু ঘোষের মৃতদেহ আবিষ্কার-দৃশ্য দিয়ে উপন্যাসের শুরু আর মাটির টিলার ওপর উঠে শশী ডাক্তারের সূর্যাস্ত-দর্শনের শখের অতৃপ্ততা দিয়ে উপন্যাসের সমাপ্তি।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here