মোঃ আবদুল মান্নান :: পৃথিবীর অন্যান্য ৫টি দেশেরমত বাংলাদেশেও ২০১৭ সাল থেকে ভোলা সদর উপজেলায় ধনিয়া ও ভেদুরিয়া ইউনিয়নে ওয়াটারশেড প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রকল্পটি নতুন হওয়ায় এর কার্যক্রম সম্পর্কে আমাদের ও পানি ব্যবস্থাপনা নাগরিক কমিটির তেমন ধারনা ছিল না। কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় পানি ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সমন্বয় করে কাজ করবো। সকলকে একই ছাউনির মধ্যে এনে সমন্বয় করে কাজ করবো। প্রথম আমরা নাগরিক কমিটির সদস্যসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যাই এবং প্রকল্পর কর্মসূচী নিয়ে আলোচনা করি তখন তারা আমাদের সাথে রশিকতা করে বলেন, বায়বীয় প্রকল্প নিয়ে এসেছেন। ভাল কোন প্রকল্প নিয়ে আসেন- যাতে সাধারন মানুষের উপকার হয়, তখন আপনাদেরকে সহযোগিতা করবো এবং আপনাদের সাথে কাজ করবো। অনেকটা ভাঙ্গা মন নিয়ে অফিসে ফিরে এসে সিনিয়র কর্মকর্তাদের সাথে শেয়ার করলে তারা আমাদের ও নাগরিক কমিটির সদস্যদের  বিভিন্ন কথা বলে সাহস যোগান এবং কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।

এর পর পর্যায়ক্রমে সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন- সিএসওদের লবি এ্যাডভোকেসি, জেন্ডার এন্ড ইনক্লুশন, অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্তকরন, বাজেট ট্রাকিংসহ বিভিন্ম কোচিং ও প্রশিক্ষন দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলেন। অথাৎ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি বেদে, হিজরা, জেলে, মুচী, প্রতিবন্ধী গুচ্ছগ্রামের অসহায় সুবিধা বঞ্চিত  মানুষগুলোকে তাদের অধিকার আদায়ে বিভিন্ন কমিটিতে সম্পৃক্ত করে কথা বলার একটি প্লাটফর্ম তৈরী করে দেওয়া ও সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনা যায়।

কোচিং প্রশিক্ষন গ্রহন করে সদস্যগন দ্বিগুন উদ্যোম নিয়ে তাদের যাত্রা শুরু করে। তারা ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস্যসহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির অধিকার আদায়সহ বিভিন্ন কমিটিতে অন্তভুক্তির জন্য দেন-দরবার শুরু করে।

এক পর্যায়ে ইউনিয়ন স্যানিটেশন পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিস্কাশন স্ট্যান্ডিং কমিটি, উপজলা স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ স্ট্যান্ডিং কমিটি, ইউনয়ন ও উপজেলা সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন এবং আন্যান্য কমিটি সক্রিয় করন এবং কমিটির সদস্য হিসাবে অন্তর্ভূক্ত হয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষের পানি স্যানিটেশন ও হাইজিন এবং সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার আওতায় পুকুর, খাল খনন/ পূর্ন খনন, পানি সংরক্ষন, ভূ-উপরোস্ত পানি নষ্ট না করা এবং ইউনিয়ন পরিষদকে সম্পৃক্ত করে প্রকল্প গ্রহন করা নিয়ে বিভিন্ন সভা /ফোরামে আলোচনা করেন। বিভিন্ন দপ্তর, জনপ্রতিনিধির সাথে দেন দরবারের ফলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর পিএসএফস্থাপনসহ কয়েকটি পুকুর খননের কাজ করছে। উপজেলা পরিষদ থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতষ্ঠানের ছাত্রীদের ব্যবহারের জন্য ৬ হাজার প্যাকেট ন্যাপকিন বিতরন করছে, বেদে পল্লী, যোগী পল্লীতে গভীর নলকূপ স্থাপনসহ ইউনিয়নের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জন্য কমপক্ষে ৩০টি গভীর নলকূপ স্থাপন করেছে। ব্যাংকের হাট বাজারে গনশৌচাগা, টিউবওয়েল, ড্রেন নির্মান বিভন্ন শিক্ষা প্রতষ্ঠানে পানির ব্যবস্থাসহ মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট স্থাপন, এলজিইডি ক্ষুদ্র পানি শাখার আওতায়  খাল খনন করছে, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোড, সুইজগেট মেরামত, জিও ব্যাগসহ সিসি ব্লকের মাধ্যমে নদীর তীর সংরক্ষন করছে। বিএডিসি, মৎস্য বিভাগ খাল/ পুকুর খননসহ অনেক কাজ করছে। ২টি ইউনিয়নে ওয়ার্ড সভা, প্রাক-বাজেট, ওপেন বাজেট সভার পরিবর্তে এখন ১৩টি ইউনিয়নে  চলছে। এমনিক গত ২০১৯ সালে এ প্রকল্পটি স্কেলআাপ হিসাব লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলায় চলমান আছে।

আসলে আমি এ গল্পে উপরোক্ত বিষয়গুলির অবতারনা করছি। এই কারন যে, প্রতিষ্ঠানগুলি সিএসওসহ আমাদেরকে নিয়ে আমাদের কাজকে নিয়ে হাসিতামসাসহ অবহেলা করত এখন তারা পানি ব্যবস্থাপনা নাগরিক কমিটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে, তাদের বিভিন্ন কাজে পরামর্শ ও কোন কোনো ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা চাচ্ছে। সিএসওগন নিরলসভাবে কাজ করার ফলে আজকের এ অবস্থার সৃস্টি হয়েছে।

আজ আমি রামগতি উপজেলার নব গঠিত ২৫ সদস্য বিশিষ্ট পানি ব্যবস্থাপনা নাগরিক কমিটির নিবেদিত প্রান মাহিনুর বেগম সম্প্রর্কে কিছু কথা এ গল্পে তুলে ধরতে চাই। অক্টোবর/২০১৯ তারিখে  লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলায় বিভিন্ন শ্রেনিপেশার বেদে, কুলি, হিজরা, কলোনীর অবহেলিত মানুষ, নদীভাঙ্গন কবলিত ভূমিহীন পরিবারের সদস্য, জেলেসহ পানি ব্যবস্থাপনা নাগরিক কমিটি গঠন করি। কমিটি গঠনের পর প্রধান কার্যালয় ও পার্টনার এনজিওদের সহায়তায় তাদেরকে বিভিন্ন কোচিং ও প্রশিক্ষনের মাধ্যমে তাদেরকে দক্ষ করে তোলা হয়। এর পর থেকেই শুরু হয় মাহিনুর বেগমসহ তাদের টিমের কাজ।

প্রথমেই তারা চর বাদাম ও আলেকজান্ডার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সচিবের সাথে দেন-দরবার করে ইউনিয়ন পরিষদের ২০১৯-২০ অর্থ বছরের বাজট দেয়ালে লিখানোর ব্যবস্থা করেন। এর পর বিভিন্ন কমিটি ইউনিয়ন স্যানিটেশন পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিস্কাশন স্ট্যান্ডিং কমিটি, উপজেলা স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ বিষয়ক স্থায়ী কমিটি সক্রিয় করন ও কমিটিতে সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হওয়া, ইউনিয়ন ও উপজেলা সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন, সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হওয়া নিয়মিত কমিটির সভায় উপস্থিত হয়ে কথা বলা পিছয়ে পড়া মানুষের নিরাপদ পানি, সযানিটেশন ও হাইজিন সমস্যা সমাধানে দাবী তোলার কাজ অব্যাহত রাখে। আদর্শ কলোনী, বেদেপল্লী, জেলে পল্লীসহ কয়েকটি স্থানে নিরাপদ খাবার পানির উৎস্যের জন্য বিভিন্ন ফোরম, সভা, ব্যক্তিগত যোগাযোগ ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ডিপিএইচই, এজিইডিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগা, দেনদরবার করেই খান্ত হয় নাই, পানির উৎস্য স্থাপন, খাল,পুকুর খনন, রামগতি উপজেলায় স্যানটেশন কভারেজ কমিয়ে আনার জন্য মাননীয় সংসদ সদস্য বরাবরে লিখিত দরখাস্ত দিয়েছেন। যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খাবার পানির ব্যবস্থা নাই সেই সকল প্রতিষ্ঠানের তালিকা উপজেলা পরিষদ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং মাননীয় সংসদ সদস্য বরাবরে প্রেরন করছেন। উপরোক্ত কাজগুলি করার প্রেক্ষিতে উপজেলা পরিষদ এডিপির বরাদ্দ থেকে চর বাদাম ইউনিয়নের আদর্শ কলোনীতে ২টি অগভীর নলকূপ ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বেদে পল্লীতে ১টি গভীর নলকূপ স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।  উপজেলা পরিষদ চর বাদাম ও আলেকজান্ডার ইউনিয়নে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জন্য ১০টি অগভীর নলকূপ স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।  উপরের প্রত্যেকটি কর্মসূচীর সাথে সক্রিয় অংশগ্রহণ  ছিলো মাহিনুর বেগমের। রামগিত উপজেলায় পানি ব্যবস্থাপনা নাগরিক কমিটি অল্প দিনের মধ্যেই তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমেই একটি শক্তিশালী প্লাটফরম হিসাবে আত্বপ্রকাশ করেছে।

মাহিনুর বেগম চর বাদাম ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডে সরকার দেওয়া আদর্শ কলোনীতে বসবাস করে। তার বসবাস করা কলোনীতে ৪০টি পরিবারে প্রায় ২ শতাধিক নারী, পূরুষ, শিশু, বৃদ্ধ বসবাস করে। ১২-১৫ বছর আগে সরকার আদর্শ কলোনী নাম দিয়ে ৫ শতাংশ জমিসহ ঘর তুলে দেয়। সাথে ৪০ পরিবারের জন্য ১টি গভীর নলকূপ ও প্রতি পরিবারের জন্য ১টি করে রিংস্লাব টয়লেট তৈরী করে দেন। বর্তমানে ৪০ পরিবারের জন্য কোন গভীর বা অগভীর কোন নলকুপ নাই এবং কোন পরিবারে কোনো টয়লেট নাই। যে ঘরগুলি করে দেওয়া হয়েছিল সেইগুলি বসবাসের অনুপযোগী কলোনীর লোকজন মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের একদিকে ঘরে থাকার অবস্থা নাই, নিরাপদ খাবার পানির ব্যবস্থা নাই, টয়লেটের ব্যবস্থা নাই। মানবেতর জীবনযাপন করছে।

মাহিনুর বেগম তাদের এ অবস্থার কথা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান,  জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তরে তুলে ধরেন এবং বিভিন্ন মিটিং সভায় তুলে ধরেন এবং লিখিত দরখাস্ত প্রদান করেন। তার দরখাস্তের পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা পরিষদের এডিপির বরাদ্দ থেকে ২টি অগভীর নলকূপ স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন এবং টয়লেট ও অন্যান্য সমস্যাগুলি উপজলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা চেয়ারম্যান মহোদয় সরজমিনে তদন্ত সাপেক্ষে সমাধানের আশ্বাস প্রদান করেন।

আমরা যখন পানি ব্যবস্থাপনা নাগরিক কমিটি গঠন করি তখন ভাবিনাই সদস্যগন বিভিন্ন দূর্যোগে তারা এমন স্বক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। ঘূর্নিঝড় বুলবুলের সময় দেখেছি তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে এসে দাড়িয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্তদের তালকা তৈরী করেছেন, টয়লেট নলকূপের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে দরখাস্ত দিয়েছেন। করোনা মহামারিতে তারা আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। মাহিনুর বেগম তার কলোনীসহ তার পাশবর্তী আরো ২টি কলোনীতে সামাজিক দূরত্ব বর্জায় রেখে  লিপলেট, মাক্স বিতরনসহ লোকজনকে সতর্ক করছে। নাগরিক কমিটির পুরো টিমের সাথে আলেকজান্ডার ও চর বাদাম ইউনিয়নে  চেয়ারম্যান ও সচিবের সাথে যোগাযোগ করে করোনা সতর্কী করন বার্তা মাইকিং এর মাধ্যমে  ৪ দিন প্রচার করছে, টিবি স্কলে প্রচার এর ব্যবস্থা করছে, রেডক্রিসেন্টের সাথে যৌথভাবে করোনা সতর্কী করনবার্তা উপজেলার সকল ইউনিয়নে  প্রচার করেছে। আলেকজান্ডার কাচা বাজারের সামনে হাতধোয়ার ডিভাইস স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহন করেছে। আমরা  যখন করোনা ভাইরাসের মহা দূর্যোগে অনেকেই কর্মস্থল ত্যাগ করে চলে আসি, তখন মাহিনুরের মত ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানা এই পানি ব্যবস্থাপনা নাগরিক কমিটির সদস্যগন জীবন বাজি রেখে অন্যের জীবন রক্ষার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সালাম জানাই মাহিনুর বেগমসহ রামগতি উপজেলা ও ভোলা পানি ব্যবস্থাপনা নাগরিক কমিটি, বরগুনা ওয়াশ এসডিজি বাজেট ক্লাব, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও খুলনাসহ বাংলাদেশের ডরপ কর্ম এলাকার সকল ত্যাগী সংগঠনকে।

 

 

 

 লেখক: উপজেলা সমন্বয়কারী, ওয়াটারশেড প্রকল্প, ডরপ, রামগতি, লক্ষ্মীপুর

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here