value of water

মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান ::  পানি বা H2O! নিরাপদ পানি! সুপেয় পানি বা পানযোগ্য বা বিশুদ্ধ পানি! নিরাপদ পানি কিন’ সুপেয় নাও হতে পারে। অর্থাৎ, পানযোগ্য নাও হতে পারে। কিন্ত গোসল, ধোঁয়া-মোছা ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয়। সরকার সকলের জন্য এ সুপেয় পানি সরবরাহে অঙ্গিকারবদ্ধ। প্রশ্ন হচ্ছে গুনগত মান নিয়ে। সুপেয় পানির কভারেজ নিয়ে তথ্য-উপাত্তের নানা বিতর্ক থাকলেও সরকারি উপাত্তকেই সঠিক হিসেবে ধরে নিচ্ছি।

সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচি ২০১১-১৬-র জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম (জেএমপি) মোতাবেক পল্লী অঞ্চলে পানি সরবরাহ কভারেজ শতকরা ৭০.৫ ভাগ যেখানে ১০০ জন একটি পানির উৎস ব্যবহার করে। তবে এ কভারেজের মানে এই নয় যে, সকলে সুপেয় পানি পাচ্ছেন। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগোষ্ঠির বিরাট অংশ এই সুপেয় পানি সুবিধা থেকে বঞ্চিত। খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ এই উপকূলের প্রয় অধিকাংশ এলাকার পানি লবনাক্ত ও আর্সেনিকযুক্ত হওয়ায়, পানির প্রাপ্যতা থাকলেও তা সুপেয় নয়; অর্থাৎ পান করার অযোগ্য।

অথচ পানির কভারেজের ক্ষেত্রে আমরা বলি শতকরা ৯৮ ভাগ জনগোষ্ঠি উন্নত পানির উৎসে প্রবেশগম্যতা রয়েছে। কিন্ত এক গবেষনায় গুনগত মান বিবেচনা বলা হয়েছে, ২২ শতাংশ টিউবয়েলে আর্সেনিক থাকায় নিরাপদ পানির ক্ষেত্রে ৭৮ শতাংশ জনগোষ্ঠির প্রবেশগম্যতা রয়েছে। আবার অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ২০ মিলিয়ন বা ২ কোটি মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পানের ভয়াবহতায় রয়েছে, যার ৯০ শতাংশরই আবার গ্রামে বাস।

পানির গুনগত মান যে শুধু রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারনেই নষ্ট হয়ে যায় তা নয়। পানি লভ্যতা এবং ব্যবহারের ফলেও দুষিত হয়। যেমন পুকুরের পানিতে আর্সেনিক মাত্রাতিরিক্ত নয়, কিন্তু পুকুরের পানি আবার পানযোগ্য নয়। একই সাথে বৃষ্টির পানি যে কলসিতে/পাত্রে ধরে রাখা হয়, তা যদি প্রক্রিয়াগত ভাগে পরিষ্কার না থাকে তাহলে ব্যাক্টেরিয়া জন্মাতে পারে; ফলে পানি দুষিত হতে পারে।

পল্লী অঞ্চলের পানির প্রাপ্যতা চিন্তা করলে অবশ্যই প্রথমে টিউবওয়েলের কথা মাথায় আসে। আবার বেশ কিছু বছর ধওে পানির বোতলযাত অবস্থায়ও পাচ্ছি এবং ক্রয় করে পান করছি। টিউবয়েলের মাধ্যমে প্রাপ্য সুপেয় পানির মূল্য যদি আমরা বোতলযাত পানির মূল্যেও সাথে তুলনা করি তাহলে দেখতে পাই দৈনিক একজন মানুষের ২০০ লিটার পানির চাহিদার মধ্যে ১০-১৫ লিটার যদি পানের জন্য প্রয়োজন হয় তাহলে এর সমপরিমাণ বোতলযাত পানির মূল্য দাড়ায় ১ শত ৮০ থেকে ২ শত ৭০ টাকা (১৮ টাকা প্রতি লিটার পানির মূল্য)।

তাহলে সুপেয় পানির মূল্য দিতে পারছিনা বলে সম্পূর্ন নিরাপদ পানি পাচ্ছি না? আবার সরাসরি মূল্য প্রদান না করলেও কি পরোক্ষভাবে মূল্য দিচ্ছি না? যেমন, টিউবয়েল ক্রয় ও স্থাপন মূল্য, ঘন ঘন অসুস্থ হওয়ার জন্য চিকিৎসা ব্যয়, জীবন মান নিচে নামার মূল্য! পানির অপর নাম জীবন, বর্তমানে সেই পানির নাম যেন মরণ! যেমন পানিবাহীত রোগ টাইফয়েড, হেপাটাইটিস এ, হেপাটাইটিস ই, ডায়রিয়া (ই-কোলাই জনিত), আমাশয়, প্যারাটাইফয়েডসহ লিভারের নানা জটিল মরণব্যাধিসহ নিয়মিত পেটের পিড়া- সুপেয় পানি না পান করার কারনেই হচ্ছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষনা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর এক গবেষনায় দেখা গেছে বাংলাদেশের জনসংখ্যা মৃত্যু ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির অন্যতম প্রধান কারন পানিবাহীত বিভিন্ন রোগ, বেশেষ করে শিশু ডায়রিয়া। ১৯৯৭ সালের এক গবেষনা প্রতিবেদন এবং বর্তমান পানির গুনগত মানের তুলনামূলক বিশ্লেষণে বোঝা যায়, অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি ভয়াবহতা কোনো অংশে কমেনি।

পানির গুনগত পরিস্থিতি সত্যিই প্রকট। যারজন্য দেশের অধিকাংশ জনগনই কোন না কোনো ভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের নীতি সহায়তা ইউনিট বা (পিএসইউ) পানির গুনগত মান নিয়ে ২০১১ সালের অক্টবর মাসের একটি প্রতিবেদনে বিশদ আলোচনা করেছে। প্রতিবেদনটি নীতি নির্ধারনের ক্ষেত্রে খুবই প্রয়োজনীয়। তবে উন্নয়ন গভেষক হিসেবে এর প্রয়োগীক ব্যবহার নিয়ে সত্যিই খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছি।

প্রতিবেদনে বলাহয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর সুপেয় পানির নীতিমালায় সুপারিশ করা হয়েছে যে, প্রতিটি জাতিসংঘ সদস্যভূক্ত দেশে ‘নিরাপদ পানি ফ্রেম ওয়ার্ক’ বাস্তবায়ন করতে হবে। যেখানে পানির গুনগত মানকেই স্বাস্থ্য ঝুঁকির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ লক্ষ্যকে বা সুপারিশকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগ ‘নিরাপদ পানি ফ্রেম ওয়ার্ক’ নামের একটি দলিল প্রস্তুত করেছে এবং সরবরাহ সিস্টেমে মেনে চলবে। এখানেই আমার প্রশ্ন, এই সম্পূর্ন ব্যবস্থার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে কি? অথবা জনগন কি সুপেয় পানির এ মূল্য পরিশোধে প্রস্তুত?

পানির গুনগত মান রক্ষায় অবশ্যই একটি অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে। সেটা ব্যক্তি পর্যায়ে দেয়া হোক বা সরকার থেকে ভর্তুকি দেয়া হোক। পানির মানের সাথে তার মূল্য সরাসরি সম্পৃক্ত। ঢাকায় আমরা ৬ টাকা ৭৫ পয়সায় ১ হাজার লিটার পানি পাচ্ছি (যদিও সবসময় পাইপ লাইনে পানি থাকে না), অথচ সে অংক অনুসারে পানযোগ্য বোতলজাত পানি প্রতি ১ হাজার লিটারের দাম হচ্ছে ১ হাজার ৮ শত টাকা। এ থেকে আমাদের বুঝতে হবে বিশুদ্ধ পানির (opportunity cost) অনেক বেশি। তাই এখন সময় এসেছে একটি সরবরাহ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রয়োজনিয় পানির মূল্য নির্ধারন করে সুপেয় পানি নিশ্চিত করা।

একদিকে বলবো সুপেয় পানি, অন্যদিকে বলবো পানি হবে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে; তাহলেতো পচা, কেঁচোযুক্ত, আর্সেনিকযুক্ত দুষিত পানিই প্যাপ্য হবে এবং তৈরী হবে অসুস্থ ও স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ জাতি। সমস্যা হচ্ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি আমরা বুঝতে পারি না যতক্ষন পর্যন্ত না অসুস্থ হয়ে কর্মক্ষমতা হারাই। ২০১২ সালে বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষনায় দেখাগেছে- বাংলাদেশে ডায়রিয়া, পেটের পিড়া, আমাশয়, টইফডের চিকিৎসায় প্রতি জন গড়ে বছরে ২ হাজার ৭২ টাকা খরচ করছেন। তার মানে সুপেয় পানি পানের জন্য মূল্য দিতে হবে। নচেৎ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যক্তি পর্যায় হতে জাতীয় পর্যায়ে বড় ধরনের মূল্য দিতে হবে।

লেখক: উন্নয়ন গবেষক, ইমেইল: research@dorpbd.org

 

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here