পাটকলগুলোকে লাভজনক করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ

স্টাফ রিপোর্টার :: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরো পাটখাতের যান্ত্রিকীকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করে দেশের সরকারি খাতের পাটকলগুলোকে লাভজনক করে তুলতে আন্তরিকভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটি বড় সমস্যা রয়েছে যন্ত্রপাতিগুলো অত্যন্ত পুরনো, কাজেই এই মেশিনারিজগুলো সব বদলাতে হবে। নতুন মেশিনারিজের ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও এ ব্যাপারে আমরা সবরকম চেষ্টা করছি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা পাটকে আরো আধুনিকিকরণের মাধ্যমে পাট উৎপাদন, পাট সংগ্রহ, পাট সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছি।’

শেখ হাসিনা মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় পাট দিবস-২০১৮ উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী পাটপণ্য মেলার উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।

তার সরকার বেসরকারি খাতকে সব থেকে বেশি সুবিধা দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কেবল সরকারি খাতে প্রতিষ্ঠান থাকলে ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের মাঝে ঢিলেঢালা ভাব চলে আসতে পারে, পণ্য উৎপাদনে যার প্রভাব পড়তে পারে।

তবে, প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের মানসিকতা পরিত্যাগ করার জন্যও সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘যে শিল্পটা আপনাদের জীবন-জীবিকার সবরকম উপকরণ দিচ্ছে সেই শিল্পটাকে বাঁচাতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে তার সরকার বন্ধ পাটকলগুলো চালু করেছে। ৫টি পাট কল চালু করা হয়েছে। খুলনায় ৪টি এবং সিরাজগঞ্জে ১টি।

তিনি বলেন, এই পাটকলগুলোর তিন হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ ছিল যেটি সরকার মওকুফ করে সরকারই তা পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছে এবং অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে কেবল যে কৃপণতা করে তাও নয়, বরং পাটকলগুলোর দায়-দেনা মুক্ত করে তাকে নতুনভাবে চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, এখন এগুলোকে সচল রাখার দায়িত্ব, যারা পাটকলগুলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন তাদের, সংশ্লিষ্ট শ্রমিক এবং কর্মচারী প্রত্যেকের।

প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযতভাবে পালন করবেন প্রত্যাশা ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, আর যেখানেই যেটুকু সমস্যা দেখা দেয় তা সমাধান করবে তার সরকার।

তিনি বলেন, যেহেতু পাটের বাজার এখন খুলে গেছে (উন্মুক্ত) আমরা রপ্তানি করতে পারছি, আমরা যতই উন্নতমানের পণ্য তেরি করতে পারবো ততই আমাদের বাজার বৃদ্ধি পাবে।

প্রধানমন্ত্রী এ সময় দেশে পাটের বাজার সৃষ্টিতে তার সরকারের করে দেওয়া ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০-এর উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, তার সরকারের এই আইন করে দেওয়ার ফলে দেশে পাটের চাহিদাও বেড়ে গেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাটের বহুমুখীভাবে ব্যবহার করতে হবে কারণ এই পাট আমাদের জাতীয় সম্পদ। একদিক এটি কৃষি সম্পদ অন্যদিকে আমাদের শিল্পপণ্য কাজেই এর অনেক সম্ভাবনা রয়েছে এবং অনেক উন্নতমানের পাটও পাটজাত পণ্য আমরা তৈরি করতে পারি। সে সম্ভাবনাও আমাদের রয়েছে।

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমরা পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি  করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা আমরা অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছি ইনশাল্লাহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সাথে সাথে পাটও আমাদের অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হবে।

শেখ হাসিনা বলেন, কৃষিপণ্য এবং শিল্পপণ্য হিসেবে পাটের যে বহুমুখী ব্যবহার এটাই আমাদের জন্য একটা বিরাট সম্পদ। এই সম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে আমাদের আর্থসামাজিক উন্নতি যাতে দ্রুত হয় সেই ব্যবস্থা ইনশাল্লাহ আমরা করবো।

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এগিয়ে যাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা ১০০ শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলছি সেখানে আমাদের কাঁচামাল দরকার, ইতোমধ্যে আমি নির্দেশ দিয়েছি যেখানে যেখানে আমাদের যে ধরনের পণ্য বেশি উৎপাদন হবে সেখানে সেসব পণ্য ব্যবহার করে সে ধরনের শিল্প কারখানা যেন গড়ে ওঠে। সেদিকেও বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী পাটের ওপর দেশব্যাপী স্কুল পর্যায়ে অনুষ্ঠিত রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের অভিনন্দদন জানিয়ে বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদেরও আমাদের দেশের পণ্য সম্পর্কে জানা একান্তভাবে প্রয়োজন।

দেশকে আগে জানতে হবে উল্লেখ করে তিনি পাট উৎপাদন, পাট রপ্তানি, পাট প্রক্রিয়াজাতকরণসহ বিভিন্ন খাতে যারা পুরস্কার পেয়েছেন তাদেরকেও আন্তরিক অভিনন্দন জানান।

তিনি বলেন, আমি বলবো এই পরিবেশবান্ধব পণ্যটাকে আমাদের আরো উন্নত করতে হবে। তিনি ‘সোনালি আঁশ’- পাট দেশের সমৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে বলেও দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পাটকল আদমজিসহ ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে একের পর এক পাটকল বন্ধ করে দেওয়ায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০২ সালে এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজি বন্ধ করে দিয়ে পাট শিল্পকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়। এতে মিলের প্রায় ২৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৯১ সালের নির্বাচনে তখন কোনো দলই সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায়নি। কিন্তু বিএনপি জামায়াতের হাত ধরে সরকার গঠন করে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সাথে একটা চুক্তি করলো যে, গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে সকল শ্রমিকদের চাকরি থেকে বিদায় দিয়ে দেবে। আর ’৯৩ সাল থেকে পাটকলগুলি একে একে বন্ধ করবে। ফলাফলটা ছিল তখন বাংলাদেশ থেকে বিশ্বে যে আড়াই লাখ বেল পাট রপ্তানি হত তা বন্ধ হয়ে যাবে। আর ঠিক একই ভারতের সঙ্গে ওয়াল্ড ব্যাংকের চুক্তি হলো তারা টাকা পেল ভারত তাদের সীমান্তে পাটকল তৈরি করবে আর ঐ আড়াই লাখ বেল পাট রপ্তানি  করার সুযোগ ভারত পাবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের পাটকল বন্ধ করার জন্য টাকা নিল বিএনপি সরকার আর ভারতকে পাটকল করার সুযোগ করে দিল ওয়ার্ল্ড ব্যাংক। তখন তিনি নিজে এবং তার দল বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বিরোধীদল সংসদে প্রতিবাদ করেছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম আমাদের দেশের পাটকল কেন বন্ধ হবে, কারণ, আমরাতো পাট উৎপাদনকারী দেশ। আমার হাজার হাজার কৃষক-শ্রমিক তাদের কেন বঞ্চিত করা হবে। তাদের কেন চাকরি যাবে। কিন্তু বিএনপি সরকার এই পাটকল সব বন্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু করলো।

’৯৬ সালে সরকারে আসার পর তিনি আবার পাটকলগুলি চালুর উদ্যোগ নিলেন এবং পাটের ওপর গবেষণার গুরুত্ব দেওয়ায় ১১টি পাট পণ্য উৎপাদনের সক্ষমতা বাংলাদেশ অর্জন করলো, বলেন তিনি।

পাটের উন্নত চাষাবাদ ও বহুমুখী ব্যবহারের জন্য গবেষকরা কাজ করে যাচ্ছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এ সময় পাটের জিন গবেষক প্রয়াত মাকসুদুল আলমকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাট নিয়ে গবেষণার ফলে অনেক নতুন নতুন অকর্ষণীয় পণ্য উৎপাদন হচ্ছে।

এ অনুষ্ঠানে তিনি যে শাড়িটা পরে এসেছেন সেটা পাটের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী জানান, তার পায়ের জুতাটাও পাটের তৈরি। নিজের ভ্যানিটি ব্যাগটিও সকলের সামনে প্রর্দশন করে বলেন, এটাও পাটের তৈরি।

তিনি বলেন, পাট এমন একটি পণ্য যে বিশ্বের দামী মার্সিটিজ গাড়ি তৈরি করতেও পাটের ব্যবহার হয়।

শেখ হাসিনা বলেন, পাকিস্তানীরা আমাদের পাট বিক্রি করে নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন করতো। তারা পাটকে ধ্বংস করার জন্য কৃষকদের বঞ্চিত করতো। তাদেরই প্রেতাত্মারা যারা বাংলাদেশে আছে তারাও ক্ষমতায় গিয়ে রাজাকারদের শিল্পমন্ত্রী-কৃষিমন্ত্রী বানিয়ে আরেক দফা এই পাটকে ধ্বংস করেছে। আমরা ক্ষমতায় আসার পর পাটকে এবং পাট চাষীদের বাঁচানোর জন্য নানা ধরনের উদ্যেগ গ্রহণ করি।

পরে প্রধানমন্ত্রী পাট পণ্য মেলার উদ্বোধনের পর বিভিন্ন স্টলগুলো ঘুরে দেখেন এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় আয়োজিত বর্নাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন।

বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী মো. ইমাজউদ্দিন প্রামাণিক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এবং বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মীর্জা আজম। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়জুর রহমান চৌধুরী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী দেশব্যাপী স্কুল পর্যায়ে আয়োজিত পাট বিষয়ে রচনা প্রতিযোগিতার বিজয়ী এবং পাট উৎপাদন, পাট রপ্তানি, পাট প্রক্রিয়াজাতকরণসহ পাটের খাতের সমৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত ১১টি ক্যাটাগরিতে ১২ জনকে অনুষ্ঠানে পুরস্কৃত করেন।

মন্ত্রী পরিষদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, সরকারের পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনিতিক, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সদস্য, আমন্ত্রিত অতিথি এবং পাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা, পাটচাষী এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে পাট পণ্যের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিষয়ে একটি প্রামাণ্য চিত্রও প্রদর্শিত হয়।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here