রবীন্দ্রনাথ মিশে আছেন সহস্রকোটি ভক্তের প্রাণের সুবাসে

-তাহমিনা শিল্পী

“ব্যথারা যদি পথ ভুল করে

বাসা বেধেঁ বসে মনে

বুকের মাঝে বসন্ত আঁকো

ঠাকুরকে রাখো প্রাণে।”

একথা বোধহয় কোন বাঙালিকে বলে দিতে হয় না। যুগ যুগ পেরিয়ে গেলেও রবীঠাকুরের প্রতি আকুল এই প্রণতি আছে এবং থেকেই যাবে বাঙালির প্রাণে।রবীন্দ্রনাথের প্রতি সকলের শ্রদ্ধা প্রেম ভালোবাসাটা তাই চিরন্তন।কেননা রবীন্দ্রনাথ তো শুধু একটি চেতনাই নয়৷ তিনি বাংলা সাহিত্যের আকাশে একটি দগদগে সূর্য৷ তাই সূর্যকে যেমন অস্বীকার করা যায় না, বাংলা ভাষা সংস্কৃতির চেতনাকে ধারণ করলে তেমন করে রবীঠাকুরকেও অস্বীকার করা যায় না।আর যারা তাঁর গান কবিতার অনুরাগী,তারা তাঁর নাম বহন করে চলেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে৷ প্রকৃতপক্ষে কতটা পারছে জানি না,তবে এতটুকু বলতে পারি তাঁর অসীম সৃষ্টির মাঝেই তিনি মিশে আমার মত সহস্রকোটি ভক্তের প্রাণের সুবাসে।এবং সে সুবাস তার ভক্তরা ছড়িয়ে দিতে চায় নতুন প্রজন্মের প্রাণে-প্রাণে।আমি রবীঠাকুরের একজন একনিষ্ঠ অনুরাগী।আজকের আলোচ্য বিষয়ে বিশেষভাবে তাঁর গানের কথা আলোচনা করবো আমার একান্ত অনুভূতির আলোকে।

আমি সর্বত্রই তাঁকে ভালোবাসি।তাঁর গানের সাথে কবিতার সাথে যখন নিজেকে একাত্ম করি তখন আমি আমাতে থাকি না।ভাবনায় অনুভবে হারিয়ে যাই দূরে কোথাও দূরে দূরে….. আমার অন্তর চোখে তখন অদৃশ্য আকাশ,নদী সাগর,আর কেবলই রবীন্দ্রনাথ।

আমার অনুভবে তিনি কেবল একজন কবিই নন।একজন জীবনগুরুও বটে।তাঁর কথায় যেভাবে তিনি জীবনকে এঁকেছেন তাতে করে সকলেই নিজ নিজ জীবনের প্রেমে পড়বে বারবার,ক্ষণে ক্ষণে।

“আমি তার মুখের কথা শুনবো ব’লে গেলাম কোথা/শোনা হল না, হল না–/আজ ফিরে এসে নিজের দেশে এই-যে শুনি,/শুনি তাহার বাণী আপন গানে…./প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে/তাই হেরি তায় সকল খানে”

এই যে নিজের মাঝে সৃষ্টিকর্তা ও তাঁর সৃষ্টিকে কে অনুভব করার, নিজেকে নিজের মাঝে খুঁজে পাবার যে সূত্র রবীন্দ্রনাথ শেখালেন এখানেই আমি পাই জীবনে এগিয়ে চলার গতি।ফিরে পাই আত্মবিশ্বাস ও মনোবল।চলার পথে নিভুক যত আলো,পথ যতই যাক বেঁকে আমি ঠিকই পাব পথের দিশা আপন আলো জ্বেলে।আমি আমার ভরসা হব,প্রেরণা হব।জয় হবে সুনিশ্চিত।

নিরবতার একটি ভাষা আছে।সে ভাষা যে শুনতে পায় তার পথচলার গতিতে কোন থেমে থাকার গল্প থাকে না।তবে নিরবতার ভাষা বোঝার জন্য গভীরে যেতে হয়।আত্মার মাঝে ডুব দিতে হয়।যে পারে সে উপলব্ধির চরম স্তরে পৌঁছায়।তার কাছে সবকিছু সহজ হয়ে যায়।এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ আমার অন্য একটা সত্তার উপলব্দি এনে দিয়েছে।উদাহরণ হিসেবে আমি কেবল দুটি লাইন উল্লেখ করতে চাই-“তুমি রবে নিরবে,হৃদয়ে মম /নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমা নিশিথীনি সম”

গানে তিনি একাধারে প্রেমের আকুতি প্রকাশ করেছেন।গভীরতম ভালোলাগার কথা বলেছেন।অপরদিকে দ্বিধা-সংশয়,ভয়,অভিমান-বেদনা ইত্যাদি যে প্রেমের অন্য এক রূপ তা তুলে ধরেছেন।প্রণয়ে নিজের সাথে নিজের যে বোঝাপড়া সেটিও কিন্তু তার গানে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।তার প্রামাণ হিসেবে পরপর কয়েকটি গানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে-

“বড়ো সাধে জ্বালিনু দীপ, গাঁথিনু মালা–/তুমি যেও না এখনি এখনও আছে রজনী”

“ও যে মানে না মানা/আঁখি ফিরাইলে বলে না না না….”

“আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে,/দিগন্তে কার কালো আঁখি/আঁখির জলে যায় ভাসি/ভালোবাসি/ভালোবাসি, ভালোবাসি”

সর্বোপরি,ষড়ঋতুর সাজে মেতে ওঠা, প্রকৃতির মাঝে নিজেকে খোঁজা,প্রকৃতি ও প্রেমের মাঝে আমিতে রূপান্তরিত হওয়ার যে কৌশল তা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে পাওয়া যায়।তাঁর যে দর্শন, দেশ,মাটি ও মানুষ,দেশপ্রেম-প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন করে,যত সুন্দর করে বর্ণনা করেছে দেশের সৌন্দর্যকে,অন্তরের সবটুকু আবেগ ঢেলে দিয়ে প্রকাশ করেছেন দেশের প্রতি ভালোবাসাকে।যেভাবে বিনম্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন দেশ ও মাটির প্রতি তেমন করে পাইনি আমি আর কোনখানে।

“ও আমার দেশের মাটি, তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা /তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা /

তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে,/তুমি মিলেছ মোর প্রাণে মনে,/তোমার ওই শ্যামলবরন কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা…

তুমি অন্ন মুখে তুলে দিল।।/তুমি শীতল জলে জুড়াইলে,/তুমি যে সকল-সহা সকল-বহা মাতার মাতা / ও মা, অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা–/তবু জানি নে-যে কী বা তোমায় দিয়েছি মা!

এই একটি গানই বোধহয় তাঁর অসীম দেশপ্রেমের কালজয়ী সাক্ষি হয়ে থাকার জন্য যথেষ্ট।তথাপি যারা ববীন্দ্রনাথকে ভালোবাসেন তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসেন তারা এমন অসংখ গানের কথা বলতে পারবেন।

রবীন্দ্রনাথের গান সবসময়ই আধুনিক।তবুও মাঝেমাঝে আমি খুব শংকিত হয়ে পড়ি।যুগের সাথে যুগের স্বাদ ও রুচির যে পার্থক্য, চর্চা ও ভালোবাসার যে দোলাচল এখানে এসে কোথাও যেন কোনভাবে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি হারিয়ে না যায়।আমরা কি আগের মতি আমাদের হৃদয়ের গভীরে রবীন্দ্রনাথকে অনুভব করি,নতুনভাবে ধারণ করি? এক্ষেত্রে অগ্রজদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে হবে।আমরা সবাই আবার যেন নতুন নতুনভাবে, আলাদা করে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকে ভালোবাসি।

নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেই আর এভাবেই রবীন্দ্রনাথ যুগযুগ পুণঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। রবীন্দ্রনাথ স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকে।কেননা,রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি গানে,কবিতায়,গল্পের একেকটি শব্দে একেকটি স্বপ্ন, প্রতিটি মুহূর্তের কথা বলে।

সর্বোপরি সকল দ্বিধা-দ্বন্দ এবং হতাশাকে কাটিয়ে রবীন্দ্রনাথকে আমৃত্যু বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় একটি কথাই শেষ কথা হতে পারে-

“যদি পুরাতন প্রেম/ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে/যদি থাকি কাছাকাছি/দেখিতে না পাও/ছায়ার মতন আছি না আছি/মনে রেখো/তবু মনে রেখো……”

 

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here