ঢাকা : সরকার বলছে যে কোনো মূল্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবেই। আর যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। এ অবস্থায় অসন্তুষ্ট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।

‘একতরফা’ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে তারা। অনেক চেষ্টার পরও সমঝোতা না হওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন তো এরই মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে বলে দিয়েছে, তারা মর্মাহত।

ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতাবাস এবং মার্কিন কূটনীতিকসহ প্রায় সব দেশের কূটনীতিকরা এক বছর ধরে অব্যাহতভাবে বলে আসছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন অবশ্যই অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এজন্য তারা ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েছেন। বারবার সংলাপে বসার জন্য প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু পরিস্থিতি দিন দিন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সময় এসব কূটনীতিক নানাভাবে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) তো আনুষ্ঠানিকভাবেই জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো একটা স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরি করতে না পারায় তারা মর্মাহত এবং নির্বাচনে তারা কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। এর আগে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচার’ ভঙ্গ করে ইউরোপীয় কূটনীতিকরা স্মৃতিসৌধেও যাননি। বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি দুই দলের সমঝোতার ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েছে বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘও। মহাসচিব বান কি মুন দফায় দফায় দুই নেত্রীকে ফোন করেছেন। বিশেষ দূত হিসেবে অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে ঢাকায় পাঠিয়েছেন। ছয় দিন ঢাকায় অবস্থান করে তারানকো নিউইয়র্কে ফিরে গেছেন এক রকম ‘ব্যর্থ’ হয়েই। দুই দলই যার যার অবস্থানে অনড় থেকেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর নির্বাচনে পশ্চিমা দেশ ও দাতা সংস্থাগুলো পর্যবেক্ষক না পাঠালে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায় না। সেক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাসহ অন্য দেশগুলোও এ ব্যাপারে সরাসরি কিছু না বললেও এক রকম  নিশ্চিত যে তারাও এই নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না।

নির্বাচনের আর বাকি আছে ১৩ দিন। এখনও যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাসহ প্রায় সব দেশই পর্যবেক্ষক পাঠানোর ব্যাপারে এক রকম নীরব আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ১৯ ডিসেম্বরও বলেছে তারা সমঝোতা চায়। বিএনপিবিহীন সংসদ নির্বাচন হলে পর্যবেক্ষক পাঠানো-না পাঠানো নিয়ে সরাসরি কিছু না বলে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, আমরা আশা করছি দুই দলের সমঝোতা হবে। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে মজিনা বলেন, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে তার দেশ বিপুলসংখ্যক পর্যবেক্ষক পাঠাবে। চীন তার দীর্ঘদিনের প্রথা ভেঙে অন্য দেশের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ নিয়ে কথা বলেছে। চীনও প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের সমঝোতার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাইছে। যুক্তরাজ্যও একই মনোভাবের কথা জানিয়ে দিয়েছে। জাপান নীরব থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। একইভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও।

তবে সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি মার্কিন সিনেটে অনুষ্ঠিত শুনানিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সিনেটের ফরেন রিলেশন্স কমিটির অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য সিনেটর ম্যাককেইনের সঙ্গে শনিবার দেখা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের। আকরামুল কাদের সিনেটর ম্যাককেইনকে আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, তারা নির্বাচনে বিএনপিকে আনতে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছেন।

এর আগে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও নির্বাচন নিয়ে সরকারের অবস্থান সম্পর্কে জানিয়ে দেন। বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের গাঁটছড়া বাঁধার বিষয়টি রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা পছন্দ করছেন না।

৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করে সুজাতা সিং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে ‘চাপ’ দিয়েছেন। এরশাদকে সুজাতা এটাও বুঝিয়েছেন, এই অঞ্চলকে জঙ্গিবাদের হুমকি মোকাবিলা করে স্থিতিশীল রাখার জন্য বিএনপির জোট শরিক জামায়াতকে রুখতে হবে। এজন্যই নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ খুব জরুরি। সূত্র জানায়, বর্তমান সরকার বিশ্ব সম্প্রদায়কে বোঝানোর ক্ষেত্রে ভারতের আরও কার্যকর ভূমিকা প্রত্যাশা করছে। এ কারণেই মূলত সুজাতা সিং ঢাকা থেকে সোজা উড়ে চলে যান ওয়াশিংটন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মুহূর্তে ভারত ছাড়া বাংলাদেশের পাশে বিশ্বের কোনো দেশ নেই। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ইস্যুতে বাংলাদেশ বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে।

বিএনপি নির্বাচন বয়কট করেছে। এরই মধ্যে ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। এসব বিজয়ী প্রার্থীর ১৪৯ জনই শাসক দল আওয়ামী লীগের। বাকি পাঁচজনও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক দলের। এ অবস্থায় দেশে বিএনপির ডাকা টানা অবরোধ চলছে। স্থবির হয়ে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জনজীবন। অচল হয়ে পড়েছে দেশ।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here