নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে সবুজ বিপ্লব প্রকল্প মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া প্রতিনিধি :: আতংক কেটে গেছে সেই কবেই। খড়-নাড়ার ঘরের পরিবর্তে এখন উঠছে টিনসেট-অর্ধপাকা ঘর। ধুলো-বালির এবড়ো থেবড়ো আকাঁবাকা জমির উপর দিয়ে পায়ে চলা রাস্তায় এখন মাটির বাঁধ। মরুভূমির সেই বালুচরের জমি এখন তিন ফষলী ক্ষেত। উত্তপ্ত বালুচর এখন সবুজের সমারোহ। সাগর ঘেষে বনবিভাগের তৈরি করা প্রাকৃতিক সবুজ দেয়াল পাল্টে দিয়েছে হাজারো পরিবারের জীবনযাত্রা। আতংক না, এখন স্বপ্ন দেখে এক সময়ে দূর্যোগ হলেই সর্বস্ব হারানো পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ধুলাসার ইউনিয়নের হাজারো পরিবার।

বাড়ি থেকে কান পাতলেই শোনা যায় সাগরের গর্জন। আর এই বর্ষায় সাগরের ঢেউয়ের উদ্যমতা আরও বাড়লেও আতংক নেই আতাহার ভূইয়ার। বয়স চল্লিশ পেরোলেও এই বয়সে প্রাকৃতিক দূর্যোগে কয়েকবার মৃত্যুর কবলে পড়েছেন। কিন্তু এখন আর তার দূর্যোগ নিয়ে ভয় নেই।  বরং তার স্বপ্ন টিনের ঘরটিকে পাকা করবেন। ছেলেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। তাইতো এখন বালুচরেই ফষল উৎপাদনের প্রতিযোগীতায় নেমেছেন। যুদ্ধ করছেন সময়ের সাথে, কার আগে কে ফষল তুলবেন।

এই পাল্টে যাওয়া গঙ্গামতি ও কাউয়ার চর গ্রামের হাজারো পরিবারের জীবনযাত্রার বাস্তবচিত্র জানতে সরেজমিনে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায় তাদের এই নতুন উদ্যম নিয়ে স্বপ্নসাজানোর বর্তমান অবস্থার বাস্তব চিত্র।

চর গঙ্গামতি সাগর ঘেষা বিস্তীর্ন বালুচর এক সময়ে ছিলো ধূ ধূ মরুভূমির মতো। সাগরে মাছ শিকার করা বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার জেলে পরিবার এই বালুচরে ছোট ছোট ঝুপড়ি করে বছরের ছয় মাস এখানে থাকতো। ছিন্নমূল,সর্বস্বহারা যেসব জেলের স্থায়ী কোন ঠিকানা ছিলো না তারা এই চরে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করে। কিন্তু ২০০৭ সালের ভয়ংকর সিডরের জলোচ্ছাস এই চরে আশ্রয় নেয়া পরিবারগুলোর সর্বস্ব কেড়ে নেয়। সেই সংগ্রাম শুরু বেঁচে থাকার। আবার সর্বস্ব হারানো পরিবারগুলো বালুচরে মাথা গোঁজার আশ্রয় তৈরি করলেও আতংকে কাড়তো প্রাকৃতিক বুলডোজার কখন গুড়িয়ে দেয় একটু একটু করে জোগাড় করা সংসারের স্বপ্নগুলো।

ষাটোর্ধ মতিন মিয়া প্রায় বলেন, বন বিভাগের সবুজ বিপ্লব প্রকল্প তাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে পেরেছে। সাগরের তীর ঘেষে প্রাকৃতিক ঝাউ বাগান প্রকল্প ও বিভিন্ন প্রজাতির দ্রুত বর্ধনশীল গাছের চারা রোপন করায় ২০১০ সালের পর আর কোন দূর্যোগে এখানকার মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ্য হয়নি।
এই চরের বাসিন্দা মনসুর আলীর মতে, সাগর পাড়ে প্রাকৃতিক বাগান তৈরি করায় এখন সমুদ্র স্তর ক্রমশ যেমন নিচু হচ্ছে তেমনি বাগানে বালু ও মাটির স্তর উঁচু হচ্ছে। এ কারনে ঝড় কিংবা প্রাকৃতিক দূর্যোগে সাগরে পানির স্তর বাড়লেও লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে পারছে না এবং বাগানের কারনে ঝড়ের প্রচন্ড বেগ লোকালয়ে নির্মিত বসত ঘর ক্ষতিগ্রস্থ্য হচ্ছে না। এ কারনে এখান মাটির যেমন উর্বরতা বেড়েছে তেমনি এখন তিন ফষল হচ্ছে।

আলমগীর হোসেন প্রায় ২০ বছর সাগরে মাছ শিকার করলেও তিনি এখন পুরোদস্তুর কৃষক। তিনি জানালেন, সাগরে মাছ শিকার করতে গিয়ে কয়েকবার ট্রলার ডুবতে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বেঁচেছেন। গত পাঁচ বছর ধরে এখন জমি বর্গা নিয়ে চাষ করছেন। এখন তিনি পরিবার নিয়ে ভালোই আছেন। দুই ছেলে-মেয়ে স্কুলে পড়ছে। অথচ যখন সাগরে মাছ শিকার করতেন তখন বড় ছেলেকে টাকার অভাবে আগে স্কুলেই পাঠাতেই পারেন নি।

নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে সবুজ বিপ্লব প্রকল্প তিন সন্তানের জননী আসমা বেগম জানান, প্রাকৃতিক দূর্যোগ তাদের কয়েকবার নিঃস্ব করেছে। কিন্তু গত ছয় বছর ধরে কোন দূর্যোগই তাদের ক্ষতি হয়নি। তার ভাষায়,“ আগে আছিলো খোলা মাঠ(বালুচর)। সাগরে জেয়ার আইলেই ঘরে পানি ওটতো। ঝড় হইলেই সব উড়াইয়া ফালাইতা। এ্যাহন ওই বাগান করায় এই চরে আর পানি ওঢে না। বাতাসে ঘর বাড়ি ভাঙ্গে না।”

মানুষের প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার সঙ্গে চরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রারও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে এ কথা জানালেন শিক্ষিকা হোসনেয়ারা বেগম। তিনি জানান, আগে এই চরের শতশত শিশু মাছ ধরা, শুটকি কারখানায় কাজ ও শ্রম বিক্রি করতো শুধু পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারনে। এখন সেই চিত্র পাল্টে গেছে। এখন আর চরের শিশুরা সকাল হলেই জাল কিংবা ঝুড়ি নিয়ে বের হয় না। বরং তারা বই-খাতা নিয়ে স্কুলমুখী হয়েছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে শেষ সম্বল টুকু রক্ষা করতে পারায় এখন অভিভাবকরা নিজ উদ্যেগেই সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করছে।

ধুলাসার বন বিভাগ সূত্রে জানাযায়, কাউয়ার চর ও চর গঙ্গামতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাগরের ভাঙ্গন রোধ ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে মানুষের জানমাল রক্ষায় এই প্রাকৃতিক বনায়ন সৃষ্টির উদ্যেগে নেয়া হয়। কয়েক স্তরে এই বাগান করা হয়। প্রথম স্তরে ঝাউ বাগান দ্বিতীয় স্তরে দ্রুত বর্ধনশীল গাছ ও তৃতীয় স্তরে মাটির ক্ষয় রোধ বড় শিকড় প্রজাতির গাছ রোপন করা হয়। এই প্রকল্পের সফলতার কারনে এখন চরাঞ্চলের মানুষ প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষা পাচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here