দারিদ্র্যের হারস্টাফ রিপোর্টার :: ২০১৬ সাল শেষে দেশে দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের প্রতি ১০০ জন মানুষের মধ্যে ২৪ জন এখনও দারিদ্রসামীর নিচে বাস করছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপে (এইচআইইএস) দারিদ্র্য পরিস্থিতির এ চিত্র পাওয়া গেছে।

মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পরিসংখ্যান ভবন মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেন।

আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যবিমোচন দিবস’ উপলক্ষে বিবিএস জরিপটির প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বিবিএস দেশব্যাপী সর্বশেষ জরিপটি পরিচালনা করে। এতে ৪৬ হাজার ৮০টি পরিবারের আয়-ব্যয়ের তথ্য নেওয়া হয়। খানা আয়-ব্যয় জরিপে এটাই সবচেয়ে বড় নমুনা। এর আগে ২০১০ সালের জরিপে ১২ হাজার ২৪০টি পরিবারের আয়-ব্যয়ের তথ্য নেওয়া হয়েছিল।

এর আগে ২০১০ সালে এ জরিপ পরিচালনা করে বিবিএস। তখন দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশ, অর্থাৎ তখন প্রতি ১০০ জনে ৩১ জন মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। ছয় বছরের ব্যবধানে দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। মোট দারিদ্র্যের পাশাপাশি অতি দারিদ্র্যের হারও আগের তুলনায় কমেছে। সর্বশেষ জরিপে অতি দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ, যা বর্তমান আন্তর্জাতিক অতি দারিদ্র্য হারের (১৩ দশমিক ৮ শতাংশ) তুলনায় কম। ছয় বছর আগে ২০১০ সালে দেশে অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ।

পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব কেএম মোজাম্মেল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাজশ্রী এস পারলকার, বিবিএসের মহাপরিচালক আমীর হোসেন প্রমুখ।

উল্লেখ্য, গত বছর এই দিনে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্য খেতে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম ঢাকায় এসেছিলেন।

অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় দারিদ্র্যের হার ১৬ শতাংশ। এই হিসেবে দারিদ্র্যবিমোচনে বাংলাদেশ সঠিক পথেই আছে। বলা হচ্ছে দারিদ্র্যবিমোচনের গতি কমে গেছে। অর্থনৈতিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমরা এত দ্রুত উপরে উঠতে চাই না, যাতে হঠাৎ করে নিচে নেমে যেতে হয়। পরিকল্পনামাফিক এগুতে পারলে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে যাবে।

জরিপের ফলাফল বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন বলেন, এর দুটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে সামগ্রিকভাবে দারিদ্র্যের হার তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমা এবং ভোগের ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা বিরাজ করা। দুটি নেতিবাচক কি হলো- দারিদ্র্যবিমোচনের গতি কমে গেছে এবং আয় বৈষম্য বেড়েছে। এছাড়া খানা নমুনা সংখ্যা বেশি হওয়ায় জাতীয় প্রতিনিধিত্বশীল এবং নির্ভরযোগ্য তথ্যের উৎস হিসেবে এটি ব্যবহারের সুযোগ বাড়বে।

রাজশ্রী এস পারলকার বলেন, এ জরিপের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে জেলাভিত্তিক দারিদ্র্য পরিমাপ এবং প্রান্তিক হিসাবে (প্রতি তিন মাসে) দারিদ্র্য পরিমাপ। এটি প্রতিটি জেলার দারিদ্র্যবিমোচন এবং মৌসুমভেদে দারিদ্র্যের হারে কেন তারতম্য হয় তা বুঝতে এবং করণীয় ঠিক করতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সহায়ক হবে।

জরিপের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৯৫ সালের পর থেকে পাঁচ বছর পর পর এ জরিপ করে আসছে বিবিএস। ২০১০ সালের জরিপে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপরে কোনো জরিপ না হলেও ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আগের জরিপের ভিত্তিতে দারিদ্র্যের হার হিসাব করা হয়েছে। সে হিসাবেও কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে দেশের দারিদ্র্য হার কমেছে। ২০১১ সালে ২৯ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১২ সালে ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ, ২০১৩ সালে ২৭ দশমিক ২ শতাংশ, ২০১৪ সালে ২৬ শতাংশ এবং ২০১৫ সালে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ দারিদ্র্যের হার প্রাক্কলন করা হয়। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সরকার ২০২০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়েছে। ওই সময়ে চরম দারিদ্র্য হার ৮ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করছে সরকার।

জরিপ অনুসারে ২০১৬ সালে জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার বেশি। জরিপমতে, গ্রামে দারিদ্র্যের হার ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ আর শহরে এ হার ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ। তবে বিভাগ ও জেলাওয়ারী দারিদ্র্যহারের যথেষ্ট তারতম্য রয়েছে। ৩১টি জেলার অতি দারিদ্র্য হার জাতীয় হারের (১২ দশমিক ৯ শতাংশ) চেয়ে বেশি। আবার ৩৬ জেলার সাধারণ দারিদ্র্য হার জাতীয় দারিদ্র্য হারের (২৪ দশমিক ৩ শতাংশ) চেয়ে বেশি।

জরিপমতে, বর্তমানে প্রতিটি পরিবারের গড় মাসিক আয় ২০১০ সালের তুলনায় ৪ হাজার ৪৬৬ টাকা বেড়েছে। ২০১৬ সালে জরিপভুক্ত প্রতিটি পরিবারের মাসিক আয় ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা, ২০১০ সালে এর পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৪৭৯ টাকা। এ সময়ে স্বাভাবিকভাবে বেড়েছে ব্যয়ের পরিামাণও। বর্তমানে পরিবার প্রতি মাসিক ব্যয়ের পরিমাণ ১৫ হাজার ৯১৫ টাকা, যা ২০১০ সালে ছিল ১১ হাজার ২০০ টাকা।

২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী মোট খাদ্যগ্রহণের হার আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। ২০১০ সালে দৈনিক খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার গ্রাম, যা ২০১৬ সালে হয়েছে ৯৭৬ গ্রাম। চাল ও আটা খাওয়ার পরিমাণ আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। অন্যদিকে ডাল, শাক-সবজি, মাংস ও ডিম খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। ২০১০ সালে চাল এবং আটা গ্রহণের পরিমাণ ছিল দৈনিক ৪১৬ গ্রাম এবং ২৬ গ্রাম। ২০১৬ সালে তা হ্রাস পেয়ে হয়েছে যথাক্রমে ৩৬৭ গ্রাম এবং ২০ গ্রাম।

জরিপমতে, প্রথমবারের মতো খাদ্য-বহির্ভূত ব্যয় খাদ্যের তুলনায় বেড়েছে, যা উন্নয়নের একটি অন্যতম দিকনির্দেশক। ২০১৬ সালে খাদ্য-বহির্ভূত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৫২ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং খাদ্য ব্যয় ৪৭ দশমিক ৭০ শতাংশ। ২০১০ সালে খাদ্য-বহির্ভূত ব্যয় ছিল ৪৫ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং খাদ্য ব্যয় ছিল ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ।

বর্তমান সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির উপকারভোগী জনসংখ্যার পরিমাণ বেড়েছে। ২০১০ সালে উপকারভোগী জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here