নওগাঁ : চাতালের ভরা মৌসুমে হরতাল আর কয়েক দফা টানা অবরোধে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের ধান-চালের বৃহৎতম মোকাম নওগাঁ।

অধিকাংশ চাল কলসহ ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে পড়ায় প্রতিদিন গুনতে হচ্ছে কোটি কোটি টাকার লোকসান।

এখানকার ধান-চাল উৎপাদন থেকে শুরু করে সরবরাহের সাথে জড়িত ৫০ হাজার শ্রমিকের দিন কাটাছে সীমাহীন কষ্টে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

এ দিকে সরকারী চুক্তি মোতাবেক মিলাররা চাল সরবরাহ করতে পারবেন কি না তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। তবে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ বিভাগ চাল সংগ্রহে সংশয় বা উদ্বিগ্ন না হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

জানা গেছে, জেলায় ছোট বড় মিলে প্রায় ১৫শ’ চালকল রয়েছে। প্রায় মাসখানেক ধরেই ৬০ ভাগ চাল কলে ধান কিনতে না পারায় বন্ধ রয়েছে। এর সাথে থেমে গেছে জেলার ধান কেনা-বেচা ও চাল উৎপাদন।

ধান-চাল কেনা-বেচায় যেখানে নওগাঁয় স্বাভাবিক ভাবে প্রতিদিন ১শ’ কোটি টাকা লেন-দেন হতো সেখানে লাগাতার হরতাল-অবরোধের মাত্র ১০ কোটি টাকা লেন-দেন হয়।

এসব মিলে চাল উৎপাদনের সাথে জড়িয়ে আছে শ্রমিক প্রায় ৫০ হাজার নারী-পুরুষ। কাজ না থাকায় কর্মহীন হয়ে বসে-বসে দিন কাটাচ্ছেন তারা। এসব শ্রমিক পরিবারের দিন কাটাচ্ছে খেয়ে-না খেয়ে। এর মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে পড়েছে বিপাকে।

সৌরভ রাইচ মিলের শ্রমিক সেলি, ফুকিলা, হামিরা বেগম জানালেন, তিন থেকে চার দিনে প্রতি চাতালের ধান শুকায়। এক চাতাল উঠলে ৬শ’ টাকা ও কিছু চাল পাই ৬ জন শ্রমিকে। এতে আমাদের কোন লাভ নাই। তারপরও হরতালে তা বন্ধ রয়েছে। নিজের থাকায় কোন জায়গা নাই। বেঁচে থাকার জন্য চাল কলে কাজ নিয়েছি। মিলের এক কোনায় বসবাস করি। বাড়তি আয় করতে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ছাগল, হাঁস, মুরগি পালন করছি। কিন্তু টানা হরতাল অবরোধে মিলাররা ধান কিনতে না পারায় আমাদেরও আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। কি ভাবে ঋণের টাকা পরিশোধ করবেন সে দুঃশ্চিনত্মাই রয়েছে। পরিবার নিয়ে এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

এমআর রাইচ মিলের শ্রমিক মিরাজুল সরদার, আরমান, মাসুদ, মিঠু জানালেন, আগে সপ্তাহে ২০ থেকে ২৫ু ট্রাক ধান চাল আনা নেয়া হতো তখন গড়ে জনপ্রতি দিনে ৪শ’ টাকা থেকে সাড়ে ৪শ’ টাকা আয় হতো। সেখানে এখন মাসে ওই পরিমাণ ধান চাল আনা নেয়া হয়নি। তাতে তাদের পরিবার নিয়ে কষ্টে চলতে হচ্ছে।

হাঁপানিয়া এলাকার আজিজুল ইসলাম ও শাহীন আলম জানান, টানা হরতাল-অবরোধে তাদের মিল ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে । এতে শ্রমিকদের কাজ না থাকায় মিল ছেড়ে চলে গেছে। ব্যাংক ঋণের সুদ, বিদ্যৎ বিল আর শ্রমিকের মজুরী দিতে হিসসিম খাচ্ছেন মিল মালিকরা। এরই মধ্যে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন অনেকে। মিল বন্ধ থাকায় সরকারী চুক্তি মোতাবেক ২৮ ফেব্রয়ারীর মধ্যে চাল সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্ক প্রকাশ করেছেন মিলাররা।

নওগাঁ ধান্য চাল আরতদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোদ বরন সাহা চন্দন জানান, বর্তমানে দুই দিন হরতালের ডাক দিলেও মূলত হরতালে আগে দিন ও পরের দিন সব মিলিয়ে ৪ দিন হরতাল হচ্ছে। হরতালে ট্রাক, বাস পোড়ানো কারণে সপ্তাহের একদিন শুক্রবার ধান চাল কেনা বেচা হচ্ছে। এতে যানবাহনের মালিকরা যানবাহনের বের করতে না দেয়ায় পরিবহনের খরচ প্রায় ৪ থেকে ৫ গুণ বেড়ে গেছে। এতে দেশের অন্য জেলায় চালের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় স্বাভাবিক।

নওগাঁ জেলা চাউল মালিক গ্রম্নপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন জানান, জেলার ১২শ’ মিলের মধ্যে ৯৯ ভাগ মিলারই বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে। ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা। হরতাল-অবরোধের কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এ পরিমাণ ঋণের প্রতিদিন প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি টাকা ব্যাংকের সুদ টানতে হচ্ছে। হিসাব করলে দেখা যাবে এক মাসে লোকসান গুনতে হয়েছে প্রায় ৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়াও অন্যান্যে খরচ তো আছেই। ইতো মধ্যে অনেক মিল বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অল্পদিনেই এ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। মিলে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এদের পরিবারের প্রায় দুই লাখ সদস্যদের জীবন-যাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। মিল বন্ধ থাকার সময় ব্যাংক ঋণের সুদ না নেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানান, জেলার ১১শ’ ৪০জন মিলারের সাথে চুক্তি রয়েছে। এবার চাল সংগ্রহের লড়্গ্য মাত্রা ১৪ হাজার ৩শ’ ৩৩ মেট্রিক টন। পহেলা ডিসেম্বর থেকে গতকাল সোমবার পর্যনত্ম ৪ হাজার মেট্রিক টন চাল ইতিমধ্যে সংগ্রহ হয়ে গেছে। প্রতি শুক্রবার ও রাত করে চাল সংগ্রহ করার কারণে লড়্গ্য মাত্র ব্যাহত হওয়ার অশঙ্কা নাই। বাঁকি চাল নির্ধারিত সময়ের আগেই সংগ্রহ হয়ে যাবে বলে আশা ব্যক্ত করেন।

গত ১ মাসে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার লেন-দেন থেকে বঞ্চিত হয়েছে নওগাঁর চাল ব্যবসায়ীরারা। উভয় জোটকে সহিংসতা পরিহার করে দেশ বাঁচানো জন্য সমঝোতার পথে এগিয়ে আসার আহবান জানান সংশিস্নষ্টরা। এছাড়া এ শিল্প ও দেশকে বাঁচানোর কোন পথ নেই বলে জানান ব্যবসায়ী নেতারা।

তন্ময় ভৌমিক/

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here