কলিট তালুকদার, পাবনা প্রতিনিধি ::
দেখে ৭-৮ বছরের শিশুর মতো মনে হলেও মেয়েটি প্রাপ্তবয়স্ক, পড়েন পাবনার আটঘরিয়া সরকারি কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষে। বাড়ি পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার চাঁদভা ইউনিয়নের বেরুয়ান গ্রামে। বাবা দরিদ্র কৃষক তাইজুল ইসলাম ও মা নাসিমা খাতুন দম্পতির মেয়ে তানিয়া। তিন ভাইবোনের মধ্যে তানিয়া বড়। জন্মনিবন্ধন সনদ অনুযায়ী তানিয়ার জন্ম ২০০৩ সালের ১৩ এপ্রিল। বয়স বাড়লেও শারীরিক গঠন হয়নি তার।
পরিবারের সদস্যরা জানান, জন্মের কয়েক বছর পর তারা বুঝতে পারেন, তানিয়া বড় হচ্ছে না। তখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। প্রথমে তাকে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলেন, মেয়েটির অনেক দিন উন্নত চিকিৎসা করতে হবে। চিকিৎসা শুরু করা হয়। ৩ থেকে ৪ মাস ওষুধ খাওয়ানোর পর টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। পরে আর কোনো চিকিৎসা করা হয়নি।
বয়সের তুলনায় শারীরিক ভাবে বেড়ে না উঠায় সমাজের লোকও তাকে বাঁকা চোখে দেখেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে ভর্তি নিতে চায়নি। কিন্তু অদম্য তানিয়া থেমে থাকেননি। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তানিয়া চালিয়ে গেছেন লেখাপড়া। বেরুয়ান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক, ২০১৯ সালে বেরুয়ান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ২০২১ সালে বেরুয়ান মহিলা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে বর্তমানে আটঘরিয়া সরকারি কলেজে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম বর্ষে পড়ছেন।
পাবনা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র মেডিসিন কনসালটেন্ট ডাঃ সালেহ মোহাম্মদ আলী বলেন, এই মেয়েটির কথা আমিও শুনেছি। তবে তাকে আমি এখনো দেখিনি। ওর অতীতের চিকিৎসাপত্র এবং পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। বিভিন্ন কারণে এই রকম হয়। তার ছোটবেলা থেকেই এই রকম নাকি খানিকটা বড় হওয়ার পর হ্রাস পেয়েছে সেটা জানতে হবে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মতো তার চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
তানিয়ার বাবা তাইজুল ইসলাম বলেন, টাকার অভাবে মেয়েকে চিকিৎসা করাতে পারিনি। লেখাপড়ার প্রতি তানিয়ার আগ্রহে কষ্ট করে হলেও ওকে লেখাপড়া করাচ্ছি। অনেকেই অনেক কথা বলে। পড়াশোনা করিয়ে লাভ নেই, ও ছোট, ওর চাকরি হবে না। এ রকম অনেক কথা শুনতে হয় মানুষের মুখ থেকে। মাঝেমধ্যে তানিয়া শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পরে। তার চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা প্রয়োজন। কিন্তু আমি সংসার চালাতেই হিমশিম খাই, চিকিৎসা করাব কীভাবে?
তানিয়ার মা নাসিমা খাতুন বলেন, আমার মেয়ে অনেক ছোট হওয়ায় সমবয়সীরা তার সঙ্গে মেশে না। ওর বয়সী অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে সংসার করছে। অনেক মানুষ অনেক কটূক্তিমূলক কথা বলে। মাঝে মধ্যে স্কুল-কলেজ থেকে অভিমান করে বাড়ি ফিরে আসতো। তারপরও পড়ালেখা করছে। এটা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে। এখন সরকারের কাছে আমার আবেদন- যেন তানিয়ার জন্য কিছু একটা করে।
তানিয়ার বলেন, ক্লাসে গেলে অনেকেই আমার সঙ্গে ক্লাসে বসতে চায় না, খেলতে চায় না। আমার বন্ধুরা শারীরিক ভাবে বড় হওয়ায় আমাকে খেলতে নেয় না, আবার ছোটদের সঙ্গে খেলতেও ভালো লাগে না।
তানিয়া আরো বলেন, আমার ইচ্ছে আছে আইনজীবী হওয়ার। কিন্তু মানুষ বলে- তুমি খাটো মানুষ আইনজীবী হতে হলে লম্বা-বড় হতে হয়। তারপরও আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব। কিন্তু আমার বাবা-মা অনেক দরিদ্র তারা আমার পড়ালেখার খরচ দিতে পারছে না।
আটঘরিয়া সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শরিফুল আলম বলেন, তানিয়া যখন আমাদের এখানে ভর্তি হতে আসে তখন আশ্চর্য হয়ে যাই। পরে জানতে পারি তার শারীরিক সমস্যা আছে। তারপর কলেজ কর্তৃপক্ষ তার লেখাপড়ার সকল খরচ ফ্রি করে দিয়েছে। পরীক্ষার ফি, টিউশন ফি, বই-খাতাসহ সকল খরচ কলেজ কর্তৃপক্ষ বহন করছে। আমরা তার সহপাঠীদেরও বলে দিয়েছি যেন তার সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করে।