টনক নাড়িয়ে দিয়েছে।রবীন্দ্র নাথ পাল ::

গত ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পেশোয়ারে একটি স্কুলে হামলা চালিয়ে ১৩২ জন শিশু শিক্ষার্থী সহ ১৪১জনকে হত্যা করেছে এক দশকের বেশী সময় ধরে দুধ কলা দিয়ে পোঁষা জঙ্গী তালেবান বাহিনী।

মর্মান্তিক ও হৃদয় বিদারক এ ঘটনায় পুরো বিশ্ব হতবাক। বিস্মিত। যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে ইসলাম কায়েমের নামে মুসুলমান হত্যা করে তারা আসলে কোন ইসলাম কায়েম করতে চায়-এ প্রশ্ন রেখেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্ত কারী কর্মকর্তা আব্দুর কাহ্‌হার আকন্দ। মুক্ত ময়মনসিংহ উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানমালার তৃতীয়দিনের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।

পাকিস্তানের ৬৭ বছরের ইতিহাসে অর্দ্ধেক সময় সেনা শাসিত সরকার সে দেশটি শাসন করেছে। সামরিক শাসকরা নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত সব সময় ধর্মীয় সংগঠনের সহায়তা পেয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে খুব বেশী দুরে যাবার প্রয়োজন নেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসে শাহ আজিজুর রহমানকে বানালেন প্রধানমন্ত্রী। কুখ্যাত রাজাকার আব্দুল আলিমকে বানালেন রেলমন্ত্রী। জনগনকে ধোঁকা দেবার জন্য সংবিধানে যোগ করলেন বিসমিল্লাহ রহমানে রাহিম। উদ্দেশ্য একটাই সামরিক উর্দী ছেড়ে আসতে এসবের সাথে আপোষ করা ছাড়া বিকল্প পথও নেই।

জেনারেল জিয়ার আমলে এদেশে নিষিদ্ধ জামায়াত ইসলামী রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েই ধর্মের নামে অপকর্মে জড়িযে পড়ে। নিষিদ্ধ জামাত মাঠে নেমেই শুরু করে ষড়যন্ত্র। ৭১’এর এই পরাজিত শক্তি এ দেশের স্বাধীনতা আজো মেনে নেয়নি। স্বাধীনতা পুর্ব ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী চক্রান্তের ফসল জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে স্ব-পরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের কুৎসা রটিয়ে তার বিশাল ইমেজ ও স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির চক্রান্ত বাস্তবায়নে মাঠে নামে এই স্বাধীনতা বিরোধী ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী। যা আজো চলছে।

এরপর এরশাদ ক্ষমতায় এসে মৌলবাদী গোষ্ঠীকে খুশী রাখার জন্য ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষনা করে কৃচ্ছতা সাধনের নামে সাইকেল চড়ে অফিসে গিয়ে লুটপাটের রাজনীতি শুরু করে।শ্রদ্ধেয় শিল্পী পটুয়া কামরুল এই এরশাদের নাম দিয়েছিলেন বিশ্ব বেহায়া। ধর্মের নামে সাধারন মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য ইনকিলাবের মাওলানা মান্নান রাজাকারকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। মন্ত্রী করেছিলেন মানবতা বিরোধী অপরাধে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে।

এভাবেই ৭৫’ থেকে ৯০পর্যন্ত কখনো উর্দী পড়ে, কখনো সাদা পোষাকে সামরিক শাসকরা দেশ চালিয়েছিল। পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল মৌলবাদীদের। স্বাধীনতার ২৮ বছর পর পর্যন্ত মৌলবাদীরা মাঠে অবাধে বিচরন করে নিজেদের হৃষ্টপুষ্ট করে একসময় জেএমবি’র মাধ্যমে ইসলামী শাসন কায়েমের লক্ষ্যে সারা দেশে বোমা ফাঁটিয়েছিল। ২১শে আগষ্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে  বোমা মেরে শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল।

আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন মোকাবেলায় আমেরিকা যে তালেবান বাহিনী তৈরী করেছিল, সেই তালেবানরা নাইন ইলেভেনে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আত্মঘাতি বিমান হামলায় হাজার হাজার মানুষের প্রান সহ ধ্বংস করেছিল ওয়াল্ড ট্রেড সেন্টার-তখন থেকেই তালেবান দমনের নামে মুসলিম বিশ্বে আমেরিকা একতরফা সন্ত্রাস(!) চালিয়েছে।

নিজেদের ঘরে হামলা না হলে হয়তো আমেরিকা তার স্বার্থে আজো দুধ কলা দিয়ে সাপ পুঁষতো। প্রয়োজনে ব্যবহার এবং প্রয়োজন ফুঁরোলেই দমনের নামে হামলা-হত্যা। কখনো নিজেদের সৈন্য পাঠিয়ে,কখনো সেই সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে নিরাপত্তার নামে নিলর্জ আগ্রাসন বিশ্বব্যাপী চালিয়েছে আমেরিকা।

গত ১৭ই ডিসেম্বর পেশোয়ারে সেনা নিয়ন্ত্রিত  স্কুলে হামলা চালিয়ে ১৩২জন ছাত্র-ছাত্রী সহ ১৪১ জন তালেবানের হাতে হত্যার পর নড়ে চড়ে বসেছে পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের সরকার। জরুরী বৈঠক করে সব দলের সাথে। মন্ত্রী পরিষদের বৈঠকেও বিস্তারিত আলোচনা করেন। সেনা প্রধানের সাথেও বৈঠক করে আশু করনীয় নিয়ে আলোচনা করে ৬ বছর যাবৎ স্থগিত থাকা ফাঁসির কার্যকরের উদ্যেগ নেন। প্রত্যাহার করেন ফাঁসির স্থগিতাদেশ। এরপরই সাবেক সেনা সদস্য আকিল ওরফে ডা: উসমান ও আরশাদ মেহমুদকে ফাঁসি দেয়া হয়। শনিবার রাতে

আরো ৪ জঙ্গীর মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। এই চার জন হলেন জুবায়ের আহমেদ, রশিদ কোরেশী, গোলাম সারওয়ার ভাট্রি ও আখলাক হোসেন। মঙ্গলবার আরো দু’জনের ফাঁসি কার্যকরের কথা ছিল। এরা হলো আতাউল্লাহ ওরফে কাসেম ও মো: আজম ওরফে শরিফ।

পাকিস্তানের সেনা প্রধান রাহিল আটক থাকা ৩ হাজার জঙ্গীর মৃত্যুদন্ড কার্যকরের জন্য প্রধানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে টুইটার একাউন্টে বার্তা পাঠান। এর আগেই তিনি ৬ জঙ্গীর মৃত্যু পরোয়ানা সই করেন।এদিকে পাকিস্তানের পেশোয়ার ও উত্তর ওয়াজিরিস্তান, খাইবার এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৩শ জঙ্গীকে আটক করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। মারা গেছে ৭০ জন জঙ্গী।

প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ সেনাপ্রধান রাহিল সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা সেনাসদরে আয়োজিত বৈঠকে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নুন্যতম শৈথল্য দেখানো হবেনা এবং কঠোর ব্যবস্থা গ্রহনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অপরদিকে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নেসার আলী খান ঘোষনা দিয়েছেন কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ৫শ জঙ্গীর ফাঁসি কার্যকর করা হবে।

পেশোয়ারের স্কুলে টিটিপি’র জঙ্গীদের ভয়াবহ হামলায় আরেক জঙ্গী সংগঠন আলকায়েদা’র দক্ষিন এশিয় প্রধান ওসামা মেহমুদ বলেন,তালেবানের হত্যা যজ্ঞের ঘটনায় কষ্টে আমাদের বুক ফেঁটে যাচ্ছে। ঘটনাটিতে আমরা খুবই দু:খিত। আমরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে নিরীহ নারী ও শিশু, আমাদের মুসলিম ভাইদের বিরুদ্ধে নয়। আলকায়েদার এ বিবৃতি প্রমান করে টিটিপি’র এ নৃশংসতা কত ভয়াবহ ও জগন্য।

ওআইসি এ ঘটনায় অচিরেই পেশোয়ারে একটি শান্তি সম্মেলন করতে যাচ্ছে। পুরো বিশ্ব টিটিপি’র এ হামলায় হতভম্ব। বিস্মৃত। এমন জঘন্য হত্যাকান্ডের পর ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পুরো বিশ্বের ধিক্কার পাকিস্তানী প্রশাসনের টনক নাড়িয়ে দিয়েছে।

দীর্ঘ একদশকের বেশী সময় ধরে যে প্রশাসন দুধ কলা দিয়ে সাপ পুঁষেছে-সেই প্রশাসনকেই মরন ছোবল দিয়ে প্রমান করেছে এরাও ক্ষমতা প্রত্যাশী। অচিরেই এদের নির্মুল করা না গেলে বিষের ছোবল ছড়িয়ে পড়তে পারে অন্য আরেক পেশোয়ারে। যা হবে আরো মর্মান্তিক ও দু:খজনক।

২৪/১২/১৪

 

লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আজকের বাংলাদেশ, ময়মনসিংহ, মোবাইল: ০১৭১৩৮১৯২৯৪

 

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here