দিলারা মেসবাহ :: আশ্বিন থেকে বাঁক নেয়া কার্তিকের মোহ আমার সুন্দরতম ঋতুস্পর্শ! আহা নরম আহ্লাদি রাত নামে চোখের পাতায়। বড্ড ঘুমপ্রিয় আমি।পায়ের কাছে ভাঁজ করে রাখা হালকা নকশিকাঁথা মুড়িয়ে নেই শরীরে। জানালার নেট ঠেলে সরিয়ে দেই।কেন জানেন? আমাদের ভবনের মূল ফটকের বামদিকে সপ্তপর্ণী গাছটি ফুলে ফুলে ভরপুর। আর মাতাল করা সুবাস!
গাছটি লাগিয়েছিলেন মুন্সি চাচু। বহুবছর আমাদের বাবুর্চি কাম ম্যানেজার ছিলেন। খুব ভালোবাসতেন আমাকে। চাচু লকলকে সবুজ চারাটি রোপণ করার সময় জর্দা পানের সুবাস ছড়িয়ে বলেছিলেন, ‘এইডা হইল ছাতিয়ান,ছাইত্তান গাছ। কেউ কেউ কয় শয়তাইন্যা গাছ। কিন্তু তিতিবাবু ফুলের বাসনা জব্বর।’
আমি প্রতিবাদ করেছিলাম।’কী চাচু এইটা সপ্তপর্ণী, সাত পাতার ছাতিম গাছ। ঋষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গাছের তলে বসে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। সেখানেই পরে শান্তিনিকেতন গড়ে উঠেছিল। ইতিহাস চাচু।’
চাচু ইতিহাস শুনতে আগ্রহী নন। তিনি পরম যত্নে আলগা মাটিগুলি টিপে টিপে গুড়ি মজবুত করছিলেন। আমার মা গাছপাগল মানুষ। তাঁর ব্যালকনি, ছাদে হরেক রকম ফুলের বাগান। মুন্সি চাচু বুড়ো হয়ে গেছেন।দেশের বাড়িতে চলে গেছেন। মনে পড়ে
চাচু চলে গেলে আমি খুব কেঁদেছিলাম। চাচু আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদেছিলেন। এতো মমতা!…
আজ আবার ভরা পূর্ণিমার রাত। ‘মরি যদি সেও ভালো ‘! ইচ্ছে করে গলা ছেড়ে গান গাই,কবিতা লিখি! কিন্তু কৃপণ বিধাতা এতো সম্পদ আমাকে দেন নাই। যাহোক শুনছিলাম বেগম আখতার, ‘জোছনা দিয়েছে আড়ি আসে না আমার বাড়ি।’
অথচ সেতো এসেছে ! আবার নজরুল, ‘ ‘উচাটন মন ঘরে রয় না’। আমাদের উত্তরবঙ্গে শীত খানিক জাঁকিয়েই নামে। হঠাৎ রিংটোন বেজে সারা। অন্য প্রান্তে বন্ধু শাখাওয়াত।
‘কি করিস রে’?.. ‘আমি পাগলপারা হয়ে গান শুনতাছি।গ্রিলে পূর্ণ চাঁদের আলো, বাতাসে ছাতিম ফুলের আতর রে।’..’চলে আয়।বিন্নি চালের খিচুড়ি, ইলিশ আনারস।আরও আছে তেলের পিঠা। মায়ের রান্না।’
রিকশা খুঁজছি। হঠাৎ ছাতিম গাছের তলে একটা ছায়ামূর্তি। চমকে উঠি। আমাদের মুন্সি চাচু! এখানে গাছতলায়! এগিয়ে যেতে যেতে বললাম,’চাচু এতোদিন বাদে এসেছ? বাড়ির ভেতরে যাও।খাওয়া দাওয়া কর গিয়ে। মা বাবা খুব খুশি হবেন।’
চাচুকে আর দেখতে পেলাম না। হয়ত রাতে থেকে যাবেন।
আমি রিকশায় উঠে বসেছি।আমি আবার খেতে ভালোবাসি,আড্ডা ভালোবাসি।
ব্যাপক আড্ডা, তুফান আড্ডা, তুমুল খানাপিনা!
রাত ঘন হয়ে এসেছে। রিকশার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি।এগিয়ে এলো সেই ধুসর রংজ্বলা চাদরে ঢাকা রিকশাআলা। রিকশা ছুটে চলেছে– মনে হয় বাতাস ঠেলে উড়ে চলেছে পঙিরাজ! যাদুময় আমার নিশুতি নিরীহ শহর পাবনা।
রিকশাআলা ভাইকে টাকা দিতে গিয়ে চমকে উঠলাম আবারও। আসার সময় তাড়াহুড়ো করে সিটের উপর টাকা রেখে চলে গিয়েছিলাম।
একটা হাত– হ্যাঁ একটা হা — ত বেরিয়ে এলো।
সেটা কেমনতর! ঘোড়ার খুর কব্জি থেকে দিব্যি ল্যালপ্যাল করে ঝুলছে। মুখটা চাদরে ঢেকে রেখেছে। আমি পড়ে যাচ্ছিলাম। সে আমাকে ধরে ফেলে। বরফের চেয়ে ঠান্ডা শরীর।
কোনরকমে গেটের ভিতর ঢুকেছি কী ঢুকি নাই — মুন্সি চাচু। আপাদমস্তক ধূসর চাদর জড়িয়ে।
ভারী খনখনে গলায় বললেন,’ কী হইসে তিতিবাবু?’ আমি কাঁপতে কাঁপতে বলি,’চাচু ঐ রিকশাঅলার হা– ত- টা.’.. আমি রীতিমতো তোতলাতে থাকি। আচমকা চাচু চাদরের তলা’
থেকে তাঁর হাত বের করে বললেন, ‘ এই রহম?
সেই ন্যালপেলে ঘোড়ার খুর।আমি দৌড়ে দোতলায় উঠি। এই প্রিয় কার্তিকের রাতে আমার সারা শরীরে ঘামের নদী! এলোপাথারি দরজা ধাক্কা দিতে থাকি।কলিং বেল টিপতে ভুলে গেছি। জানালায় হুহু করে বয়ে যাচ্ছে জলজ গন্ধে ভরা বুনো হাওয়া। চিৎকার করে ডাকি,’ মকবুল ঠান্ডা পা- নি।’ সে আমাদের সার্বক্ষণিক ফুটফরমাশের গৃহকর্মী। মকবুল হকচকিয়ে দৌড়ে আসে।’ মামা ফ্রিজের ঠান্ডা না
মিশাল কইরা দিমু।’ হুঙ্কার দিয়ে উঠি,’ বলদা পানি দে — জগ ভর্তি।পানি।’
মা দৌড়ে এসেছেন। কাঁপতে কাঁপতে বলি,’ মা মুন্সি চাচু এসেছেন।দেখা হয়নি?’
মকবুল হকচকিয়ে বলে, ‘কী কন মামা? তাজ্জবের কথাই না। হেয় তো কোন জন্মে ট্রাকের তলায় পইড়া মইরা গেছে গা।আমাগোর সাঁথিয়ার মানুষ। দিলডা খুবই নরম আছিল।আমগো বাড়ির লগে হের বাড়িডা।’…
যখন চেতনা ফিরে আসে দেখি কয়টি ব্যথিত, উদ্বিগ্ন মুখ আমার উপর ঝুঁকে আছে।মা বিড়বিড় করে আয়তুল কুরসি পড়ছেন। বাবা গম্ভীর মুখে পায়চারি করছেন।ঘরে কুলকুল করে বইছে বুনো বাতাস।জলজ গন্ধে ভরা।