জহিরুল ইসলাম শিবলু,লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি :: ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে লক্ষ্মীপুরের আলোচিত পৌর মেয়র তাহের পরিবারের ১০ সদস্যের বিষয়ে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় নোয়াখালীর উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলমকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে।

অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তাহের পরিবারের ১০ সদস্যের নামে কি পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে, তা জানতে চেয়ে দেশের সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেওয়া হয়েছে। দুদকের সংশ্লিষ্ট একটি দায়িত্বশীল সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। দুদক সূত্র জানায়, চলতি বছরের জুন মাসে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় নোয়াখালী থেকে লক্ষ্মীপুরের আলোচিত পৌর মেয়র আবু তাহেরসহ তার পরিবারের ১০ সদস্যের সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার জন্য চিঠি দেয় দুদক। তাহের ছাড়াও পরিবারের অপর সদস্যরা হলেন তাহেরের স্ত্রী নাজমা সুলতানা চৌধুরী, তিন ছেলে এ এইচ এম আফতাব উদ্দিন বিপ্লব, এ কে এম সালাহ উদ্দিন টিপু ও আবু সাহাদাৎ মো. শিপলু, দুই মেয়ে নাজমুন নাহার রেহানা ও শাহেলা আক্তার পিংকি, ছেলে বিপ্লবের স্ত্রী সানজিদা খায়ের, টিপুর স্ত্রী জান্নাতুল নাইম ও শিপলুর স্ত্রী নাজমুন নাহার।

সূত্র জানায়, দুদক কার্যালয়ে হাজির হয়ে সম্পদ বিবরণী দেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হলেও তাহের পরিবারের পক্ষ থেকে কেউই স্ব-শরীরে দুদকে হাজির হননি। এমনকি তারা কেউ সম্পদের বিবরণীও জমা দেননি। তাহের পরিবারের পক্ষ থেকে আয়কর দেওয়া সংক্রান্ত কিছু নথিপত্র জমা দেওয়া হয়েছিল। এরপর দুদকের পক্ষ থেকে তাহের পরিবারের জ্ঞাত আয় বর্হিভূত অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়।

সূত্র আরো জানায়, অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করার পর গত ৩০ নভেম্বর দেশের সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাহের পরিবারের কি পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে, তা জানার জন্য ব্যাংক গুলোতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে লক্ষ্মীপুরে তাহের পরিবারের স্থাবর সম্পদের বিষয়েও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, দীর্ঘ দিন ধরেই লক্ষ্মীপুরে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আসছে তাহের পরিবার। আবু তাহের বর্তমানে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এছাড়াও বর্তমানে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। তার স্ত্রী নাজমা সুলতানা চৌধুরী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য। গত নির্বাচনে তিনি সংরক্ষিত আসনের এমপি পদে প্রার্থী ছিলেন। বড় ছেলে বিপ্লব একাধিক খুনের মামলায় প্রথমে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ও পরে যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে ছিলেন। কারাগারে থাকা অবস্থাতেই তিনি বিশেষ ব্যবস্থায় বিয়ে করেন। খুনের একটি মামলায় রাষ্ট্রপতির অনুকম্পায় ক্ষমা পান তিনি। আরেকটি মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার হওয়ার পর ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন তিনি। আরেক ছেলে এ কে এম সালাহ উদ্দিন টিপু বর্তমানে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি গত উপজেলা নির্বাচনে নৌকার বিপক্ষে নির্বাচন করে জয়ী হন। ছোট ছেলে শিপলু এলাকায় ঠিকাদারি করেন।

সূত্র আরো জানায়, লক্ষ্মীপুর মানেই ‘তাহের পরিবারের কথাই শেষ কথা’ হিসেবে বিবেচনা করে স্থানীয় লোকজন। তাহের পরিবারের কথার বাইরে কেউ কোন কিছু করতে পারেন না। লক্ষ্মীপুরে একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন তারা। পৌরসভাসহ জেলার সকল ঠিকাদারি কাজে অন্য কোন প্রতিষ্ঠান কাজ পেলেও তাহের পরিবারের কাউকে না কাউকে কমিশন দিতে হয়। আগের মতোই তাহেরপুত্র বিপ্লব এখন সাধারণ মানুষের কাছে ত্রাস হিসেবেই পরিচিত। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন জানান, প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে তাহের পরিবারের সদস্যরা হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে স্থানীয়ভাবে প্রচলিত রয়েছে। দুদক সঠিকভাবে ও প্রভাবমুক্ত হয়ে অনুসন্ধান করলে তাদের বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের সন্ধান পাবে। তবে লক্ষ্মীপুরে তাহের পরিবারের স্থাবর সম্পত্তির চেয়ে নগদ অর্থ বেশি। এ সব অর্থ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ অন্যান্য দেশে পাচার করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তাহের পরিবারের মধ্যে মেজ ছেলে টিপু ও ছোট ছেলে শিপলু সবচেয়ে বেশি অবৈধ অর্থের মালিক হয়েছেন বলে এলাকায় প্রচারণা রয়েছে। এ ছাড়া তাহের সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে বিদ্রোহী প্রার্থীদের ইন্ধন দিয়ে আলোচনায় আসেন।

দুদকের অনুসন্ধান ও অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পৌর মেয়র আবু তাহেরের মেজ ছেলে এ কে এম সালাহ উদ্দিন টিপু বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তা মিথ্যা। দুদক আমাদের চিঠি দিয়েছিল, আমরা সেই চিঠি অনুযায়ী নথিপত্র দুদকের নোয়াখালী কার্যালয়ে জমা দিয়েছি। আমাদের কোন অবৈধ সম্পদ নেই। যা আছে সবই আয়কর নথিতে উল্লেখ রয়েছে। টিপু বলেন, আমাদেরকে হয়রানি করার জন্য এসব করা হচ্ছে। যখনই নির্বাচন সামনে আসে, তখনই একটি পক্ষ আমাদের বিরুদ্ধে নানা অপ-তৎপরতা চালায়। সামনে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ কারণে আমার বাবা ও আমাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসব অপ-প্রচার চালানো হচ্ছে। তাহের পরিবারের ১০ সদস্যের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা তাহের পরিবারের সম্পদ অনুসন্ধান শুরু করেছি। অনুসন্ধান বর্তমানে চলমান রয়েছে। জুনের শুরুতে এ অনুসন্ধান শুরু হয়। নভেম্বরের শেষে এসে বিভিন্ন ব্যাংকে চিঠি পাঠানো হয়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আমাদের কাছে তথ্য আসতে শুরু করেছে। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কমিশন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here