বোরহান উদ্দিন :: বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষার্থী যখন পড়াশুনা শেষ করে বিসিএস বা অন্যান্য চাকরির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে। সেখানে অনেক তরুণ উদ্যোক্তা চাকরি না করে বরং চিন্তা করছেন একটু ভিন্ন ভাবে। যদিও তারা জানে পথটা বন্ধুর, তারপরও এগিয়ে যেতে হবে। নিতে হবে নতুন নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগ। যা চাকরি করার শিকল থেকে মুক্ত করে, চাকরি দেওয়ার মহৎ সুযোগ সৃষ্টি করে দিবে। সোনার হরিণের পেছনে না ছুটে উদ্যোগ গ্রহণ করা অবশ্যই মহৎ। কিন্তু সমৃদ্ধি আনতে হলে প্রয়োজন সামগ্রিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ এবং পাশাপাশি প্রত্যেকের নিজস্ব স্থান থেকে এগিয়ে আসা।
যে দেশে তরুণদের সংখ্যা বেশি, সে দেশে উন্নায়ন হচ্ছে বিদ্যুৎ গতিতে । সত্যি তাই কি হচ্ছে…? সেক্ষেত্রে বলা যায়, আমাদের বাংলাদেশ এক সম্ভাবনার দেশ। তবে যাদের কাছে অর্থ আছে; বর্তমান শুধু তাদেরই উন্নতি হচ্ছে। আর দিন দিন লাখ লাখ বেকার হতাশা হয়ে যুক্ত হচ্ছে নানা ধরনের অনৈতিক কাজে। যা আগামীতে এ দেশের জন্য হুমকি কিংবা বিপদ নিয়ে আসতে পারে। তেমনই তরুণদের নানা ইচ্ছের মধ্যে উদ্যোক্তা হবার চেষ্টা কথা জানবো…
দেশের উন্নয়নে তরুণ প্রজন্মের উদ্যোক্তারা সামনে এগিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারা কি তা করতে পারছে? নাকি গাঁদা গাঁদা বই পড়ে চাকরীর জন্য প্রস্তত হচ্ছে। কোন তারা উদ্যোক্তা হতে পারেছে না, এমন প্রশ্নের উত্তর অনেক কঠিন আবার অনেক সহজ।
এই প্রসঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ৫ বছর পর পর রাজনৈতিক দল পরির্বতন হচ্ছে, নীতিও পরির্বতন হচ্ছে। প্রায় সব কয়টি রাজনৈতিক দল তরুণদের উপর ভর করে ক্ষমতায় আসে। কিন্তু তরুণদের কি তেমন কোন উন্নতি হচ্ছে? হ্যাঁ, হচ্ছে.. কিন্তু কয়খানি হচ্ছে?
বিবিএসের জরিপে গত এক বছরে এক লাখ বেকার বেড়েছে। তার মানে দেশে বেকারের সংখ্যা মোট ৪৫ ভাগ। কোনো আমরা লাখ লাখ বেকারকে কাজে লাগতে পারছি না? দেশ তো ডিজিটাল খতে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কত হাজার বেকার কর্মসংস্থান করতে পারছে বা কত জন আগামীর তরুণদের জন্য পথ দেখাতে পেরেছে?
বিশ্ব মন্দার ভেতরে থেকে শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে এই তরুণরা। তবে ব্যবসা প্রসারে নতুন শিল্প উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণ বড় বাধা। যারা বয়সে তরুণ, বুদ্ধি আর পরিশ্রমে দিঢ় প্রতিজ্ঞা বদ্ধ। যুকি নেবার ক্ষমতা থাকার পরও তারা ব্যাংক থেকে কোন সহায়তা পায় না। আপনি যদি আমার সাথে এক মত না হন, তাহলে একবার কোন ব্যাংকে গিয়ে বলুনঃ “আমি এক জন উদ্যোক্তা হতে চাই। আমি কি ভাবে ব্যাংকে থেকে থেকে সাহায্য পেতে পারি?” ব্যাংক আপনার হাতে একটা কাগজ দিয়ে বলবেঃ এই শর্ত অনুসারে কাগজ পত্র নিয়ে আসেন। তারপর আমরা বিষয়টা, খতিয়ে দেখবো। এই কাগজে আপনার চৌদ্দ গুষ্টি ইতিহাসের কাগজ লাগবে। যা তৈরি করতে আপনার কবরে যাবার সময় হয়ে যাবে।
অন্য দিকে, যারা কোটি কোটি টাকা ঋণ খেলাপি তালিকায় আছে। ব্যাংক তাদের কাছে গিয়ে বসে থাকে। আর বলে স্যার, আপনি আমাদের সাথে ব্যবসা করুন। আমরা আপনাকে সহজ শর্তে ঋণ দিবো। এই হচ্ছে, আমাদের ব্যাংক…
বর্তমানে এত সংকট বা সীমিত সম্পদ থাকার পরও তরুণেরা সংকট থেকে মুক্তির জন্য নিজ নিজ অবস্থান থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর ঠিক তখন একদল বিশেষজ্ঞ বলেন, বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনার সুযোগ তৈরি হচ্ছে এবং দিন দিন বিনিয়োগ বাড়ছে। একদল বিশেষজ্ঞরা কি তরুণদের জন্য কিছু করছেন? নাকি এসি রুমে বসে তরুণ তরুণ করে কান্না করছেন?
পৃথিবীতে অসংখ্য সফল উদ্যোক্তা রয়েছে যারা আজ নিজ উদ্যোগ ও স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করে তাদের দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্বের অন্ধ ছোবল থেকে রক্ষা করেছে দেশের অগণিত যুব সমাজকে। তেমনই বাংলাদেশের তরুণদের জন্য আইকন হচ্ছে, আনিসুল হক, এ. কে. আজাদ, মতিউর রহমান, স্যার ফজলে হাসান আবেদ, ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ আরো অনেকে। আনিসুল হক বলতেন “মানুষ তার স্বপ্নের চেয়ে বড়” আসলে তাই।
এ. কে. আজাদ নিজের ব্যবসায়িক সফলতার বিভিন্ন দিক তুলে ধরার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতাও বর্ণনা করে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি কিছু ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তখন দেশে প্রকট রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। এ কারণে তার এবং আরও অনেক তরুণ উদ্যোক্তার শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। তার মধ্যে এক ধরনের জেদ চেপে ধরে। তিনি নিজেকেই চ্যালেঞ্জ করে আবার শুরু করেন ব্যবসা। তিনি বলেন, আমাকে পারতেই হবে। এর পর নতুন উদ্যমে আবার ব্যবসা শুরু করেন এ. কে. আজাদ এবং সফল হন।
নিজের সফলতার জন্য বাবার কথা স্মরণ করে এফবিসিসিআইর সাবেক এ সভাপতি বলেন, তিনি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তারা পাঁচ ভাই ও চার বোন। বাবার কৃষিকাজ এবং বড় ভাইয়ের চাকরির আয় দিয়েই তাদের সংসার চলত; কিন্তু তার বাবা সব সময়ই তাকে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। তিনি তার আজকের সফলতার পেছনে বাবার অনুপ্রেরণা সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে জানিয়ে বলেছেন, ‘আমার মধ্যে স্বপ্ন ছিল একদিন বড় হবো।’ সততা ও ওনারশিপের মধ্য দিয়েই এই সফলতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে তিনি শ্রমিকদের যথাযথ সম্মান দিয়েই মালিককে কাজ আদায় করতে হয় বলে সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন।
তরুণদের সৃজনশীলতা প্রয়োগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের আজকের তরুণেরাই পরিবর্তনের নিয়ামক, পরিবর্তনের শক্তি। তাদেরই সৃজনশীলতা প্রয়োগে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এখন তরুণ। এই তরুণেরা বিশ্বে তাদের দক্ষতা, সক্ষমতা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। কাজেই তারা সামাজিক ব্যবসাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশের জমি অপ্রতুল। পুঁজির অভাবে আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আনছি। প্রযুক্তিতে দখল নেই বলে তা আমদানি করছি। কিন্তু সৃজনীশক্তিতে আমাদের বিশাল সম্ভাবনা আছে। এই জ্ঞানবিকাশের জন্য সৃজনীশক্তি প্রয়োজন। সৃজনীশক্তিই আমাদের ভবিষ্যৎ রচনা করবে।’ সামাজিক ব্যবসাকে ‘বুদ্ধির খেলা’ হিসেবে অভিহিত করে ইউনূস বলেন, ‘যাদের বুদ্ধিমত্তা আছে, তারাই এখানে সাফল্য আনতে পারবে। এর জন্য খুব ভালো ছাত্র হতে হবে এমন নয়।’
তরুণদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, ‘সামাজিক ব্যবসার জন্য পুঁজি বা টাকার চিন্তাটাও জরুরি নয়। বরং নতুন নতুন ধারণা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য চাই সৃজনীশক্তির বিকাশ ও প্রয়োগ।’
সামাজিক ব্যবসার উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা কোনো মুনাফা নেন না, শুধু মূল পুঁজি ফিরিয়ে তুলে নিতে পারেন। মুনাফা ব্যবহার করা হয় ব্যবসার সম্প্রসারণে। আর ব্যবসাটি হয় সামাজিক কোনো একটি সমস্যা সমাধানের সহায়ক হিসেবে। মুহাম্মদ ইউনূস এই সামাজিক ব্যবসা ধারণার প্রবক্তা।
সামাজিক ব্যবসার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইউনূস বলেন, ‘বিশ্বে কোটি কোটি তরুণ কর্মহীন ও বেকার। কোটি কোটি মানুষ গরিব। এই বেকারত্ব বা গরিবির জন্য তারা দায়ী নয়। দায়ী বিদ্যমান পদ্ধতি। সুতরাং, তরুণদের এই পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। সামাজিক ব্যবসা এ ক্ষেত্রে বড় একটি হাতিয়ার হবে।’
ক্ষুদ্র ব্যবসা ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিশ্বায়ন থেকে সুবিধালাভের বিষয়টি নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিশ্বের তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোয় যুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন। সেক্ষত্রে শিক্ষা সংস্কারের প্রতি বিশেষ জোর দেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। সাথে সাথে তথ্যপ্রযুক্তি যুগের উপযোগী কর্মসংস্থানসহ নিজে কিছু করার জন্য তরুণদের প্রস্তুত করতে হবে। তরুণ প্রজন্ম জানতে চাওয়ার চেয়ে যুক্ত হতে বেশি আগ্রহী। প্রযুক্তি হয়তো বহু কর্মসংস্থান ধ্বংস করেছে। আবার একই সঙ্গে বহু সুযোগও তৈরি করেছে।
সরকারে কাছে অনুরোধ তরুণদের কথা চিন্তা করুন, তাদের কিছু করার সুযোগ করে দিন। দেশ যেমন এগিয়ে যাবে, এতে করে তরুণরা বিপথ গামী হবে না। শেষ কথা হচ্ছে, আর কেবলমাত্র সরকারি কিংবা বেসরকারি চাকরি করে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্ভব না। এরজন্য প্রয়োজন তরুণদের নতুন নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগ, যার ফলে এগিয়ে যাবে দেশ, সমৃদ্ধ হবে দেশের অর্থনীতি।
লেখক: সমাজ উন্নয়ন কর্মী ও সংগঠক। borhan.2012@yahoo.com