১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া দেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গেলো বছরের পয়লা জুলাই বিশ্বের শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয়ের দলে যোগ দিয়েছে দেশসেরা এই বিদ্যাপীঠ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ জন শিক্ষার্থী নিজেদের ক্যাম্পাস নিয়ে তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন মনোভাব জানিয়েছেন। নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা ব্যক্ত করেছেন। স্বপ্নবিলাসী, আশাবাদী এসব শিক্ষার্থীর কথাগুলো তুলে ধরেছেন ইউনাইটেড নিউজ টুয়েন্টিফোর’র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ফারহান ইশরাক:

শাহরিয়ার শহীদ শুভ
শিক্ষার্থী, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

‘শতবর্ষে ঢাবিঃ শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা’ শিরোনামের লেখাতে শতবর্ষ পরে যেন শিক্ষার্থীদের সমসাময়িক হতাশা আক্ষেপ গুলো না থাকে সে বিষয়গুলো ফুটিয়ে তোলা-ই সমীচীন। একজন শিক্ষার্থী হিসাবে আমার প্রত্যাশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের প্রতি, শিক্ষকদের প্রতি, ছাত্রদের প্রতি, কেননা আমার প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে এই তিন শ্রেণীর মিথস্ক্রিয়া ব্যতীত সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের কে স্বাধীনতা অর্জনে অনবদ্য অবদান রাখা ঢাবি শতবর্ষে নিজে কতটা স্বাধীন! এই প্রশ্নে জর্জরিত প্রশাসনের প্রতি প্রত্যাশা নিজেকে সরকারবিরোধী বা সরকারবান্ধব মতাদর্শের গোলামী না করে সত্যিকারের ছাত্রবান্ধব স্বাধীন ও দৃঢ়চেতা হিসাবে গড়ে উঠবে! দীর্ঘামেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে ঢাবিকে পূর্ণাঙ্গ আবাসিক ও গবেষণা উপযোগী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা-ই প্রশাসনের প্রতি প্রত্যাশা।

শিক্ষক ও ছাত্রের দূরত্ব ঢাবিতে সবেচেয়ে বেশি পীড়া দেয়। একদিকে শিক্ষকদের অাভিজাত্য ও বৈভবের প্রদর্শনী, অন্যদিকে ছাত্রদের পাশবিক জীবনযাবন সবমিলিয়ে এক লক্ষণীয় মানসিক দুরত্ব লক্ষ্য করা যায়। আশা করি, অবকাঠামোগত দূরত্ব লাঘবের পাশাপাশি ছাত্র-শিক্ষকদের মানসিক দুরত্ব ও কমে আসবে।

তবে আমার সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা শিক্ষার্থীদের ঘিরে। প্রশাসন ও শিক্ষকদের পূর্ন সহযোগিতা পেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আধুনিক বিশ্বউপযোগী বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তর করার মূল কারিগর হবে শিক্ষার্থীরাই। গবেষণা, বিজ্ঞানচর্চার পাশাপাশি সুষ্ঠু সংস্কৃতি, সাহিত্য, প্রগতিশীলতা, মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও শিক্ষার্থীদের অধিকারবান্ধব রাজনৈতিক চর্চার ধারা চলমান রাখবে শিক্ষার্থীরা – এটাই প্রত্যাশা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হাজারো মেধাবী ছাত্রদের জীবনে ‘আলোর ফাঁদ’ হিসাবে নয় বরং বাতিঘর হিসাবে পরিণত হবে এটাই আমার প্রত্যাশা। প্র্যাচের অক্সফোর্ড ছায়ানামে পরিচিত না হয়ে বরং নিজেদেরকেই “University of Dhaka-A great University from small country” হিসাবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভের সাক্ষী হতে চাই।

অর্ণি আনজুম
শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞান বিকাশের এমন এক জায়গা যেখানে সকল শিক্ষার্থী পর্যাপ্ত সুযোগ পাবে। ঢাবির শতবর্ষে আমরা চাই এর গবেষণার ক্ষেত্র সহজলভ্য হোক। বাজেট বাড়ুক এ খাতে। সকল শিক্ষার্থীদের আবাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি হলগুলো দখলদারিত্ব মুক্ত করা সময়ের দাবি। হলের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি নতুন হল স্থাপন, বিভাগসমূহের বিশেষত কলাভবনের সংস্কার, শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু, লাইব্রেরি বর্ধিতকরণ ও বইয়ের সংগ্রহ বাড়ানো, ক্যাম্পাসে নির্দিষ্ট একটি দলের আধিপত্য রোধ ইত্যাদি বাস্তবায়িত হোক এটাই আমরা চাই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিতের উদ্দেশ্যে ক্যাম্পাস দখলমুক্তকরণ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত, শিক্ষক নিয়োগসহ সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতিসহ সকল অনিয়ম রোধ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বশীল একটি সুষ্ঠু ডাকসু নির্বাচন চাই আমরা। ঢাবির শতবর্ষে এসে আমাদের প্রত্যাশা, সকল শিক্ষার্থীদের সমান সুযোগ নিশ্চিতের সাপেক্ষে একটি পরিপূর্ণ জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র হয়ে উঠুক আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাদেকুর রহমান সানি
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার সেরা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।শুরুতে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর সাথে পাল্লা দিলেও কালক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ তার গৌরব হারাতে বসেছে। হলগুলোতে দেখা দিয়েছে আবাসন সংকট, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, লাইব্রেরিগুলোতে সিটের অপর্যাপ্ততা, ক্যাম্পাসে বায়ুদূষণ ও অসহনীয় শব্দদূষণ, নিরাপত্তাহীনতা সহ নানাবিধ সমস্যা। এর ফলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা, গবেষণা তথা মেধাবিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ পাচ্ছে না।

গবেষণাখাতে নিম্নবাজেট ও গুনগত গবেষণা ব্যবস্থার অভাব শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীলতা নষ্ট করে দিচ্ছে। একইসাথে আবাসন ও লাইব্রেরি সংকট একটা ছাত্রকে পড়াশোনাবিমুখ করে তুলছে যা পরবর্তীতে জাতির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই সমস্যাগুলো সমাধানের সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার গৌরব ও ঐতিহ্য ফিরে পাবে এবং বিশ্বে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল হবে।

মো. হাছিবুল বাসার
শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

যে উদ্দেশ্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা কতটা পূরণ হয়েছে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফেরেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকটের সমাধান, কেন্দ্রীয় ও হল লাইব্রেরীতে সিট সংকট, গণরুম-গেস্টরুম প্রথা উচ্ছেদ, অছাত্র-বহিরাগত বিতাড়ন, সান্ধ্যকালীন বাণিজ্যিক কোর্স বন্ধ, গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো, পরিবহন সমস্যা দূর করা, ক্যান্টিনে খাবারের মান বাড়ানো, সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল, রেজিস্ট্রার অফিসে ভর্তি ডিজিটালাইজেশন, শিক্ষার্থীদের স্মার্ট আইডি কার্ড প্রদান, ক্যাম্পাসে বহিরাগত যান-চলাচল সমস্যার আজও কোনো সমাধান হয় নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ঐতিহ্য ও সুনাম পুনরুদ্ধারে ঢাবির শতবর্ষে প্রত্যাশা থাকবে যেন দ্রুত আবাসন সংকট নিরসন, করোনায় সেশনজট মোকাবেলায় দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া, সন্ধ্যাকালীন কোর্সসমূহ বাতিল, লাইব্রেরীতে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা, সর্বোপরি ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি না করে সুষ্ঠু রাজনীতি এবং গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করে সকলের মতামত পেশ করার সুযোগ সৃষ্টির সমাধান নিশ্চিত করে জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত উদ্দেশ্য যেন তুলে ধরা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়টা যেন কোন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হয় সেটাই আশা রাখবো। জ্ঞান চর্চা বাদ দিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী যেন প্রমোশন কিংবা ক্ষমতার পেছনে না দৌড়ায় সেটাই প্রত্যাশা করবো। তবেই পূর্ণ হবে শতবর্ষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি। ক্যাম্পাস হবে জ্ঞান অর্জন, সংস্কৃতি ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার উদ্যান।

সানজানা হোসেন অন্তরা
শিক্ষার্থী, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সুখ্যাতি এদেশে, প্রায় সবদিক থেকে এগিয়ে দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে; এ নিয়ে কোন সন্দেহ করার অবকাশ নেই। তবে আমার সামান্য জ্ঞানে আমার কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর আবাসিক সংকট সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে মনে হয়েছে। বিশেষ করে ১ম বর্ষ ও ২য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের চরম অসুবিধার মুখে পড়তে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষার্থী হিসেবে এটাই কাম্য হবে আগামীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আবাসিক সংকট নিরসন হবে। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হল ত্যাগ এর প্রতি কড়া নজর সহ, আরো বেশি আবাসিক সুযোগ তৈরি করতে হবে; এক শিক্ষার্থী এক আসন ভিত্তিতে, দরকার হলে হল সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাতঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থীরা বারান্দায় রাত কাটাবে, এক রুমে ২০/২৫ জন থাকবে বা হল সিট না পেয়ে বাসা ভাড়া করে থাকতে বাধ্য হবে এমন পরিস্থিতি যেন না হয় তার যথাযথ ব্যবস্থা করবেন প্রশাসন এই আশাই ব্যক্ত করছি। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর চাওয়া। শতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের চাওয়ার বাস্তব রূপদানের জন্য কাজ শুরু করবেন বলে আশা রাখি।

মো. সুজন সরদার
শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১ লা জুলাই ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে। তৎকালীন ৩ টি অনুষদ ও ১২ টি বিভাগ নিয়ে যাত্রা করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখনো আমাদের স্বপ্নের সারথী। ২০২১ সালের ১লা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষে পা দেবে। অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে, বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে সামনে এগিয়ে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

পরিবর্তনের ছোঁয়ায় পাল্টেছে পৃথিবী। নতুন নতুন অভিনব কৌশলকে গ্রহণ করেছে মানুষ। তবে বদলায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া। ১০০ বছর পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভর্তি প্রক্রিয়ায় ততটা উন্নয়ন করতে পারেনি। ভর্তি হতে হলে ডিপার্টমেন্ট থেকে হল, হল থেকে সোনালী ব্যাংক, সোনালি ব্যাংক থেকে জনতা ব্যাংকে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করতে হয়।

এ পদ্ধতির পরিবর্তন করে অনলাইনে ভর্তি চালু করা হোক এটাই শতবর্ষে শিক্ষার্থীদের চাওয়া। চাকরির বাজারের করাল গ্রাসে প্রায় অর্ধমৃত হয়ে গেছে শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও থিসিসপত্র লেখা। শতবর্ষ উপলক্ষ্যে গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত হোক এটাও শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি দাওয়া উপস্থাপন করে। ডাকসু নির্বাচন অব্যাহত থাকুক এটি শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত দাবী। শতবর্ষের ক্রান্তিলগ্নে সর্বোপরি একটা আধুনিক, উন্নত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখে সকল শিক্ষার্থী।

ইউনাইডেট/সোহাগ/ফারহান

 

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here