ড. তপন রায় প্রধান, কলকাতার সাহিত্যাঙ্গনের উজ্জ্বল মুখ।বহু গুণের অধিকারী তপন রায় একাধারে গবেষক, লেখক, আবৃত্তিশিল্পী এবং সম্পাদক।কাজ করেছেন আকাশবাণী শিলিগুড়ি, কলকাতা দূরদর্শন ও দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকসহ বেশ কটি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে।বর্তমানে কলকাতা দূরর্শনের এসোসিয়েট হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত আছেন। তিনি গবেষনা করেছেন’ রাজবংশী প্রবাদের আর্থসামাজিক নান্দনিক বিশ্লেষণ’ নিয়ে।তাঁর উল্লেখযোগ্য বইসমূহ- আব্বাস উদ্দিন, রাজবংশী লোককথা, নদী ও নারীর গদ্যপদ্য।সম্পাদনা করেন ‘রাজবংশী কবিতা সংগ্রহ। আর তাহমিনা শিল্পী বাংলাদেশের একজন গণমাধ্যম কর্মী এবং কবি। সম্প্রতি তাহমিনা শিল্পী কলকাতা গিয়েছেন। কলকাতা গিয়ে সাক্ষাৎ করেছেন ড. তপন রায় প্রধান এর সাথে। পরবর্তীতে ড. তপন রায় প্রধান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‌’ব্যক্তিগত_জার্নাল (৬)’ কলামে তাহমিনা শিল্পীকে নিয়ে লিখেছেন “পরস্পর আমরা পর নই” কলামটি। সেটি এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো-

 

“পরস্পর আমরা পর নই”
।।
শিরোনামটি লিখেই থমকাতে হল। কীরম একটা লাগে না! যাঁকে আপন ভাবি, জনসমক্ষে ঘোষণা করে এখন জানাতে হচ্ছে তিনি ‘পর’ নন!
বহুবছর আগে আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছিলাম। তখন লিখতাম টিখতাম। তো সেই লেখাটির শিরোনাম ছিল, ‘রাজবংশী-বাঙালি ভাইভাই, ম্যারাপ বেঁধে বলা চাই?” নয়ের দশকের ক্রান্তিকাল তখন। অশান্ত উত্তরবঙ্গ। সুদীর্ঘকালব্যাপী নানাতর শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ মুখ্যত ভূমিপুত্রদের বিবিধ গণসংগঠন। তারমধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত KLO (কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন)। রাজধানী কলকাতা থেকে তখন সময়ান্তরেই শাসক এবং বিরোধী দলনেতাগণ, উত্তরবঙ্গের সভাসমিতিতে, ডজন ডজন লাউড স্পিকার লাগিয়ে বক্তৃতা করে জানাতেন- রাজবংশীরা আমাদের ভাই… ইত্যাদি ইত্যাদি। পাশাপাশি চলছে বিরামহীন ধরপাকড়, বিনা বিচারে অসংখ্য আটক এবং তথাকথিত ‘এনকাউন্টার’!

আচ্ছা বলুন তো, আপনার ‘ভাই’কে দেখিয়ে, আপনি কি মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করে বলবেন- ইনি আমার ভাই? একটা দেখনদারি, বিসদৃশ, বোকাবোকা ব্যাপার না? তাহলে কি ভাইয়ের প্রতি ভ্রাতৃসুলভ আচরণে বড় কোনও ফাঁক কিম্বা ফাঁকি থেকে গেছিল আপনার?
সঙ্গত কারণেই এই প্রশ্নগুলি সামনে চলে আসে তখন। ভিন্ন প্রসঙ্গ সেসব। এখন ইতিহাস। তবু অবতারণায় আনার কারণ- ঠিক সেভাবেই, আমি নিজেও, আজ থমকে গেলাম শিরোনামটি লিখে।

থমকে গেছিলাম এই সেদিনও। মেসেঞ্জারে ছোট্ট একটি মেসেজ পেলাম যখন-
“দাদা, প্রনাম জানবেন। একটি তথ্য জানালে উপকৃত হবো। কলকাতায় কি এখন খুব সমস্যা হচ্ছে? আমি যাবো বলে টিকেট কনফার্ম করলাম। এখন একজন ওখান থেকে ফোন করে বলল, টিকেট ক্যানসেল করো। এখানে খুব ঝামেলা হচ্ছে। কি করবো বুঝতে পারছি না”।
-এই উৎকন্ঠা স্বাভাবিক। রাজ্য জুড়েই প্রায় আগুন জ্বলছে তখন.. বাস পুড়ছে, ট্রেন পুড়ছে, চলছে গুলিও। গোটা দেশেই বলা যায়। NPR, NRC, CAB/CAA ইস্যুতে মুখর প্রতিবাদী/ প্রতিরোধী সাধারণ মানুষ। তারইমধ্যে প্রতিবাদী পক্ষের ‘লুঙ্গি’কে ব্র্যাকেটে ফেলে স্ট্যাম্প দেওয়া হয়েছে এক বিজাতীয় ইঙ্গিতের! যা ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতীয় আদর্শের পরিপন্থী।

অথচ কি? না একজন কবি, ঢাকা থেকে আসতে চাইছেন, কবিতার শহর কলকাতায় কবিতা পড়তে; তিনি তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে ভাবিত! কোন কলকাতা? যে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ একদিন লক্ষলক্ষ বাংলাদেশি শরনার্থীদের ঠাঁই দিয়েছিল। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষেই দিয়েছিল। হাসিমুখে। আকাশবাণী কলকাতা থেকে (গোপনে) চালাতে দিয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার’! যেখানে আজও–
“আমাদের এক সুখ এক কান্না এক পিপাসা
ভূগোল ইতিহাসে আমরা এক
এক মন এক মানুষ এক মাটি এক মমতা
পরস্পর আমরা পর নই
আমরা পড়শী –আর পড়শীই তো আরশি..”

সেই ‘আরশি’তেই তৎক্ষণাৎ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল পড়শিনগরের ভিন্ন এক ছবি… স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষিত হবার পরপরই, আমি গেছিলাম সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে; আমাদের ‘বড়শশী’ গ্রামের ফেলে আসা বাড়িতে। সীমান্ত তখন শিথিল। এপার-ওপার করা যেত অক্লেশেই। সেই সুযোগ নিয়েই কৌতূহল মেটাতে। যে পৈতিৃক ভিটের গল্প শুনেছি ছোটবেলায়; একবার ত চোখের দেখায় দেখতে।
আহা কী দেখিলাম; জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না! কী সে আপ্যায়ন; ছবির মত আজও সযত্নে রক্ষিত মনের কোণে! বাড়িটি তখন ওখানকারই এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের দখলে। হলেও, ওঁরাই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন, কোনটা ছিল কার কার ঘর, কোনটা বৈঠকখানা, রান্নাঘর, খাবার ঘর, গরু আর ঘোড়া রাখার ঘর। এমনকি ঠাকুরদালানও- যার কোনো অদলবদল তাঁরা করেননি। করবেনই বা কেন? তাঁরাও তো মনে করেন-
“আমরা এক বৃন্তে দুই ফুল, এক মাঠে দুই ফসল/
আমাদের খাঁচার ভিতরে একই অচিনপাখির আনাগোনা/ আমার দেবতার থানে তুমি বটের ঝুরিতে সুতো বাঁধো/ আমি তোমার পীরের দরগায় চেরাগ জ্বালি”।

–আসার সময় হাতে তুলে দিলেন সব দাদাদের জন্য ভাউলাগঞ্জের মিহি সুতোর লুঙ্গি। গল্প শুনেছিলাম সেই বিখ্যাত লুঙ্গির। জ্যাঠা, দাদাদের খুব প্রিয় ছিল।
মুহূর্ত অপেক্ষা করলাম না আর। মেসেঞ্জারেই আমার ফোন নম্বর দিয়ে ফিরতি বার্তা পাঠালাম তাহমিনা শিল্পীকে-
‘নিশ্চিন্তে চলে এসো। কলকাতা সবার জন্য। সকলেই আমরা পাশে আছি। আমিও থাকছি কলকাতায়। দরকারে ফোন কোরো’।
ততদিনে তাহমিনা আমায় ‘দাদা’ বলে সম্বোধন করা শুরু করেছে। এমন অনেক বিনি সুতোয় রাখিবন্ধনের কাছের মানুষ এপারের, এপারের কবিবন্ধুরা, স্বজন যাঁরা- সবাই এক ভরসা দিয়েছেন- কলকাতা আছে কলকাতাতেই.. ভয় নেই বিন্দুও।

তাহমিনা এলেন, নির্ভয়ে কবিতা বললেন, সব জায়গায় ঘুরলেন সপরিবারে, ফিরেও গেলেন; যেমন এসেছিলেন। কলকাতা থাকল কলকাতাতেই- তার প্রসারিত হৃদয় নিয়ে; বরাবরের মত।
আমার মনে পড়ছে অনুজপ্রতিম লোকশিল্পীবন্ধু নাজমুল হকের গাওয়া একটি গান-
“আমার মায়ামাটি ভাগ করে
এখন ঝুরে আঁখি
এপার বাংলা ওপার বাংলা
ছিল মাখামাখি..”
— বাংলাদেশের কবিয়াল-গায়ক অনিল খ্যাপা’র (দাস) এই গানটিকে, এই মুহূর্তে, একটু পরিমার্জন করে বলতে ইচ্ছে করছে– ‘ছিল’ মাখামাখি, ‘আছে’ মাখামাখি, ‘থাকবে’ মাখামাখি…

ভালো থেকো বড়শশী
ভালো থেকো ভাউলাগঞ্জ
ভালো থেকো বাঙলা
ভালো থেকো তাহমিনা

–আবার এসো, বারবার।

 

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here