হীরেন পণ্ডিত:: মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক মর্যাদা দিয়ে। এই শ্রেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠত্বের রহস্য হলো বিবেক, বুদ্ধি ও জ্ঞানের মাধ্যমে সত্য-মিথ্যা, কল্যাণ-অকল্যাণ, ভালো-মন্দ যাচাইয়ের মাধ্যমে সঠিক পাঠ ও পথ গ্রহণ ও অবলম্বন করা। তাই সহায়-সম্বলহীন, সর্বহারা, হতাশাগ্রস্ত মানুষকে প্রাণবন্ত করে নিঃস্বার্থভাবে অপরের সেবায় আত্মনিয়োগ করার নামই মানবসেবা।

মানুষকে ভালোবাসা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে ভালোবাসা, হিংসা প্রতিহিংসা থেকে দূরে থাকা, একে অপরের কাজে সহযোগিতা করা, মানবসেবা ও সামাজিক কার্যক্রমে ভূমিকা রাখা আমাদের দৈনন্দিন কাজের অংশ। নিঃস্বার্থভাবে মানবতার দোয়ার খুলে নিরবচ্ছিন্নভাবে মানবতার সেবা করাই হোক মানুষের লক্ষ্য।

প্রকৃত সুখ কোথায়? অন্যকে ফাঁকি দিয়ে নিজের সুখটুকু ভাগ করে নেওয়াতে কি সত্যিকারের সুখ আছে? আত্মার তৃপ্তির কাছে জড় দেহের ভোগ সুখের মূল্য কিছুই না। যতদিন না মানুষ অন্যকে সুখ দিতে আনন্দবোধ করবে ততদিন তার যথার্থ কল্যাণ সাধন সম্ভব নয়।

শুধু তাই নয়, যে ব্যক্তি অন্যের কল্যাণের ইচ্ছা পোষণ করে, সে প্রকৃত পক্ষে নিজের কল্যাণই নিশ্চিত করে। সামাজিক সংগঠনে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে কাজ করার প্রেরণা পাওয়া যায়। সামাজিক সংগঠনে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে ইতিবাচক গুণাবলী তৈরি হয়। মানুষের মধ্যে নেতৃত্ব-গুণ তৈরী হয়। দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি পায়, সামাজিক দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি পায়। প্রতিটি সামাজিক সংগঠনের মৌলিক বিষয় একই। সামাজিক সংগঠনে সবার মতকে শ্রদ্ধা করা, সদস্য হিসেবে নিজ দায়িত্ব পালন করা, নিজেকে বিকশিত করা, একসঙ্গে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হওয়াসহ সহনশীল হওয়া শেখায়।
এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিবেকানন্দ স্টাডি এন্ড ফিলানথ্রোপিক সেন্টার অফ নিউইয়র্ক, আমেরিকা। প্রকাশ চক্রবর্তী একজন শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী এবং ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তন ছাত্র, একজন আমেরিকান প্রবাসী বাংলাদেশী। তিতস বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা প্রচারের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তাঁর উদ্যোগে ঢাকার অদূরে টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলার উত্তর রোয়াইলের একটি অবহেলিত ও প্রত্যন্ত গ্রামে রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন এই উত্তর রোয়াইল রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম এলাকার সকল মানুষের কাছে আশা ও একটি আস্থার নাম।
বিবেকানন্দ স্টাডি অ্যান্ড ফিলানথ্রোপিক সেন্টার নিউইয়র্ক-এর নতুন প্রকল্পের অংশ হিসেবে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উত্তর রোয়াইল রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমে “স্বামী অক্ষরানন্দ ভবন” এর উদ্বোধন করেন রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের অধ্যক্ষ স্বামী পূর্ণাত্মানন্দজি মহারাজ। চট্টগ্রাম রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী শক্তিনাথান্দজী মহারাজ ও কুমিল্লা রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী বিশে^শ্বরানন্দজী মহারাজ, ৬ জন সম্মানিত ব্রহ্মচারী এবং উক্ত এলাকার ৫০০ জনেরও বেশি ভক্তবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। নবনির্মিত ভবন এবং এর আধুনিক সুযোগ-সুবিধা এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামবাসীদের মাঝে আধ্যাত্মিক চেতনা উদ্ধুদ্ধ করতে সচেষ্ট হবে। আশ্রমের স্বামী স্বহানন্দজী ফ্রি কোচিং সেন্টারের মোট ১৭৫ জন ছাত্র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এই কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রাম রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী শক্তিনাথানন্দজীর (নিখিল মহারাজ) দৈনন্দিন পরামর্শ ও নির্দেশনা এবং শ্রদ্ধেয় বিবেক মহারাজ ও তাঁর স্বেচ্ছাসেবকদের দলের নিঃস্বার্থ কাজ, ইঞ্জিনিয়ার দীপঙ্কর পন্ডিত এবং এলজিইডি’র ইঞ্জিনিয়ার স্বপন পালের সর্বাত্মক সহযোগিতার কারণে এই কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। বেলুড় মঠের শ্রদ্ধেয় সভাপতি মহারাজ শ্রীমৎ স্বামী স্মরণানন্দজী এবং শ্রদ্ধেয় সাধারণ সম্পাদক স্বামী সুবীরানন্দজী, শ্রদ্ধেয় স্বামী চেতনানন্দজী, অধ্যক্ষ সেন্ট লুইস মিসৌরি রামকৃষ্ণ মিশন এবং ক্যালিফোর্নিয়ার হলিউড রামকৃষ্ণ মিশন অধ্যক্ষ সর্বদেবানন্দজী লিখিত বার্তা ও ভিডিও বার্তার মাধ্যমে তাঁদের আশীর্বাদ বার্তা পাঠিয়ে এই কার্যক্রমকে উৎসাহিত করেন এবং এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য এবং সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করেন।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে স্বামী অক্ষরানন্দ মহারাজ বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি স্বামী বিবেকানন্দ এবং শ্রী রামকৃষ্ণের ধর্মোপদেশ এবং চেতনা প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ হিসেবে বাংলাদেশে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
কিছুদিন আগেও উত্তর রোয়াইল ছিলো ঢাকার অদূরে টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলার এক অবহেলিত জনপদ। এ যেন ছিলো বাতির নিচে এক অন্ধকার! স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমাদের দেখতে হয়েছিলো মূল সড়কের সাথে এ রকম বিচ্ছিন্ন জনপদের চিত্র, যেখানে বাস করে প্রায় ২০০০ নারী-পুরুষ !
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের ঘোষিত আমার গ্রাম-আমার শহর কার্যক্রম বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে দেশের ৮৭,২৩০টি গ্রামকে উন্নত গ্রামে রূপান্তরের বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসাবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সড়ক সংযোগবিহীন দেশের সকল গ্রামের তথ্য সংগ্রহ করছে এবং পর্যায়ক্রমে ঐ গ্রামগুলোকে মূল সড়কের সাথে সংযোগের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলছে। তারই অংশ হিসাবে অবহেলিত ও বিচ্ছিন্ন উত্তর রোয়াইল গ্রামকে মূল সড়কের সাথে সংযুক্ত করার জন্য এলজিইডি চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সড়ক উন্নয়নের একটি স্কীম বাস্তবায়নের কার্যক্রম গ্রহণ করেছে যা বর্তমানে চলমান আছে। এ কার্যক্রম নিয়মিত পরিদর্শন করছেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রকৌশলী। কি আছে বা কি চলছে এ গ্রামে সেদিকে এবার একটু দৃষ্টি প্রসারিত করা যাক। এ গ্রামে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে উত্তর রোয়াইল রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম-যা ক্রমেই হয়ে উঠছে এ এলাকার একটি আশার নাম একটি ভরসার নাম। এখানে একটি স্থাপনা নির্মাণ করে একদিকে চলছে শিশু প্রতিভা বিকাশে “সারদা-নিবেদিতা শিশু নিকেতন”- এর কার্যক্রম, অন্যদিকে বিবেকানন্দ স্টাডি সার্কেল এর পরিচালনায় “ফ্রি কোচিং সেন্টার”, সারদা সংঘের পরিচালনায় “সচ্ছল নারী উন্নয়ন প্রকল্প”-এর সেলাই প্রশিক্ষণ ও অসচ্ছল, মেধাবী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ও উচ্চতর শিক্ষায় সহায়তা প্রদান এবং অসহায়দের চিকিৎসা সহায়তা, শিশু-কিশোরদের সংস্কৃতমনা করে গড়ে তুলতে সংগীত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা । “ফ্রি কোচিং সেন্টার” এ অংশগ্রহণ করছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আশে পাশের প্রায় ১৫টি গ্রামের কোমলমতি অসহায় দরিদ্র শিক্ষার্থীরা, যাদের মধ্যে বিনামূল্যে শিক্ষাসামগ্রী, ইউনিফর্ম ও টিফিন সরবরাহ করা হচ্ছে। সেবাশ্রমের সকল কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষায় সকল প্রকারের সেবা বাস্তবায়নে সেবাশ্রমের অবকাঠামোগত উন্নয়নে “মাস্টার প্ল্যান”-এর কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। মাস্টার প্ল্যানের অংশ হিসাবে “স্বামী অক্ষরানন্দ ভবন”-এর উদ্বোধন করা হলো। তাছাড়া খুব শীঘ্রই এখানে শুরু হবে স্বামী বিবেকানন্দ শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কাজ-যেটি হয়ে উঠবে এ এলাকার জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের লোকের মিলন কেন্দ্র। ঠাকুরের শ্রীমন্দির নির্মাণের কাজও দ্রæত শুরু হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা ।

এ বিশাল কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে সার্বিক সহযোগিতা ও অর্থায়নে বিবেকানন্দ স্টাডি এন্ড ফিলাথ্রোপিক সেন্টার অফ নিউইয়র্ক, আমেরিকা- এর পক্ষে যে মানুষটি দিন-রাত অহর্নিশি কাজ করে যাচ্ছেন তিনি হলেন এ এলাকার কৃতি সন্তান আমেরিকা প্রবাসী ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের একনিষ্ঠ ভক্তদের মধ্যে অন্যতম শ্রী প্রকাশ চক্রবর্তী।

প্রকাশ চক্রবর্তীর মতো আমাদের অন্যান্য প্রবাসী বন্ধুরা যদি নিজ নিজ এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এগিয়ে আসতো, তাহলে আমরা ২০৪১ এর আগেই উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে পেতাম। আর যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে এ কার্যক্রম বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁদের একজন হলেন বিবেকানন্দ মহারাজ। এ মহতী উদ্যোগের সাথে যাঁরা সংযুক্ত রয়েছেন তাদের অসংখ্য কৃতজ্ঞতা এবং আজকের অবহেলিত উত্তর রোয়াইল আগামী দিনে উন্নত বাংলাদেশ গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে- এটিই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
লেখক: প্রাবন্ধিক

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here