ঝর্না রহমান

ঝর্না রহমান :: তন্নিষ্ঠার বিয়েটা আর ঝুলিয়ে রাখা গেল না। করোনার জন্য বিয়েটাতে একটা গিটটু লেগে গিয়েছিল। এই বারে খুলে না দিলে এ গিটটু হবে যম গিটটু। বিয়েটা হওয়ার কথা ছিল আরও দু বছর আগে, দু হাজার আঠারোতেই। পল্লবের বাবা মা খুব চাচ্ছিল, মেয়ে বিদেশের ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আগেই আকদটা করে রাখতে। তন্নিষ্ঠার বাবা মায়েরও অমত ছিল না। কিন্তু তন্নিষ্ঠা রাজি ছিল না। বিয়ে হলে পড়াশোনা হ্যাম্পার হবে। পল্লব বলেছিল, কীভাবে হ্যাম্পার হবে? আমি কি বিদেশে গিয়ে তোমাকে বগলদাবা করে পালাবো না ক্যাফেতে বসে তোমার ক্লাসটাইম উড়িয়ে দিতে পারবো? না কোরো না প্লিজ। কলমাটা পড়ে ফেলি! কী হবে বল!

পল্লব কেমন ভ্যালভ্যাল করে তাকায়। তন্নিষ্ঠা সে চোখ দেখে ঝিকমিক করে হাসে। আরে! তুই দেখছি কেঁদে ফেলবি!
পল্লব হাসে। ধুর! কাঁদবো কেন? হেসেই বাঁচি না! আমার হবু বউ কত্ত মেধাবী! স্কলারশিপ নিয়ে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে যাচ্ছে!

তবে? বাচ্চাদের মত ভ্যালভ্যাল করে তাকাচ্ছিলি কেন?
পল্লব সামলে নেয়। বলে, আচ্ছা, যা তুই। বিদ্যাদিগগজ হয়ে ফিরে এসো তনু! হেই মা সরস্বতী, এই মেয়েটাকে বিদ্যের সাথে দুটো বুদ্ধিও দিও, যাতে বুঝতে পারে কে, কেন, কীভাবে তাকে মিস করে!

পল্লবের বাচ্চাবাচ্চা চোখ দুটো মাঝেমাঝেই তন্নিষ্ঠাকে কেমন উদাস করে দিতে লাগলো। রাতে শুয়ে শুয়ে বিদেশে দীর্ঘ সময় একা একা থাকার কথা চিন্তা করে। পল্লবের সাথে অনেকদিন দেখা হবে না, এটুকু ছাড়া তেমন খারাপ লাগে না। কারণ মানসিকভাবে বহুদিন ধরেই প্রস্ততি নিয়েছে তন্নিষ্ঠা। নিজেই খুঁজে খুঁজে বিদেশের ইউনিভার্সিটিগুলোতে স্কলারশিপের জন্য এপ্লাই করেছে। বেশ কয়েকটাতেই ভর্তির সুযোগ এসেছে। পল্লবের সাথে পরামর্শ করেই কিংসটনটা বেছে নিয়েছে।

তন্নিষ্ঠার মনটা ভিজে উঠতে শুরু করলো। আচ্ছা, হোক না আকদ! পল্লবকে নিয়েই তো জীবন গড়বে! তা হলে আকদ হয়ে থাকলে কী অসুবিধা! পল্লব তো সত্যিই কোনো বাঁধা সৃষ্টি করতে যাচ্ছে না! বরঞ্চ যখন সুযোগ পাবে পল্লবের সাথে চুটিয়ে ভার্চুয়াল প্রেম করা যাবে! জমিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে! কিন্তু সেটা কি আকদ না হলে করা যাবে না? ভার্চুয়াল প্রেমে তো আর শরীরী ব্যাপারট্যাপার থাকবে না? থাকলেই বা কী হত? তন্নিষ্ঠা আর পল্লব কি ওদের তিনবছরের প্রেমজীবনে একআধটুকু শরীর ছোঁয়াছুঁয়ি করেনি? ধেৎ! এসব কী ভাবছে?

কিন্তু যেদিন জানতে পারলো, বিদেশে যাওয়ার পরে তন্নিষ্ঠার মনমানসিকতা কী হবে বলা যায় না, অন্য কারো প্রতি ঝুঁকে পড়ে কি না, এই ভাবনায়ই পল্লবের পরিবার আসলে আকদটা করিয়ে রাখতে চাচ্ছে, সেদিনই মন থেকে পল্লবের ভ্যালভেলে চোখ রাবার দিয়ে ঘসে মুছে দিল। পল্লবকে সোজাসুজি বলে দিল, আমার ওপর তোর আস্থা থাকলে ফিরে এসে বিয়ে হবে, নইলে কেটে পড়! ভালোবাসা কি গরু, আকদের দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে, নইলে অন্যের ক্ষেতে মুখ দেবে?

ফেব্রুয়ারির শেষদিকে তন্নিষ্ঠা ইউনিভার্সিটির পাট চুকিয়ে দেশে ফিরে এলো। বাৎসরিক কোর্সগুলো শেষ হয়ে গিয়েছে, ফাইনাল গ্রেডিংও হাতে এসেছে। ফার্স্ট ক্লাস নম্বর আছে ওর। এখন লম্বা সময় পাবে থিসিস তৈরি করার জন্য। পরে সময়মত গিয়ে পেপার জমা দিলেই হবে। কাজেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফেলার জন্য সবাই তৈরি হয়ে গেল। ছাব্বিশে মার্চ বিয়ের ডেটও ঠিক হয়ে গেল। তখন কেউ চিন্তাও করেনি দুহাজার বিশ মানে গোটা বিশবিশ বছরটাই এমন বিষময় হয়ে উঠবে! করোনার ছোবলে পুরো বিশ্ব পরিস্থিতি ভয়ানক হয়ে গেল। জুলাই-র মধ্যেই কাজিন হিমু ভাই, প্রিয় বান্ধবী অহনার বর, ছোট মামার নিউইয়র্ক প্রবাসী মেয়ে জামিলা আপার ননদসহ কত চেনা পরিচিতজন চিরতরে চলে গেল! লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ আর মৃত্যু! মানুষ ঘরবন্দী হয়ে পড়লো! বন্ধ কর্মক্ষেত্র, মাস্কঢাকা মুখ, সামাজিক দূরত্ব, হাত ধোয়া, সব কিছুতে সংক্রমিত হওয়ার ভয়, জীবনটাকেই কেমন যান্ত্রিক করে তুললো।

পল্লবের সাথে দু বছরের অদর্শন করোনার জন্য তিন বছরে ঠেকতে চললো। তন্নিষ্ঠার মনে হয়, এখন যেন আর ওর জন্য উতলাও হয় না মন। উতলা হওয়ার সময় কোথায়? সারাক্ষণ তো ভয়েই থাকতে হয়! হাঁচি দিলে ভয়। কাশি দিলে ভয়। মাথা ব্যথায় ভয়। সবচেয়ে ভয় জ্বরের। সারাক্ষণই বাবা মা তন্নিষ্ঠার গায়ের তাপ পরীক্ষা করছে। রাতে মনে হয় গায়ের তাপে বিছানা গরম হয়ে উঠছে। মনে হয়, প্রেম ভালোবাসা বিয়েফিয়ে সবই মিথ্যা, মায়া! কী হবে, করোনায় তো কদিন পরে মারাই যাবো! তারপরেও তন্নিষ্ঠার বিয়েটা হয়ে গেল। আর দেরি করা সম্ভব ছিল না। কারণ, পল্লবের বৃদ্ধ দাদার শরীর ভালো যাচ্ছে না। এই বুড়োর করোনা হলে টেঁসে যেতে দুদিনও লাগবে না! দাদাকে নাতবউ দেখানোটা ফরজ। পল্লব বলে, আমিও করোনায় টেঁসে যেতে পারি। যাই বলো না বলো, জোয়ান মদ্দ ছেলে, বাসর ঘরে ঢোকার আগেই কবরে ঢুকতে চাই না। সতর্ক ব্যবস্থা হিসেবে বর কনে দুজনেরই করোনা টেস্ট করিয়ে নেয়া হল। দুজনেই নেগেটিভ। সুতরাং বিয়ে পজিটিভ হয়ে গেল।

বিষে বিষময় সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিনে মধুরঙা শেরওয়ানি পরে পল্লব বাসর ঘরে ঢুকে পড়লো। সোনালি কাতানে নিজেকে মুড়ে তন্নিষ্ঠা ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল জোছনার তলোয়ারের মত। মুখে সোনালি পুঁতির নকশা করা মাস্ক। বান্ধবী মৌ দিয়েছে, বিয়ের শাড়ির সাথে ম্যাচ করে! পল্লব অবাক হয়ে বলে, এখনো মাস্ক খোলনি? আমরা চুমু খাবো কীভাবে? আর দাঁড়িয়ে কেন, খাটে বসো! তন্নিষ্ঠা পল্লবের কথার উত্তর না দিয়ে হাতব্যাগ ঘেঁটে কিছু একটা খোঁজে।
তনু, কী খুঁজছো? পল্লব কাছে আসে।
তন্নিষ্ঠা ছিটকে দূরে সরে যায়। দূরে থাকো!
কেন? আশ্চর্য!
তন্নিষ্ঠা ব্যাগ থেকে হাত বের করে বলে, এই তো! পেয়েছি!
কী পেয়েছ?

থার্মোমিটার! তন্নিষ্ঠা থার্মোমিটার ঝাড়তে ঝাড়তে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, প্লিজ কিপ সিক্স ফিট ডিসট্যান্স ফ্রম মি। আমার টেম্পারেচার বেড়েছে! তন্নিষ্ঠা নিজেই দূরে সরে যায়। মাস্কটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে থার্মামিটারটা মুখের ভেতরে পুরে দেয়। বের করে পারদ চেক করে। আটানব্বই? নাহ, ঠিক রিডিং আসেনি! আর্মপিটে দিতে হবে!

শাড়ি ব্লাউজ চেলি অলঙ্কার ফুল ইত্যাদিতে তন্নিষ্ঠার সারা দেহ তখন কনের সাজে ঢাকা। সে পাগলের মতে সব খুলতে শুরু করে। পল্লব খাটের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে তন্নিষ্ঠার কাণ্ড দেখে। আচমকা তন্নিষ্ঠার হাত থেকে থার্মোমিটারটা উড়ে এসে পড়ে মেঝেতে। টুং করে শব্দ হয়ে মার্কিউরি বাল্বটা ভেঙে যায়। ভেতরের পারদটুকু মেঝেতে ছিটকে পড়ে। তরল ফোঁটাগুলো দু তিনটে ফাজিল জোনাকের মত ঝিকমিক করে চোখ মটকাতে থাকে। উজ্জ্বল আলোর নিচে অগ্নিশিখার মতো উন্মুক্ত দু বাহু তুলে হতভম্ব দাঁড়িয়ে থাকা তন্নিষ্ঠার তাপ পরখ করতে পল্লবকে কাছে আসতেই হয়!

 

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here