জেসমিন দীপা

ছোট গল্প- ‘অসুখ’

-জেসমিন দীপা

(লেখাটি Mental Disordersদের উৎসর্গকৃত)

 

চরিত্রের নাম রোমানা৷ বয়স কমবেশী আটচল্লিশ৷ মেনোপজ স্টেজ পার করে এসেছে৷ এ সময় মেয়েদের শরীরের হরমোন পরিবর্তন জনিত কারনে মেয়েদের মননশীলতায় ব্যপক পরিবর্তন দেখা দেয়৷ উচ্চ রক্তচাপ সহ নানান রকম শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়৷ মেজাজ হয় খিটখিটে৷ সন্দেহ বাতিকতা দেখা দেয়৷ মনে করে তার জীবনটা বোধ হয় শেষ হয়ে গেল৷
সে কর্মহীন হয়ে গেল৷ এসব ভাবনা থেকে দিনে দিনে এগ্রোসিভ হয়ে উঠে৷

রোমানা অসুস্থ৷ ভীষন ভাবে অসুস্থ৷ সব সময় অসুখের প্রকোপ থাকে না৷ কখনো খুব স্বাভাবিক৷ কখনো কখনো ভীষনভাবে রোগাক্রান্ত হয়ে যায় রোমানা৷
কিন্তু নিজের অসুস্থতা বুঝতে পারেনা রোমানা৷ আসলে মনের রোগ গুলোর ধরন এমনই হয়৷ আজ পর্যন্ত কোন পাগল নিজেকে পাগল বলে স্বীকার করেনি৷ বরং উল্টো রেগে যায়, কেন তাকে পাগল বলা হলো? যে বলছে , সেই পাগল৷ এটাও রুগীর পাগলামির একটি উপসর্গ৷
এমন রোগীরা প্রচন্ড ভাবে অসুখী থাকে৷ কারন তাদের মস্তিস্কে রোগ বাসা বাধা’র সাথে সাথে আসেপাশের সবাই কে তার কার্যক্রম দিয়ে, আচার আচড়ন দিয়ে অতিষ্ট করে রাখে৷পরিবার পরিজন সহ্য করে নেয় , কারন পরিবারের অতি গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্যকে তো ইগনোর করা যায় না৷
কারোর মা, কারোর বোন বা স্ত্রী যে নারী তার সংসারে একটা বিরাট ভূমিকা থাকে৷ সেই মা বোন বা স্ত্রী দায়িত্ব গুলো পালনও করে ভালো ভাবে, কিন্তু যখন অসুখ করে , অপ্রকৃতস্থ হয় তখন তো তাকে ফেলে দেয়া যায় না৷

এই ধরনের রুগীরা হয় প্রচন্ড সন্দেহ বাতিক৷ রোমানা ও তাই৷ রোমানা পৃথিবীর কাওকে বিশ্বাস করেনা৷ পরিবার সমাজ সংসার কাওকে না৷ সবাই কে অসহ্য মনে হয়৷ বোঝা মনে হয়৷
রোমানার জীবনে আছে হতাশা, অপ্রাপ্তি আর পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা৷ এখান থেকে অসুখের শুরু৷ তার সব সময় মনে হয় ওর যা আছে আমার তা থাকতে হবে, আরো বেশী থাকতে হবে৷ বন্ধুরা বা পরিচিতরা সফল যারা তাদের মতো হতে চায় , সব দিক দিয়ে৷ ও পারে আমি কেন পারবোনা, ওর যা আছে আমার কেন নেই এই প্রশ্ন গুলো রোমানাদের ক্ষিপ্ত করে তোলে৷

নিজের সতন্ত্রতা ভুলে যায়, হয়ে পরে পরশ্রীকাতর৷ নেমে পরে অসুস্থ প্রতিযোগীতায়৷ এই প্রতিযোগীতা, প্রতিযোগীতা খেলায় হেরে যেয়ে হয়ে পরে হিংস্র৷ অসুখ হয় তীব্র৷ কোন অষুধ কাজ করেনা৷

রোমানা তার আশে পাশের কাওকে বিশ্বাস করেনা৷ সবার প্রতি থাকে তীক্ষ্ম নজর৷ যেন পৃথিবীর সবার ভাল থাকা , পরিচ্ছন্ন থাকার সব দায়িত্ব নিয়ে রেখেছে৷
এসবই অসুখের অংশ৷ অসুখের লক্ষন৷ রোমানার যত পরিচিত আছে সবাই কে রোমানা প্রশ্ন করে তার কারো’র সাথে কোন প্রেমের সম্পর্ক আছে কিনা৷ এবং ক্লু খুঁজতে শুরু করে৷ দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর চেষ্টা করে৷ এবং নিজের মতো করে মনগড়া কাহিনীও তৈরী করে ফেলে৷ এবং খুব স্লাগ অনুভব করে, নিজের কৃতকার্যতায়৷

রোমানা তার স্বামীকে সহ্য করতে পারেনা এমন কি সন্তানদেরও নয় ৷ কিন্তু আমাদের বাঙ্গালী মেয়েরা শত কষ্ট বুকে চেপে রেখেও সংসার করে সারাজীবন৷

আমি মনে করি একজন মেয়ের সবচেয়ে বড় অপরাধ যদি অনুসন্ধান করা হয় তবে তা হবে তার স্বামীর অক্ষমতা৷ এই অক্ষমতা বিভিন্ন রকম হতে পারে৷

যে মেয়ে বা নারীর স্বামী অক্ষম সেই নারীর কোন সন্মান, নাম, যশ , আত্মসম্মান থাকেনা৷ সমাজে নানান ভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া, অপমান অবহেলিত হওয়া নিত্য সঙ্গী হয়ে যায়৷
রোমানা দিনে দিনে মানুষিক অসুস্থতা থেকে অনেকটা বিকৃত রুচি’র হয়ে গেছে৷ সে অনর্গল অশ্লীল ভাষায় কথা বলে৷ অশ্লীলতা তার প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে৷ লিখা এবং বলায়, চলনে বলনে৷ নারী পুরুষের সুন্দর সম্পর্ককে রোমানা দেখে কুৎসিত দৃষ্টিতে৷

একজন সুস্থ মানুষ যে ভাষায় কথা বলতে পারবেনা রোমানা তা খুব স্বাভাবিক ভাবে বলে৷ একজন শিক্ষিত মানুষ নূন্যতম বোধ থাকলে যে সব ভাষা বলতে পারবেনা, রোমানা তা অনায়াসে বলে৷

রোমানার সন্দেহ বাতিকতা ওর অসুখের উপসর্গ৷ হঠাৎ করে রোমানা একদিন তার এক পরিচিতার সাথে উঠে পরে লাগলো৷ রোমানার সন্দেহ পরিচিতা পরকীয়া তথা অবৈধ সম্পর্কে জড়িত৷ এবং তা একজনের সাথে নয়, একাধিক জনের সাথে৷ মিথ্যা সন্দেহের বশে , অযাচিত ভাবে যা মনে এলো চাপিয়ে দেয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করলো৷ অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করলো৷ পরিচিতা মেয়েটি যেখানে যেখানে যায়, যার যার সাথে কথা বলে, সবার সাথে সম্পর্ক তার৷ অনৈতিক সম্পর্ক৷ লেনদেনের সম্পর্ক, দৈহিক সম্পর্ক ৷
পরিচিতা যতই বলে ঠিক নয় ৷ ভুল, এসব বলা অন্যায় ৷ রোমানা মানতে নারাজ৷ রোমানা ডিটারমাইন্ড যেভাবেই হোক তাকে প্রুফ করতেই হবে, এবং সে উঠে পরে লেগে যায় ক্লু সংগ্রহে৷
উক্ত পরিচিতা , নাম সোমা৷ একজন মানুষ সে, তার হৃদয় আছে, ভালোবাসার মন আছে৷ সোমা’র কাওকে ভাল লাগতে পারে, সোমা কাওকে ভালোবাসতেও পারে, সোমার যদি কোন সম্পর্ক থেকেও থাকে সে তো বাধ্য নয় রোমানার কাছে তার জবাবদিহিতা করতে৷
এটি সোমার স্বাধীনতা৷ কিন্তু সোমা মিথ্যা সহ্য করতে পারেনা, মিথ্যে মেনে নিতে নারাজ৷ তাই সে প্রতিবাদ করে৷

কিন্তু লাভ হয়না৷ রোমানার অসুখ দিন দিন বাড়তেই থাকে৷ রোমানা উঠে পরে লাগে যে ভাবেই সোমাকে ব্যাভিচারী স্বীকার করাতেই হবে৷ এবং এতেই তার মুক্তি, রোমানা শান্তি এবং তৃপ্তি লাভ করবে৷ বলবে— ঐ যে বলেছিলাম না, দেখেন সবাই ইহাই সত্যি৷
রোমানা প্রয়োজনে সোমার বাসার সামনে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসাবে,এমনও ভাবে ৷
সোমাকে প্রস্তাব করে পবিত্র কুরআন ছুঁয়ে,
সন্তানের মাথা ছুঁয়ে বলো তোমার অবৈধ সম্পর্ক আছে৷
সোমাকে কবুল করিয়েই ছাড়বে৷
অসুখের মাত্রা যখন এমন পর্যায়ে চলে যায় তখন এটাকে আর অসুখ বলা যায় না৷

হয়ে যায় ক্রাইম, অপরাধ৷
এসব রুগীকে তখন নিতে হয় রিহেব সেন্টারে বা পাগলা গারদে৷ সুস্থতার জন্য৷
কিন্তু বিষয়টা খুব কষ্টের একটি অধ্যায়৷
এসব রিহেব সেন্টার গুলোর ব্যবস্থাপনা খুবই সংকীর্ণ৷ খাবার বা ভাল চিকিৎসা পত্র দূরে থাক শুনেছি সেখানে গেলে রোগীরা আরো বেশী অসুস্থ হয়ে যায়৷
তাই পরিবার থেকে সাধারনত চায়না রিহেব এ পাঠাতে৷
পাবনা মেন্টাল হসপিটালে এমন রোগীরা দীর্ঘ দিন থাকার পর সুস্থ হয়েও বাড়ি ফিরতে পারেনা৷ স্বজনরা ভুলেই যায় রুগীনিকে৷
স্বজনদের জীবনে রুগীনির প্রয়োজনীতা শেষ হয়ে যায়৷ খুঁজে পাওয়া যায়না বাড়ির ঠিকানা৷যেখানে , যার কাছে ফিরবে ওরা৷
ভয়াবহ ক্যান্সার যেমন , তিলে তিলে মৃত্যুর দুয়ারে পৌছে দেয় তেমনি মানুষিক অসুস্থতা৷ যখন তীব্র রুপ ধারণ করে তখন আর সারভাইভ করার আশা থাকেনা৷
তাই রোমানাদের জন্য করুনা হয়৷
রোমানারা চাইলেই হয়ত আত্ম নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে অনেকটা সংশোধন হওয়ার চেষ্টা করতে পারে৷
তাতে নিজের, সংসার ও সমাজের মঙ্গল ৷
রোমানা তুমি ভালো হয়ে যাও৷ কনফিডেন্ট ভালো কিন্তু অভার কনফিডেন্স ভালো নয়৷
তাই রোমানা তুমি নিজে শুদ্ধ হও, পরিচ্ছন্ন হও , অন্যের ভার নিতে হবে না৷ তার জন্য, তার পরিবার আছে, সমাজ আছে, রাষ্ট্র আছে ৷তাদের ভাবতে দাও৷ তারা ভাবুক৷

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here