জাতিসংঘ সদরদপ্তরে প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনবাংলা প্রেস, জাতিসংঘ সদরদপ্তর থেকে : জাতিসংঘ সদরদপ্তরে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতিসংঘ সদরদপ্তরের ৪নম্বর কনফারেন্স রুমে বাংলাদেশ, হাঙ্গেরি, মারিসাস, পেরু ও ভানুয়াতু স্থায়ী মিশনের এবং জাতিসংঘ সদরদপ্তর, নিউ ইয়র্কস্থ ইউনেস্কো অফিস ও নিউ ইয়র্ক সিটি’র মেয়র অফিসের যৌথ উদ্যোগে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-এই দুই পর্বে বিভক্ত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের এ আয়োজনের শুরুতেই স্বাগত ভাষণ দেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। আলোচনা পর্বে আলোচকগণ পৃথিবীর প্রতিটি ভাষার সংরক্ষণ ও সুরক্ষা, বহুভাষিক শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়া এবং ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বাহন হিসেবে গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
স্বাগত ভাষণে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন দিবসটি উপলক্ষে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাণীর অংশবিশেষ, “সারা বিশ্বের সকল নাগরিকের সত্য ন্যায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রেরণার উৎস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিশ্বের সকল ভাষা সংক্রান্ত গবেষণা এবং ভাষা সংরক্ষণের জন্য আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছি” উদ্বৃত করেন।
স্থায়ী প্রতিনিধি বলেন, “বিভেদ সংকুল পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে শ্রদ্ধা ও সম্প্রতি বাড়াতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মাতৃভাষার বৈচিত্র সমুন্নত রাখার মাধ্যমে আমারা সকল ধরনের কুসংস্কার ও জাতিগত বিদ্বেষ পরিহার এবং শান্তির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে পারি’।
তিনি আরও বলেন, “ভাষা ও সংস্কৃতিগত বৈচিত্রই আমাদের শক্তি”। ভাষা বৈচিত্রের এই শক্তি ধরে রাখতে তিনি জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রের প্রতি আহবান জানান।
জাতিসংঘ সদরদপ্তরে প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনরাষ্ট্রদূত মোমেন তার বক্তব্যে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রাজপথে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির বেদনাদায়ক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষার জন্য শহীদ হওয়ার একমাত্র ঘটনা। হাঙ্গেরির স্থায়ী প্রতিনিধি কাতালিন এ্যানামারিয়া বোগায়া বলেন, “মাতৃভাষা সংরক্ষণের মাধ্যমে আমরা আমাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে সংরক্ষণ করতে পারি। মাতৃভাষা শিক্ষা, অভিব্যাক্তির প্রকাশ এবং পারস্পারিক আদান প্রদানের জন্য অপরিহার্য”। তিনি জানান হাঙ্গেরিতে ১৩টি ভাষা রয়েছে। তারা এই ভাষাগুলোকে সংরক্ষণের জন্য কাজ করছে।
মারিসাসের স্থায়ী প্রতিনিধি জগদিস ধর্মচান্দ কজুল  বলেন, ‘মাতৃভাষা সংহতি ও সহিষ্ণুতা শিক্ষা দেয়। এই দিবস উদযানের মাধ্যমে আমরা যেন আমাদের বৈচিত্রের একতাকেই উদযাপন করছি’। তিনি মহান ২১শে ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদের প্রতি গভীর সমবেদনা ব্যক্ত করেন।
পেরুর স্থায়ী প্রতিনিধি গোসটাভো মেজা কোয়াদ্রা বলেন, ‘মাতৃভাষা সংরক্ষণ হচ্ছে কোন দেশের শিকড়কে সংরক্ষণ করা। সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করা- যার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব’। দেড় শতাধিক স্থানীয় ভাষা সমৃদ্ধ বিশ্বের অন্যতম সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের দেশ ভানুয়াতুর স্থায়ী প্রতিনিধি ওডো ট্যাভি বলেন, ‘সফল গণতন্ত্রের জন্য ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বহুভাষাবাদ ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র গ্রহণের মাধ্যমে আমরা প্রাজ্ঞ ও প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণ করতে পারি’।
জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক ইনফরমেশনের প্রধান ক্রিস্টিনা গ্যালাক বলেন, “পারস্পারিক সম্পর্ক, শ্রদ্ধা, সহিষ্ণুতা ও সংলাপ বৃদ্ধিতে জাতিসংঘ বহুভাষাবাদের প্রচারকে আরও তরান্বিত করছে’। তিনি বলেন, মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা ৫০০টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। ইউএন রেডিও ৬০টি ভাষায় জাতিসংঘের কর্মকান্ড সারা বিশ্বে তুলে ধরছে।
জেনারেল এসেম্বিলী, কনফারেন্স ম্যানেজমেন্ট এবং ওয়াইড কো-অর্ডিনেটর ফর মাল্টিলিঙ্গুয়ালিজম বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মিজ ক্যাথরিন পোলার্ড মাতৃভাষার উন্নয়নে সচেতনতা বৃদ্ধিতে বছর জুড়ে নিরলসভাবে কাজ করার জন্য বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি মাতৃভাষাকে স্ব স্ব সংস্কৃতির হৃদয় বলে উল্লেখ করেন।
এছাড়া অনুষ্ঠানটিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতি পিটার থমসন, ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ও নিউ ইয়র্ক সিটি মেয়রের বাণী পড়ে শোনানো হয়।
বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক পর্বের সুচনায় যুক্তরাষ্ট্রের শ্রী চিন্ময় গ্রুপ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ নিয়ে মনোমুগ্ধকর থিম সঙ্গীত এবং শ্রী চিন্ময় এর ইংরেজি ভাষায় রচিত একটি কবিতা বিভিন্ন ভাষায়   আবৃত্তি করেন। অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক স্কুলের শিক্ষার্থীগণ, ইউএন লারর্নিং সেন্টার ফর মাল্টিলিংগুয়ালিজম এন্ড ক্যারিয়ার ডিভোলোপমেন্ট এর শিক্ষকগণ, জাতিসংঘের জেনারেল এসেম্বিলি ও কনফারেন্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগে কর্মরত ভাষা কর্মীগণ গান, আবৃত্তিসহ বিভিন্ন বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা তুলে ধরেন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীর বিক্রম এবং জাতিসংঘে নিযুক্ত সদস্য দেশগুলোর স্থায়ী প্রতিনিধিগণ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাঙালি ও মিডিয়া প্রতিনিধিগণ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here